সীমান্তে সংঘাত: সারাদিনে যা যা হলো...

অনলাইন ডেস্ক

মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের মধ্যে রাখাইনের ম্রাউক ইউ ও কিয়াকতাও শহরে জান্তা বাহিনীর আরও দুটি ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর দখলে নেওয়ার দাবি করেছে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)। প্রতিদিন নতুন নতুন সামরিক ঘাঁটি দখল করছে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীরা। এই অবস্থায় প্রতিদিনই সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সদস্যারা। এই অবস্থায় সংঘর্ষ আর ওপার থেকে ভেসে আসা তীব্র গোলা–বারুদের শব্দে আতঙ্ক কাটছে না মিয়ানমার সীমান্তে থাকা জনপদগুলোতে।

 

সীমান্ত আইন লঙ্ঘন
মঙ্গলবার সকালে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে কক্সবাজারের বালুখালির জমিদার পাড়ায় ঢুকে তুমল যুদ্ধ করেছে বিজিপি ও আরাকান আর্মির সদস্যরা। গোলাগুলির বিকট শব্দে আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

নাইক্ষ্যংছড়ির ওপারে মিয়ানমারের তমব্রু ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি দখলে নিতে চারদিন ধরে গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপ করছে আরকান আর্মি ও মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা। এতে কেঁপে কেঁপে উঠছে জলপাইতলী, জমিদার পড়াসহ সীমান্তের অন্তত ১৩টি গ্রাম।

মার্টার শেল আর গুলি এসে পড়েছে বাংলাদেশেও।

উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা।

 আরও পড়ুন : কী ঘটছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে?

এদিকে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বালুখালি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বালুখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. ইউনুস বলেন, মিয়ানমারের সেনাদের গোলাগুলির কারণে স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

নাইক্ষ্যংছড়ির ২৪০ পরিবারকে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ২৪০ পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক (ডিসি)। মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত পরিদর্শনকালে জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন এ নির্দেশ দেন।

ডিসি বলেন, বান্দরবান-মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান পরিস্থিতির কারণে ছাত্রছাত্রী ও সীমান্তে অতি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারী ২৪০ পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সীমান্তবর্তী স্কুলগুলো বন্ধ ও সবাইকে আতঙ্কিত না হয়ে সজাগ থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয়রা জানায়, সীমান্তে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে। এরইমধ্যে সীমান্ত লাগোয়া দেশটির সরকারি বাহিনীর তমব্রু রাইট ক্যাম্প দখলে নিয়েছেন বিদ্রোহীরা। বর্তমানে ঢেকুবনিয়ে বিজিপি ক্যাম্প দখলে নিতে উভয় পক্ষের লড়াই চলছে। তাদের এ সংঘাতে ব্যবহার করা গুলি ও মর্টার শেলের গোলা সীমান্ত অতিক্রম করে এসে পড়ছে বাংলাদেশের ঘুমধুম এলাকার বিভিন্ন লোকালয়ে।

কী বলছে বিজিবি?
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেছেন, সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। নৌকাযোগে ৬৫ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করলে তাঁদের গ্রেপ্তার করে পুশব্যাকের চেষ্টা চলছে। কোনো অবস্থাতেই রোহিঙ্গাদের ঢুকতে দেওয়া হবে না।

বিজিবির মহাপরিচালক বলেন, আমরা ধৈর্য ধারণ করে মানবিক দিক থেকে এবং আন্তর্জাতিক একটি সুসম্পর্ক বজায় রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছি। গতকাল সোমবার রাত পর্যন্ত ১১৫ জন এবং আজ সকালে ১১৪ জন ও দুপুরে ৩৫ জনসহ মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ২৬৪ সদস্য আত্মসমর্পণ করেছেন। আমরা তাঁদের আশ্রয় দিয়েছি, খাবারের ব্যবস্থা করেছি। ১৫ জন আহত হয়েছেন, এর মধ্যে ৮ জন গুরুতর আহত। চারজনকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ও বাকি ৪ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এক রোহিঙ্গা ও এক বাংলাদেশি নারী নিহত হয়েছেন। এসব মৃত্যু কোনোভাবেই কাম্য নয়।

কতজন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে?
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রীয় জান্তা বাহিনীর সঙ্গে জাতিগত বিদ্রোহীদের চলমান সংঘর্ষে জীবন বাঁচাতে এখন পর্যন্ত ২৬৪ জন বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। তাদের মধ্যে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্য, সেনা সদস্য, পুলিশ সদস্য, ইমিগ্রেশন সদস্য ও বেসামরিক নাগরিক রয়েছেন।

পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়াদের মধ্যে বিজিপি সদস্য ১৮৩ জন, দুই সেনাসদস্য, চার সিআইডি, পাঁচ পুলিশ, স্পেশাল ব্রাঞ্চের ৯ জন, ইমিগ্রেশন সদস্য ২০ জন ও বেসামরিক নাগরিক ৪ জন। নতুন আশ্রয় নেওয়া ৩৫ জনের পরিচয় শনাক্ত প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

সীমান্তে কী দেখলেন সাংবাকিরা?
মিয়ানমার সীমান্তের যুদ্ধ পরিস্থিতির সংবাদ সংগ্রহ করতে বান্দরবান সীমান্ত এলাকায় রয়েছেন নিউজ টোয়েন্টিফোরের বিশেষ প্রতিনিধি নাহিদ হোসেন।  

তিনি বলছেন, মিয়ানমারের রাখাইনের বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের সাথে জান্তা বাহিনীর সংঘাতের  আঁচ এসে পড়েছে সীমান্ত লাগোয়া জনপদগুলোতেও। এতে আতঙ্ক বিরাজ করছে ওই এলাকাগুলোতে।  সীমান্ত এলাকায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে।  

কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্তের পরিস্থিতির বিষয়ে নিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রতিনিধি বলেন, সংঘাতে আজকের পরিস্থিতিও কিছুটা জটিল। সকালে আমরা ঘুমধুম সীমান্তে দেখেছি একটি স্কুলের পাশে এসে মর্টারশেল পড়েছে। রহমতের বিল এলাকায় তুমুল সংঘর্ষ হয়েছে। আরও কয়েকটি এলাকায় দফায় দফায় সীমান্তের ওপার থেকে শব্দ ভেসে আসতে শোনা গেছে। রহমতের বিল এলাকা দিয়ে ১১৪ জন মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে আসতে দেখা গিয়েছে। তারা বিজিবির কাছে আশ্রয় চেয়েছে। তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এই ১১৪ জনের মধ্যে বিজিপি সদস্যের পাশাপাশি কাস্টমস কর্মকর্তারাও আছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক রয়েছে।  

 আরও পড়ুন : রাখাইনে জান্তা সেনা ও বিদ্রোহীদের তুমুল লড়াই

সম্প্রতি মিয়ানমারের বিভিন্ন রাজ্যে বিদ্রোহীদের আক্রমণে ক্রমাগত চাপের মুখে রয়েছে দেশটির জান্তা সরকার। বিদ্রোহীদের কাছে উত্তর-পশ্চিমের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে মিন অং হ্লাইংয়ের জান্তা বাহিনী। পশ্চিম সীমান্তে আরাকান আর্মির হামলায় পিছু হটছে তারা। এরই মধ্যে একে একে সেখানকার সব সামরিক ঘাঁটি চলে যাচ্ছে আরাকান আর্মির দখলে।

বেসরকারি সংবাদ পরিষেবা সংস্থা রেডিও ফ্রি এশিয়া বলছে, রোববার বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি মিয়ানমার বর্ডার গার্ড ফোর্সের আরও  কয়েকটি ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায় আরাকান আর্মি। মিয়ানমারের পশ্চিম সীমান্তের এই ঘাঁটিতে পূর্ণ সামরিক শক্তি নিয়ে চালানো হয় এই হামলা।

 আরও পড়ুন : জান্তার আরও দুটি ঘাঁটি দখলে নিলো আরাকান আর্মি

মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮৩ কিলোমিটার। এর বড় অংশ পড়েছে বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায়। কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধ জোরাল করেছে আরাকান আর্মিসহ বিদ্রোহী কয়েকটি গোষ্ঠী। সংঘাত বাড়ার পর সবচেয়ে বেশি গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের উলুবনিয়া, তুলাতুলি, কাঞ্জরপাড়া, উখিয়ার পালংখালির আনজুমান পাড়া এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি তুমব্রু ও ঘুমধুম সীমান্তে। এতে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে আবার দেখা দিয়েছে উত্তেজনা, বেড়েছে অনুপ্রবেশের শঙ্কা।

এ সংঘাতের কারণে সীমান্ত এলাকায় সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বিজিবি। এর মধ্যে গত সোমবার মিয়ানমার থেকে ছোঁড়া একটি গোলার আঘাতে ঘুমধুম সীমান্তে একজন বাংলাদেশি ও একজন রোহিঙ্গা নিহত হন।

আরও পড়ুন : মিয়ানমারে ৬২ সৈন্যকে হত্যা

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সুচির সরকারকে উৎখাত করে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। নির্মমভাবে দমন করা হয় বিক্ষোভকারীদের। জবাবে হাতে অস্ত্র তুলে নেয় গণতন্ত্রকামীরা। বিভিন্ন জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কাছে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয় তারা।  

পাশাপাশি আরাকান আর্মি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স আর্মি ও ট্যাঙ্গ ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি নিয়ে গঠিত থ্রি ব্রাদারহুড এলায়েন্স সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। গত তিন বছরের গৃহযুদ্ধে ৩ শর বেশি সেনা চৌকি এবং ২০টি শহর দখল করে নিয়েছে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। ২০২২ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরেও মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের প্রভাব পড়েছিল বাংলাদেশ সীমান্তে। তখনও কিছু গোলা এসে পড়ার ঘটনাও ঘটে।

news24bd.tv/aa
 

এই রকম আরও টপিক