প্রতারণা ও ধোঁকাবাজির শাস্তি

প্রতারণা ও ধোঁকাবাজির শাস্তি

মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় মানুষের অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। পাল্টে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা। জীবনের গতিতে এসেছে নতুন মাত্রা। পাশাপাশি মানুষের সমস্যাগুলোও নতুন মোড়কে আবির্ভূত হচ্ছে।

এখন অপরাধীরাও প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষকে প্রতারিত করার নতুন নতুন অভিনব পদ্ধতি বের করছে। মানুষকে ঠকানোর সুযোগসন্ধানী এই শ্রেণি সব যুগেই দুনিয়ায় ছিল। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তুমি তাদের মধ্যে থেকে অনেককে দেখতে পাবে যে তারা পাপে, সীমা লঙ্ঘনে এবং হারাম ভক্ষণে ছোটাছুটি করছে। তারা যা করছে, নিশ্চয়ই তা কতই না মন্দ!’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ৬২)

বর্তমানেও একদল প্রতারক মানুষের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, অর্থ ইত্যাদি হাতিয়ে নিচ্ছে সূক্ষ্ম কূটচালের মাধ্যমে।

যার মধ্যে একটি পদ্ধতি হলো এটিএম কার্ড জালিয়াতি। যেহেতু এখন অনেক মানুষই ক্যাশলেস লেনদেনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, তাদের শপিং মল, রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে পেট্রল পাম্প ইত্যাদিতেও এটিএম কার্ড ব্যবহার করে পরিশোধের প্রবণতা বেড়েছে। এর সুযোগে এক শ্রেণির মানুষ এই সিস্টেমগুলো থেকে কিভাবে মানুষের মূল্যবান তথ্য হাতানো যায় এবং তা ব্যবহার করে পরে তাদের টাকা-পয়সা চুরি করা যায় সে রাস্তা অনুসন্ধানে নেমে পড়েছে।

অনেক সময় বিভিন্ন ই-কমার্স ওয়েবসাইটের আড়ালে লোভনীয় অফার দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা মানুষের কার্ডের তথ্য হাতিয়ে নেয়।

আবার কখনো হ্যাকাররা বিভিন্ন সুপারশপের নিরাপত্তাহীন কম্পিউটার বা নেটওয়ার্ক হ্যাক করে মানুষের কার্ডের তথ্য চুরি করে। অনেক সময় প্রতারকচক্রের সদস্যরাই সেলসম্যানের বেশে ভোক্তার কার্ডের তথ্য চুরি করে পরবর্তী সময়ে তাদের অ্যাকাউন্টের টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়।

২০১৮ সালে আমাদের দেশেই এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল। রাজধানীর বনানী এলাকার একটি সুপারশপে কেনাকাটা করেছেন, এমন ৪৯ গ্রাহকের কার্ড জালিয়াতি করে একটি চক্র লাখ লাখ টাকা তুলে নেয়। গণমাধ্যমের তথ্য মতে, সুপারশপের ছদ্মবেশী সেই বিক্রয়কর্মীর হাতে বিশেষ ডিজিটাল ঘড়ি থাকত, যাতে ছিল ‘স্ক্যানিং ডিভাইস’, এর মাধ্যমে সে মুহূর্তেই মিনি কার্ড রিডারের সব তথ্য সংগ্রহ করতে পারত।

তার বাসায় পাওয়া গিয়েছিল বিশেষ প্রিন্টার, ক্লোন করার উপযোগী ভার্জিন কার্ড, যেগুলোর মাধ্যমে সে গ্রাহকের কার্ড ক্লোন করে নতুন কার্ড তৈরি করত। এর আগে ২০১৬ সালেও বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে তথ্য চুরি করে ক্লোন কার্ড তৈরি করেন বিদেশিরা। স্ট্যাস্টিটার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যে ব্যাংক কার্ডের মাধ্যমে জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে সাড়ে ২৭ লাখ। এখানে স্কিমিং ডিভাইস বা গ্রাহকের কার্ডের ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্য চুরির যন্ত্র ব্যবহার করে জালিয়াতির ঘটনা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধরনের জালিয়াতি জঘন্য অপরাধ। কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে অন্যের অর্থকড়ি হাতিয়ে নেওয়া, নিজের প্রযুক্তিগত দক্ষতার মহড়া নয়। এটি অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ হরণ, যা মহান আল্লাহ হারাম করেছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। আর তোমরা নিজেরা নিজেদের হত্যা কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু। আর যে ওই কাজ করবে সীমালঙ্ঘন ও অন্যায়ভাবে, আমি অচিরেই তাকে আগুনে প্রবেশ করাব। আর সেটি হবে আল্লাহর ওপর সহজ। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯-৩০)

অর্থাৎ যারা সীমালঙ্ঘন করে অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করবে মহান আল্লাহ তাদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.)-ও ধোকাবাজ ও প্রতাকরদের নিজের উম্মত বলে স্বীকার করবেন না। কেননা নবীজি (সা.) বলেছেন, প্রতারক ও ধোকাবাজের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। (তিরমিজি : ১৩১৫)

আর নবীজি (সা.) যার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছেন, তার মতো দেউলিয়া আর কেউ হতে পারে না, বিশেষ করে যারা প্রতারণার মাধ্যমে অর্থকড়ি হাতিয়ে নেয়, তাদের তো হাদিসের ভাষায় সরাসরি দেউলিয়াই ঘোষণা করা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের প্রশ্ন করেন, তোমরা কি জান, দেউলিয়া কে? তারা বলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমাদের মধ্যে দেউলিয়া হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যার দিরহামও (নগদ অর্থ) নেই, কোনো সম্পদও নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমার উম্মতের মধ্যে সেই ব্যক্তি হচ্ছে দেউলিয়া যে কিয়ামত দিবসে নামাজ, রোজা, জাকাতসহ বহু আমল নিয়ে উপস্থিত হবে এবং এর সঙ্গে সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কারো রক্ত প্রবাহিত (হত্যা) করেছে, কাউকে মারধর করেছে ইত্যাদি অপরাধও নিয়ে আসবে। সে তখন বসবে এবং তার নেক আমল হতে এ ব্যক্তি কিছু নিয়ে যাবে, ও ব্যক্তি কিছু নিয়ে যাবে। এভাবে সম্পূর্ণ বদলা (বিনিময়) নেওয়ার আগেই তার সৎ আমল নিঃশেষ হয়ে গেলে তাদের গুনাহগুলো তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে, তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৪১৮)

মহান আল্লাহ সবাইকে এ ধরনের পাপ থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন এবং এ ধরনের অপরাধীর চক্রান্ত থেকে হেফাজত করুন।