বাংলাদেশের সঙ্গে আরাকান আর্মির সম্পৃক্ততা

প্রশিক্ষণরত অবস্থায় আরাকান আর্মির সৈন্যরা।

ফ্রন্টিয়ারের বিশেষ প্রতিবেদন

বাংলাদেশের সঙ্গে আরাকান আর্মির সম্পৃক্ততা

অনলাইন ডেস্ক

গত ১৪ জানুয়ারি দক্ষিণ চিন প্রদেশের পালেটা শহরের বেশকিছু প্রশাসনিক ভবনে আরাকান আর্মি রাখাইনের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার মাধ্যমে শহরটিকে জান্তার নিয়ন্ত্রণমুক্ত বলে ঘোষণা করে। একই সময়ে গোষ্ঠীটি পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশ সংলগ্ন ৮০ কিলোমিটার বিস্তৃত সীমান্ত এবং ভারতের সাথে গুরুত্বপূর্ণ একটি বাণিজ্যিক করিডরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

রাখাইন এবং চিন প্রদেশে জান্তা সৈন্যদের বিরুদ্ধে হামলা পরিচালিত করার মাত্র দুই মাসের মাথায় আরাকান আর্মি এই তুমুল বিজয়ের দেখা পেলো। এই আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ গোষ্ঠীটিকে রাখাইন রাজ্যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আরও নিকটে নিয়ে এসেছে।

এর ফলে আরাকান আর্মিকে ইতোপূর্বে এড়িয়ে চলা ভারত এবং বাংলাদেশের সাথে গোষ্ঠীটির সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির সাথে পরিচিত একজন ব্যক্তি ফ্রন্টিয়ারকে জানান, দীর্ঘদিন ধরেই আরাকান আর্মি ও বাংলাদেশের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক সম্পৃক্ততা রয়েছে। অধিকাংশ লেনদেনই ঘটেছে সীমান্তে নিয়োজিত সৈন্যদের মাঝে, এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে খুব কমই জানে।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরাকান আর্মির সাথে সম্পৃক্ততা স্বীকার করার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এসেছে এবং মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে এসেছে।

তবে, এ ব্যাপারে জ্ঞাত ব্যক্তিদের মতে, বাংলাদেশে বসবাসকারী দশ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর মতো ইস্যুতে দেশটির সরকার আরাকান আর্মিকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন বলে মনে করে।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই বিশ্লেষক ফ্রন্টিয়ারকে জানান, যদি মিয়ানমারে কোনো স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয় কিংবা জান্তা সরকার যদি আরাকান আর্মিকে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ছেড়ে দেয় কেবল তবেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আরাকান আর্মির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়া সম্ভব হবে।  

বাংলাদেশের সাথে সম্পৃক্ততার প্রতি জোর দিলেও আরাকান আর্মির জন্য প্রধান চিন্তার বিষয় হচ্ছে বৈশ্বিক পরাশক্তি চীনের সাথে সম্পর্ক রক্ষা। রাখাইন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ একজন ব্যক্তির মতে, চীন হচ্ছে আরাকান আর্মির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং অন্য যে কারও চাইতে আরাকান আর্মির ওপর চীনের প্রভাব অনেক বেশি।

চীনও আরাকান আর্মির সাথে তাদের সম্পর্ককে গুরুত্বের সাথে দেখে এবং দেশটি মিয়ানমারের কিয়াকফু থেকে চীনের কুনমিং পর্যন্ত বিস্তৃত তেল ও গ্যাস পাইপলাইনের সুরক্ষার আশ্বাস দিয়েছে। এছাড়াও কিয়াকফু শহরে চীন একটি গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সীমান্তে অস্থিরতা নিরসনের জন্য এবং নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য চীন মধ্য জানুয়ারিতে শান প্রদেশে ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি এবং ট্যাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির মধ্যে যুদ্ধবিরতি সম্পাদন করেছে এবং এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছে।

আরেকটি আঞ্চলিক পরাশক্তি হচ্ছে ভারত, যারা এখন পর্যন্ত আরাকান আর্মিকে স্বীকার করার ক্ষেত্রে অসম্মতি জানিয়ে এসেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অস্বীকার করলেও আরাকান আর্মির সাথে দেশটির সম্পৃক্ততার ইতিহাস বেশ পুরোনো, এবং পালেটা শহর দখলের ফলে উভয়ের মধ্যকার সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেতে যাচ্ছে।

পালেটা শহর ভারতের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই শহরের মধ্য দিয়েই ভারত কলকাতা বন্দরের সাথে তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যকে সংযুক্ত করার মহাপরিকল্পনা করেছে। প্রকল্পটি বেশ পুরোনো হলেও মিয়ানমারে চলমান অস্থিরতার ফলে এর কাজ বেশ কয়েকবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে।  

ভারতের সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের সহযোগী ফেলো অংশুমান চৌধুরী ফ্রন্টিয়ারকে জানান, প্রকল্পটির ব্যবহারিক মূল্য না থাকলেও রাজনৈতিক মূল্য রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যেহেতু আমাদেরকে তাদের বন্দরগুলো ব্যবহার করতে দিয়েছে সেহেতু মিয়ানমারের সিতে হয়ে পালেটা যাওয়ার আমাদের কি দরকার? এই প্রকল্পের মূল্য থাকবে যদি ভারত চীনের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করতে চায়।

তবে সাম্প্রতিক যুদ্ধ প্রমাণ করেছে যে মিয়ানমারে প্রভাব বিস্তার করতে হলে ভারতকে আরাকান আর্মির মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীদের সাথে সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। চীনকে প্রতিহত করতে গিয়ে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করায় ভারতকে অনেক সমালোচিত হতে হয়েছে। তবে চীনের নিকটস্থ সশস্ত্র গোষ্ঠীর কাছে একের পর এক এলাকা হারানোর ফলে ভারতকেও এখন জান্তা সরকারের সাথে তাদের সম্পর্ক নিয়ে পুনরায় ভাবতে হবে।

বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ইস্যুটি আরাকান আর্মির জন্য দারুণ সুযোগের সৃষ্টি করেছে। এ ব্যাপারে চীন মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করলেও দেশটির বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন মধ্য জানুয়ারিতে জানিয়েছেন যে প্রক্রিয়াটি বাধার সম্মুখীন হয়েছে। তার মতে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের আগে চীন রাখাইন প্রদেশে যুদ্ধবিরতি চায়।

আরও পড়ুন: মালদ্বীপের জলসীমায় ঢুকে পড়েছে ভারতীয় সৈন্যরা

বাংলাদেশের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোকেই আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছি।

মিয়ানমারে ফেরার শর্ত হিসেবে রোহিঙ্গারা তাদের নিজেদের বাড়িতে ফিরতে চায় এবং নাগরিকত্ব ফিরে পেতে চায়। কিন্তু রোহিঙ্গাদেরকে উৎখাতের পর জান্তা সরকার তাদের বাড়িঘরে সীমানা প্রাচীর তুলে দিয়েছে যার ভেতরে রোহিঙ্গাদেরকে নজরদারি করা হবে এবং তাদের চলাফেরা সীমিত করে দেয়া হবে।

ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের প্রতিষ্ঠাতা রো নায় সান লিন বলেন, রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোকে কারাগারে পরিণত করা হয়েছে, এবং ভবিষ্যতে এগুলো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত হবে। এমন অবস্থায় কোনো রোহিঙ্গাই বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ফেরত আসতে চাইবে না।

নিজেদেরকে জান্তা সরকারের চাইতে নমনীয় বলে প্রচার করে আসা আরাকান আর্মির জন্য তাই সামনে সুবর্ণ সুযোগ। তবে রোহিঙ্গারা মনে করেন তারা জান্তা ও আরাকান আর্মির মধ্যকার যুদ্ধে আটকা পরে আছেন।

আপাতত বাংলাদেশ সরকার কবে মিয়ানমারের জান্তা সরকার আরাকান আর্মিকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসে তার জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মিজানুর রহমান ফ্রন্টিয়ারকে বলেন, আরাকান আর্মিকে সম্পৃক্ত করার দায়িত্ব জান্তা সরকারের, আমাদের নয়।

তবে বাংলাদেশকে এর জন্য বেশ কিছুকাল অপেক্ষা করা লাগতে পারে, কারণ জান্তা সরকার সহজে আরাকান আর্মিকে অংশীদার করতে চাইবে বলে মনে হচ্ছে না।

সূত্র: ফ্রন্টিয়ার

news24bd.tv/ab