শুরুতে সনাক্ত হলে ক্যান্সার নিরাময় হয়

ফাইল ছবি

আজ বিশ্ব ক্যান্সার দিবস

শুরুতে সনাক্ত হলে ক্যান্সার নিরাময় হয়

অধ্যাপক ডা. কাজী মনজুর কাদের

পৃথিবীতে যে কয়টি রোগের নাম শুনলে মানুষ আঁতকে ওঠে, ক্যান্সার এগুলোর মধ্যে অন্যতম। ক্যান্সারকে ধরা হয় মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে। প্রায় ১৩ শতাংশ মৃত্যু ঘটে ক্যান্সারের কারণে। সারা বিশ্বেই ক্যান্সার একটি মারাত্মক অসুখ।

আজ বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। তাই আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনিয়ন ফর ইন্টারন্যাশনাল ক্যান্সার কন্ট্রোল (ইউআইসিসি) প্রতিবারই বিশ্বব্যাপী নানা কর্মসূচির মাধ্যমে ক্যান্সারে মৃত্যুর হার কমানোর কথা জোরালোভাবে তুলে ধরে আসছে।  

ক্যান্সার কী?
সাধারণভাবে ক্যান্সার প্রাণঘাতী ও মারাত্মক জটিল রোগ, যা সঠিক সময়ে নির্ণয় ও চিকিৎসা না পেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মৃত্যু ডেকে আনে। বৈজ্ঞানিকভাবে বলা যায়, যখন শরীরের কোনো স্থানে অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে কোষ বৃদ্ধি হয়ে চাকা বা পিণ্ডের সৃষ্টি হয়, তখনই ক্যান্সার রূপ ধারণ করে এবং রক্তনালি ও লসিকানালির মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।

ধীরে ধীরে মানুষকে অকালমৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।

গঠন
কোটি কোটি কোষের সমন্বয়ে মানবদেহ গঠিত। এই কোষের কেন্দ্র হলো নিউক্লিয়াস, যার ভেতরে থাকে ক্রমোজম। জিন থাকে ক্রমোজমের মধ্যে এবং ডিএনএ থাকে জিনের মধ্যে। এই জিন সাধারণ বংশের ধারা রক্ষা করে। শরীরের বৃদ্ধির সামঞ্জস্যতা, গঠন, চুল ও চোখের রং সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। এই জিনের সামঞ্জস্যপূর্ণ কার্যকারিতার জন্যই মানুষ ছোট থেকে বড় হয়। আবার একপর্যায়ে বৃদ্ধি হওয়াও থেমে যায়। প্রয়োজন অনুযায়ী কোষসংখ্যা বৃদ্ধিতে যে জিনগুলো ভূমিকা পালন করে থাকে, তার মধ্যে একটি জিন ‘পটোঅনকোজিন’, যা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থ। যেমন—ভাইরাস, রাসায়নিক পদার্থ (কার্সিনোজেন) ইত্যাদি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে অনকোজিনে রূপান্তরিত হলে সেই কোষের বৃদ্ধি অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলতে থাকে।

আবার অপ্রয়োজনীয় কোষ সৃষ্টিতে বাধাদানকারী আরেক ধরনের জিন আছে, যার নাম ‘ক্যান্সার সাপ্রেসরজিন’। মূলত এই সাপ্রেসরজিনের কার্যকারিতা নিস্ক্রিয় হলেই ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।

কারণ
সুনির্দিষ্ট কোনো কারণে ক্যান্সার হয় না। এটি সৃষ্টিতে একাধিক কারণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। তবে ক্যান্সার হওয়ার জন্য বংশগত ও পরিবেশগত কারণকেই মূলত দায়ী করা হয়।

বংশগত : ক্যান্সারের সঙ্গে জিনগত বা বংশগত সম্পর্ক রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই পরিবারের কারো যদি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা থাকে, তাহলে অন্যদেরও ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অনেকখানি বেড়ে যায়। বংশগত কারণে সাধারণত যেসব ক্যান্সার হয়, তার মধ্যে স্তন ক্যান্সার, বৃহদন্ত্রে ক্যান্সার, শিশুদের চোখের ক্যান্সার, কিছু কিছু ক্ষেত্রে কলোরেক্টাল ক্যান্সার ইত্যাদি।

পরিবেশগত

পরিবেশগত কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—

ভৌত কারণ : রোদে বেশিক্ষণ থাকার কারণে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির কারণে ত্বকের ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। এ ছাড়া এক্স-রে, গামা রে অন্যতম কারণ।

রাসায়নিক পদার্থ : রঙের কারখানা, রাবার বা গ্যাসের কাজে যারা নিয়োজিত, তারা এক ধরনের বিশেষ রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসার কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া ধূমপানের ধোঁয়ায় বিদ্যমান ক্ষতিকর পদার্থ (কারসিনোজেন), রঞ্জক পদার্থ অসম্পূর্ণভাবে পোড়া আমিষ, শর্করা বা চর্বিজাতীয় খাদ্য ইত্যাদিও দায়ী।

ভাইরাস : কিছু কিছু ভাইরাস ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। যেমন—হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস, হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাস, এপেস্টেইন বার ভাইরাস ইত্যাদি। জরায়ুমুখের ক্যান্সারের জন্য দায়ী করা হয় হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাসকে। লিভার ক্যান্সার হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস দ্বারা হয়ে থাকে। আবার এপেস্টেইন বার ভাইরাস দ্বারা গলার ক্যান্সার ও লসিকাগ্রন্থির ক্যান্সার হয়।

অন্যান্য কারণ : কিডনি বা পিত্তথলির পাথর থেকেও ক্যান্সার হতে পারে। সার্ভিক্স বা বোনের ক্রনিক ইনফেকশন থেকে জরায়ু ও বোনের ক্যান্সার হয়। রাসায়নিক বা কেমিক্যাল এজেন্ট, যেমন—এনিলিন ডাইয়ে মূত্রথলির ক্যান্সার হয়। খাদ্যে ব্যবহৃত ফরমালিন (পচনরোধক পদার্থ) স্টমাক বা পাকস্থলীর ক্যান্সার সৃষ্টি করে। চুলের কলপের ব্যবহারে স্কিন ক্যান্সার হতে পারে।

চিকিৎসা
ক্যান্সারের ধরন অনুযায়ী শল্যচিকিৎসা, রেডিওথেরাপি বা বিকিরণ চিকিৎসা, কেমোথেরাপি, হরমোন চিকিৎসা ও ইমিউনোথেরাপি, টারগেটেড থেরাপি ইত্যাদির মাধ্যমে সমন্বিতভাবে চিকিৎসা প্রদান করা যায়।

শল্যচিকিৎসা (সার্জারি) : স্তন, প্রস্টেট ক্যান্সারসহ কিছু চিকিৎসায় সার্জারি রোগীকে বেশি আরোগ্য করে। শরীরের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়া টিউমারের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা অবশ্য নগণ্য।

রেডিওথেরাপি : অপারেশনের পরও খালি চোখে দেখা যায় না—এমন কিছু ক্যান্সার কোষের সহায়ক চিকিৎসা হিসেবে দেওয়া হয় রেডিওথেরাপি, বিশেষ করে এ রোগ মস্তিষ্ক বা হাড়ে ছড়িয়ে পড়লে জরুরিভাবে পেলিয়েশন বা প্রশমন করার জন্য রেডিওথেরাপির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে রেডিওথেরাপি দেওয়া যায় বলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা খুবই কম থাকে।

কেমোথেরাপি ও হরমোন : ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায় কেমোথেরাপি ও হরমোনথেরাপি প্রয়োগ করা যায়। সামগ্রিকভাবে শরীরের সর্বত্রই এ রোগের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য এর ব্যবহার অপরিহার্য। দেখা গেছে, খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণীত হলে এবং যথোপযুক্ত চিকিৎসা নিলে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ রোগী ১০ বছরেরও বেশি বেঁচে থাকে। মাঝ পর্যায়ে নির্ণীত হলে এই হার ৫০ থেকে ২৫ শতাংশে নেমে আসে এবং শেষ পর্যায়ে ভালো কিছু করার সুযোগ প্রায় থাকেই না।

লেখক : অধ্যাপক ডা. কাজী মনজুর কাদের, বিভাগীয় প্রধান, অনকোলজি বিভাগ, ডেলটা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল।

news24bd.tv/health

এই রকম আরও টপিক