আমার দস্তইয়েভস্কি

অলংকরণ: কামরুল

কিস্তি-১০

আমার দস্তইয়েভস্কি

প্রায়ই নিজেকে মৃত মনে হয়। মনে হয়, একটা ইরেজার দিয়ে ঘষে যদি নিজের হেঁটে আসা ভুল রাস্তাগুলো মুছে ফেলা যেতো, ভালো হতো। তা তো হয়ই না, বরং উল্টোটা হয়। ভুল পথে হেঁটে আসা পথে ভুল ভুল মানুষগুলো দেখে নেয় আমাকে।

ফলে সঠিক রাস্তায় হাঁটার সময় তারা আমাকে বেলুনের মতো পিন করে। এমন ভাব করে যেন একেকজনের নিজেদের হাঁটার রাস্তাগুলো একেবারে বেহেশতি কানন। তাই কি হয় আসলে? আগে চুপসে যেতাম, এখন আমার আত্মবিশ্বাসের বেলুনগুলো বুলেটপ্রুফ লেদারের মতো হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

ভুল রাস্তা দিয়ে হাঁটতে সবসময় ভাল্লাগে না।

কারণ, মানুষের মুড চড়ুইয়ের মতো ফিকল। ইদানিং 'মুড সুয়িং' শব্দটি বেশ পপুলার হয়েছে। বাইপোলার ডিসঅর্ডার রোগীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয় পৃথিবীতে। মানুষের সাইকোলজি, বায়োলজি এবং কালার-হ্যাবিটেশন যখন একসঙ্গে অ্যাক্ট করে, তখন হয়তো মানুষকে সুস্থ ও সামাজিক বলা হয়। কিন্তু বাইরের প্রদর্শনীতে স্থির হলেও ভেতরে ভেতরে মানুষ দুর্দান্ত অস্থির। এই অস্থিরতার উৎস বিবিধ। ভেতরের অস্থিরতাকে সামাজিক ভাষার দাপটে আটকে রাখে মানুষ। এটা মন নষ্ট করতে থাকে, আর শরীরের ওপর চাপ তৈরি করতে থাকে। ফলে শরীরও একসময় বেয়াদবি শুরু করে দেয় নিজের সাথে। অ্যাক্সিডেন্ট ছাড়া মানুষের শরীরকে মন দারুণভাবে কন্ট্রোল করে। শরীর অতোটা পেরে ওঠে না মনের সাথে। 'মুড সুয়িং'-এর মাত্রা তখন ঘণ্টা ছাড়িয়ে সপ্তাহে জায়গা করে নেয়, সপ্তাহ থেকে মাস, মাস থেকে বছরে পা রাখে। মানুষকে তখন মানসিক ভারসাম্যহীন বলা হয়ে থাকে।

কিন্তু বর্তমানে কতো পার্সেন্ট মানুষের সাইকোলজি, বায়োলজি এবং হ্যাবিটেশনের রুলসগুলো এক সঙ্গে অ্যাক্ট করে? আপনাদের পরিসংখ্যানটা জানা থাকলে জানাইয়েন তো। আমার কম-জানা মাথায় সব তথ্য আঁটে না।

তথ্য না আঁটলে না আঁটুক।

ওর জন্য গুগল মামা কম যান না। চ্যাটজিটিপি তো আছেনই।

কিন্তু জ্ঞানের জন্য চাই নির্দিষ্ট গন্তব্য-পথ। কেননা গন্তব্য নিশ্চিত হলেই তো রাস্তা ভুল বা ঠিকের প্রশ্ন আসে। 'ভুল রাস্তা' বলছি মানুষের তৈরি করা নির্দিষ্ট গন্তব্যের কথা চিন্তা করে। ভাগ্যের সফলতা তো প্রত্যেকের আলাদা আলাদা হয়।

আমার হেঁটে চলা তথাকথিত ভুল রাস্তাগুলোতে যদি দোয়েল আর চড়ুইদের সাথে দেখা হতো, তাহলে সারাজীবন ভুল রাস্তা দিয়েই হাঁটতাম। কিন্তু এখানে মানুষগুলো যে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ হীনম্মন্যতাযোগে ডিমপচা গন্ধের মতো বমি-বমি পরিস্থিতি তৈরি করে রাখে। সেগুলো এক কথায় অনন্য। বলে রাখছি, ভুল রাস্তাকে আমি সবসময় ভুল বলতে রাজি নই। কেননা এগুলো অনেক সময় জগতের বাদবাকি রূপগুলো চেনাতে সাহায্য করে। সবসময় হজম করতে পারা জীবন যাপন করে গেলে বমি বা বীভৎস রস কী তা তো আমি জানতে পারবো না। অবশ্য অধিক জানার লোভ অনেকেরই থাকে না। গরুর মতো গোয়ালে বা প্লাস্টিকের মতো কারখানায় সারাজীবন কাটিয়ে যেতে পারে। রাবিশ!

আরও পড়ুন:দাঁড়িয়ে আছি মাধ্যাকর্ষণের টানে

প্রচুর কাজ বা দায়িত্বকে অতোটা চাপ মনে হয় না, কিন্তু উদ্ভট আর অসুস্থ মানুষের মানসিক পীড়াদায়ক কথাবার্তা বা সৃষ্টি-করা পরিস্থিতি খুবই মানসিক চাপ তৈরি করে। বারোমাস এসবের মধ্যে থাকতে হয়। আবার নিজে নিজেই এগুলো কাটিয়ে উঠি। চেষ্টা করি পরিবেষ্টিত উদ্ভট মানুষগুলোর মনে প্রশান্তি জোগাতে। কিন্তু তাই কি আর সবসময় হয়! কখনো কখনো হয়, কখনো কখনো হাল ছেড়ে দিই।  

আমার নিজেকে মাঝে মাঝে খুব দারুণ একটা মানুষ মনে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, ধুর, পৃথিবীতে আমাকেই কেন আসতে হলো? শত আঘাতে আমার বুলেটপ্রুফ আত্মবিশ্বাসকে সুরক্ষিত রাখার জন্য আমাকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। এই পরিশ্রম কখনো কখনো দুঃসাধ্য লাগে।

আমি প্রচুর কথা বলি। আমার দোষের মধ্যে এটা একটা বিরাট দোষ। চুপচাপ থাকবার চেষ্টা জীবনে কম করিনি। অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে ব্যর্থ হয়েছি। আমার বর একজন তুখোড় বক্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক । তা বাদেও তিনি বিভিন্ন জ্ঞানতাত্ত্বিক সমাবেশে কঠিন কঠিন 'ওয়াজ' করে বেড়ান। শব্দটি 'ওয়াজ' বলার কারণ সম্পর্কে অনেকেই হয়তো কৌতূহলী হবেন। বাংলাদেশে এখন পাবলিক পরিসরে 'ওয়াজ' একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। ভীষণ কমিউনিকেটিভও। অধিক মানুষের মনের কথা বলতে পারার ক্ষমতা অনেক বুদ্ধিজীবীরও থাকে না। হাজেরানা মজলিশ কী শুনতে চাইছে সেটার সঙ্গে নিজের জ্ঞানপ্রতিমার দিক-নির্দেশনা সংযোজনের এক চমৎকার ক্ষমতা আছে তাঁর মধ্যে। একেবারে অকাট্য বচন ছুঁড়ে মারেন দবরদস্ত ওয়াজশিল্পীদের মতো। ফলে এ ধরনের কালোত্তীর্ণ পারফরমেন্স নিয়ে তাঁকে প্রচুর ভাবতে হয়। অপ্রয়োজনীয় কথা বলায় তিনি একেবারেই আনাড়ি। টার্কিশ একটা সিরিয়াল দেখেছিলাম কিছুদিন আগে। নাম, 'ইনাডিনা আশক'। আমার খুব প্রিয় টার্কিশ নায়ক জান ইয়ামান অভিনয় করেছেন এটাতে। এই সিরিয়ালে 'ডেফনে' চরিত্র হচ্ছে নায়িকা। আর জান ইয়ামান 'ইয়ালিন' নাম নিয়ে নায়কের চরিত্রে ছিলেন। আমার কথা বলার ধরন একেবারে 'ডেফনে'র মতো। দম বন্ধ করে কথা বলতে থাকি। আর অধিকাংশ কথাই হয় অপ্রয়োজনীয়। আর আমার বরের কথা এই সিরিয়ালের নায়ক জান ইয়ামানের মতো মাপা মাপা।

আমি আসলে এই সিরিয়াল শুরু করেছিলাম একটা বিরাট ঘোর কাটানোর জন্য। ঠিক ঘোর না বলে বলবো চেতন-জগতের বিরাট ধাক্কা সামলানোর জন্য।

আমার চেতন জগতে প্রবলভাবে ধাক্কা মেরেছিলেন ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তইয়েভস্কি। লেখক মশিউল আলম সরাসরি রুশ ভাষা থেকে 'নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড' ইংরেজি-নামের বইটির বাংলা অনুবাদ করে 'তলকুঠুরির কড়চা' নাম দিয়েছেন। বইখানা পড়ে আমি এটা ভেবেছিলাম যে, মশিউল ভাই এটা অনুবাদ করে মানুষের সমাজে স্বাভাবিকভাবে বিচরণ করে বেড়াতে পারছেন কী করে! আমি পড়ে তো স্বাভাবিক থাকতে পারিনি বহুদিন।

ঘোর বা ধাক্কা কাটানোর জন্যই আমি নিয়মিত টার্কিশ সিরিয়াল দেখতাম। এটা আমার ক্ষেত্রে অনেকটা টাকিলার সঙ্গে লেবু আর লবণের কাজ করতো। একে একে জান ইয়ামানের সবগুলো হিন্দি ডাবিঙের সিরিয়াল দেখে ফেললাম। কিন্তু না, ঘটনা তথৈবচ। এখন কী মনে হয় জানেন? মনে হয় আহা, দস্তইয়েফস্কির মতো ক্ষুরধার মেধা যদি জান ইয়ামানের থাকতো, বা জান ইয়ামানের মতো বাহ্যিক স্মার্টনেস আর সাকসেস যদি দস্তয়েফস্কির থাকতো! তাহলে আমার কী হতো?  কিছুই হতো না। এমনেই বললাম।

আরও পড়ুন: মা

আমরা যে সুন্দর সুন্দর স্মার্ট স্মার্ট নায়ক/নায়িকা স্ক্রিনে দেখে থাকি, তাদের অধিকাংশের অভিনয়ই নির্ভর করে ভালো স্ক্রিপ্ট-রাইটার আর পরিচালকের মেধার ওপর। আবার ভালো স্ক্রিপ্টের বিকাশ হয় স্মার্ট নায়ক/নায়িকার  অভিনয়-গুণের উপর। সম্প্রতি সৃজিত মুখার্জির 'দশম অবতার' সিনেমায় জয়া আহসানের অভিনয় দেখেও আমার এই কথা মনে হয়েছে। মনে হল, সৃজিত জয়ার সঙ্গে অতোটা যায়নি, যতোটা যায় সোহিনী বা বাঁধনদের সঙ্গে।

সুতরাং আমি যদি বিশ্বকর্মা হতাম তাহলে তিলোত্তমার মতো তিলোত্তমও বানিয়ে দেখতাম। কিন্তু হায়, খোদা আমাকে সে কর্ম-ভাগ্য দিয়ে পাঠাননি।

সত্যি বলতে কী, প্রচুর পরিমাণে জান ইয়ামানের সিরিজ দেখা সত্ত্বেও আমি এখনও  দস্তয়েফস্কির ঘোর কাটাতে পারিনি। অন্তরাত্মা দিয়ে ফজর এবং তাহাজ্জুদ পড়েও দেখেছি, কিছুদিন কুরআনের তাফসির, জালালুদ্দিন রুমি ও শামস তাবরেজিকেও পড়লাম।   নাহ কিছুতেই হালকা হতে পারলাম না।

আর মশিউল ভাইয়ের অনুবাদের জোর কিনা জানি না, এ বইয়ের আদ্যপান্তে যেন আমি আমাকেই দেখলাম। মাল্টি 'কালারড মোটিফ' বলে একটা ব্যাপার আছে না টেক্সটাইলের মধ্যে? ওইরকম একটা ব্যাপার আমি বইটার মধ্যে পেলাম। যেকোনো দৃষ্টিকোণ থেকে পড়া যায় বইটা। ফলে আমি অনেকদিন ধরে, অনেক সময় নিয়ে 'তলকুঠুরির কড়চা' পড়লাম। বইটা গতবছর বইমেলা থেকে কিনেছিলাম। গতবছরই বের হয়েছিলো। এ বছর বইটি একটা পুরস্কারও জিতেছে দেখলাম। পুরস্কার পেলে বা না পেলে এই বইয়ের কিচ্ছু যায় আসে না অবশ্য। নিজেকে আবিষ্কার করতে পারার জন্য এই বই জরুরি।

আমি নিজের ঘোরগ্রস্ততা কাটাতে টার্কিশ সিরিয়াল দেখেছি সত্য, কিন্তু সিরিয়ালগুলো দেখে আরও ভার হয়ে উঠলো মন। দেখলাম খুব সিম্পল ডায়লগ আর প্রেক্ষাপটকে ফুটিয়ে তোলা কতো বছরের সাধনাবহুল সংস্কৃতির কাজ! যেহেতু হিন্দি ডাবিং, ভেবেছিলাম কিঞ্চিৎ হালকা পাতলার উপরেই যাবে। না, সিরিয়ালে দেখি নায়ক/ নায়িকারা কাফকা পড়ছে! আর কে না জানে কাফকার সঙ্গে দস্তইয়েফস্কির সম্পর্ক কত গভীর!

নাহ, কিছুতেই দেখি কিছু হয় না। এরপর আমি দস্তইয়েভস্কি সম্পর্কে বই খুঁজতে শুরু করলাম। পাঠক সমাবেশে পেয়ে গেলাম দস্তইয়েফস্কির ওপর অমলকুমার মণ্ডল সম্পাদিত কলকাতার একটা পত্রিকা 'কবিতীর্থ'।  

ব্যস, আর যাবে কোথায়। দস্তইয়েফস্কি আমাকে আরো পেয়ে বসলো।

এটা ঠিক, যেকোনো টেক্সটকে টেক্সট হিসেবেই পড়তে হয়। কিন্তু এতোটা নিরাসক্তি হয়তো মানুষের মধ্যে দিয়ে পাঠাননি খোদা। মানুষ তার জীবদ্দশায় প্রায় সবজায়গাতেই নিজেকে খোঁজে অথবা দেখতে পায়। না হলে দেখেন না, এক সময়কার রাজা/ রানি বা বাদশারা পৃথিবী শাসন করতেন নিজের নাম দিয়েই। যিনি জর্জ তাঁর ছেলেও জর্জ। যিনি ফিলিপ তাঁর ছেলেও ফিলিপ। শুধু কি ছেলে?  নাতি, পুতি, প্রপৌত্রও ফিলিপ।

আবার এখনও দেখবেন, অধিকাংশ মা-বাবাই তাদের সন্তানের নাম রাখেন নিজেদের নামের সঙ্গে মিল রেখেই। যেমন, কারো নাম জাহিদ, আর ছেলের নাম রাখলেন জাভেদ। আমি নিজেও তাই করেছি। আমার ছেলের নাম ক্ষিতি খৈয়াম রেখেছি। আমি অবশ্য অন্ত্যমিল করেছি। সেঁজুতি থেকে ক্ষিতি আর আজম থেকে খৈয়াম। আমাদের দুইজনই আছে ওর মধ্যে। মানে আমাদের বীজের মধ্যে আমরা আমাদেরকে শুধু বায়োলজিক্যালি দেখবো না, হিস্ট্রিক্যালি দেখার জন্যই আমরা এই ব্যবস্থা করেছি। আচ্ছা এখানে অবশ্য 'আমরা' বলা উচিত হবে না। নামটা আমার বাছাই করা, অ্যাপ্রুভ করেছেন আমার বর।  

এই যে মানুষ সবকিছুর মধ্যে কেবল নিজেকে খোঁজে, এটা কিন্তু অনেকে স্বীকার করবেন না। কিন্তু নিজের অজান্তেই এইসব খোঁজাখুঁজি জারি থাকে।  'তলকুঠুরির কড়চা' পড়ে আমি আমার নিজেকে দেখতে পাই। পরিচয় হয় নিজের অন্ধকার কুঠুরিগুলোর বদ্ধ চাবিদের সঙ্গে। দ্রুত সেই সব চাবি দিয়ে খুলে ফেলে আমি কথা বলি নিজের সঙ্গে।

নিজের সঙ্গে কথা বলতে পারলে আমি নিশ্চিত আপনি নিজেকে আর চিনবেন না। বা চিনতেও পারেন। আমি চিনেছি। আমার ক্ষোভ, রাগ, দুঃখ, হতাশা, বিদ্বেষগুলোকে আমি সমাজের সরবরাহকৃত নিয়মের কুঠুরিগুলোতে বদ্ধ করে রাখি। কিন্তু প্রায়ই সেগুলো আমার মমতা, প্রেমবোধকে মাড়িয়ে এগিয়ে আসে। আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না। আবার যখন পারি তখন শরীর খারাপ হয়ে যায়।  

আপনারা পারেন?

মস্তিষ্ক খাটাতে খাটাতে হৃদয়ের কথা না শুনতে শুনতে মানুষের হৃৎপিণ্ড অভিমান করে শরীরের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান অভিনেতা আহমেদ রুবেলের মৃত্যুকে আমরা অনাকাঙ্ক্ষিত মনে করছি। অথচ, কেউ জানি না বা জানতে চাইও না যে ভদ্রলোকের ব্রেইন, হৃৎপিণ্ড আর প্রতিবেশের পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন ছিলো। মানুষের মৃত্যু মানে কী? 

বায়োলজিক্যাল ডেথ, ক্লিনিক্যালি ডেথ আর জ্যান্তে মরার মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক নাই?

মানুষ মৃত্যুর নানা কারণ ব্যাখ্যা করে মাথাকে প্রচুর পরিমাণ খাটিয়ে। তারও ছক আর অংক আছে। কিন্তু যেকোনো প্রাকৃতিক ক্রিয়ারই যে একটি সাধারণ উদ্দেশ্য থাকে, তার সঙ্গে যুক্তি ও আবেগের তীব্র সম্পর্কও থাকে, সেটা সবসময় মাথার উপর দিয়ে চড়ুই পাখির মতো উড়ে যায়।

আবার অতিরিক্ত ব্রেইন খাটাতে খাটাতে সেটা বিগড়েও যায় অনেক সময়। আমার বর একজন তুখোড় বুদ্ধিওয়ালা মানুষ। তিনি মাথার কথা এতো বেশি শোনেন যে মাঝে মাঝে আমার মনে  সন্দেহ জাগে তাঁর হৃৎপিণ্ডের দশা ভেবে। বাৎসরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মোটামুটি ভালো আছে বলেই জানায় সে। কিন্তু কাজের স্ট্রেইস বয়স আর সময়ের গতিকে ছাড়িয়ে গেলে হৃৎপিণ্ড আর এভাবে কথা শুনবে কিনা সন্দেহ!

আমার আবার মাথার চেয়ে হৃৎপিণ্ডই বেশি চলে সবজায়গায়। এর জন্য ধরাও খাই বিস্তর। কারণ সমাজের কানুনগুলো তো সব যুগের মহারথীদের মস্তিষ্ক থেকেই উদ্ভূত। অনেকদিন আগে একবার এক সাংবাদিক জনাব ফারুক ওয়াসিফ আমার একটা লেখা পড়ে মন্তব্য করেছিলেন, আমার লেখায় হৃদয় আর আমার বরের লেখায় মস্তিষ্ক স্পষ্ট ফুটে থাকে। এই মন্তব্যের সঙ্গে আমি শতভাগ একমত। আমরা দু'জন একদম বিপরীত মেরুর মানুষ। তারপরেও ১৬ বছর চলে আমাদের যৌথতার। এটা আমার পরিসরে স্বাভাবিক হলেও আমার বরের পরিসরে একদম অস্বাভাবিক। এরকম একজন জবরদস্ত বুদ্ধিওয়ালা 'ওয়াজশিল্পী'র সঙ্গে জীবন কাটানো এতো সহজ নয়। তাঁর জবান, তাঁর চিন্তাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো গ্রহণ করা এক জিনিস;  বা যদি বলি সভা-সেমিনার বা ক্লাসরুমের চৌকিতে দাঁড়িয়ে টেবিলে হাত চাপড়িয়ে কিংবা ল্যাপটপের সামনে বসে রাত-দিন হাত নাড়িয়ে নানারকম চিন্তাকে শব্দে রূপান্তর করা এক জিনিস – আর তেল, লবণ, হাড়ি, শ্বশুরালয়সমৃদ্ধ বিবাহিত জীবন একেবারেই ভিন্ন বিষয়।

আমাদের যখন বিয়ে হয় তখন অনেকেই অবাক হন। মোহাম্মদ আজম আমার সরাসরি ক্লাস-শিক্ষক। তিনি থার্ড ইয়ারে ইতিহাসের কোর্স পড়াতেন। এর আগে দ্বিতীয় বর্ষে ইতিহাসের ক্লাস নিতেন জনাব ফয়জুন্নেসা ম্যাডাম। সেই ক্লাসের সঙ্গে মোহাম্মদ আজমের ক্লাসের ছিলো আসমান-জমিন ফারাক। পড়াতেন চল্লিশ থেকে সত্তরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস।

ছেলেমেয়েরা ইতিহাসের মতো একটা কটমটি বিষয়ে এতো আগ্রহ কোত্থেকে পেলো কে জানে! 

'আজম স্যার' ক্লাসে একেকটা বইয়ের নাম বলতেন আর ছেলেমেয়েরা হুমড়ি খেয়ে লাইব্রেরিতে গিয়ে সেইসব বই পড়তে লেগে যেতো। কার আগে কে সেইসব বই শেষ করতে পারে, চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা।

ছফা, মার্কেজ, শহীদুল জহির, ইলিয়াস, দুই হক, দুই হুমায়ূন এমনকি মাসুদ রানাও ছাড় পেতেন না তাঁর ক্লাসে। 'যদ্যপি আমার গুরু'কে মোহাম্মদ আজম আমাদের মধ্যে হটকেক বানিয়ে ছাড়লেন। জিএইচ হাবীব, আনু মুহাম্মদ, হুমায়ুন আজাদ অনূদিত বইগুলো আমরা ওইসময় গোগ্রাসে খেতাম। ছফা অনূদিত 'ফাউস্ট', আজাদ অনূদিত 'দ্বিতীয় লিঙ্গ', আনু মুহাম্মদ অনূদিত 'হাত বাড়িয়ে দাও', জিএইচ হাবীব অনূদিত 'নিঃসঙ্গতার একশো বছর' আমরা মোহাম্মদ আজমের অনুপ্রেরণায় তৃতীয় বর্ষে পড়ি। বাংলা বিভাগের ছেলেমেয়েরা জ্ঞানের লোভে লাইব্রেরিমুখী হয় মোহাম্মদ আজমের আছরগ্রস্ত হয়ে।

সমাজবিজ্ঞানের তখনকার বিখ্যাত ছাত্র 'কার্ল মুজিব' একবার মন্তব্য করেছিলো: 'আজম স্যার দেখি বাংলা বিভাগের ছেলেমেয়েদেরকে একেবারে লাইব্রেরিমুখী করে ছাড়লেন!' কেউ কেউ তখন আজম স্যারের সঙ্গকে পুঁজি করতেও লেগে যায়! এদের মধ্যে দর্শন বিভাগের ছাত্র কবি মাহমুদ হাছানের কথা মনে পড়ে। এই ছেলে অতি অল্প বয়সে বিরাট পাকা পেকে গিয়েছিলো। মোহাম্মদ আজমের সঙ্গে তার সম্পর্ককে সে মেয়ে পটানোর কাজে নাকি ব্যবহার করতো। বোঝেন অবস্থা! এমনও শুনেছিলাম যে, সে নাকি মোহাম্মদ আজমের কোনোরূপ এক ভাই!

বাঙালি অবশ্য বরাবরই ভূত ও মিথ-প্রেমী।

আমার সঙ্গে মোহাম্মদ আজমের বৈবাহিক সম্পর্ক থাকবার সুবাদে অনেকেই এসে জিজ্ঞেস করতো হাছান কি আসলেই মোহাম্মদ আজমের দূর-সম্পর্কের ভাই কিনা!

আহা মাহমুদ হাছান! ছেলেটা ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গিয়েছিল – সম্ভবত আত্মহত্যা।

আমার সতীর্থ শরীফ, টপি, সাজিয়া, কুসুম, তাহমিনা, রুনা, রাসেল, মোস্তফা হামেদীসহ অনেক ছেলেমেয়েই নিয়মিত লাইব্রেরিতে যেতাম মোহাম্মদ আজমের ক্লাস লেকচারে উল্লিখিত বইয়ের হদিস নিতে। লাইব্রেরিতে তখন কেউ কেউ বিসিএস প্রস্তুতি নিতে যেত। তবে সংখ্যায় এখনকার মতো নয়। আমরা যারা নিয়মিত লাইব্রেরিতে যেতাম, তাদের অধিকাংশই স্রেফ জ্ঞান-সাধনার জন্য লাইব্রেরিতে যেতাম। চাকরির চিন্তা তখনও মাথায় ওভাবে ঢোকেনি। তবে ভালো ফলাফলের লোভ আমাদের মধ্যে ছিলো।  

সাহিত্য বোঝা এবং করার একটা অদম্য চেষ্টা আমার ছিলো। তখন জানতাম না যে মোহাম্মদ আজম আমার পড়ালেখার অতীত ইতিহাস সম্পর্কে রীতিমতো হোমওয়ার্ক করেছিলেন। দ্বিতীয় বর্ষে আমার রেজাল্ট প্রথম দিকেই ছিলো। এসব গোপন তথ্য আমার কাছে বিয়ের অনেক পরে একজন ফাঁস করে দিয়েছিলেন। আমাদের বিয়েটা একটা মিরাকল। এটা অবশ্য পৃথিবীর প্রত্যেক দম্পতি কমপক্ষে একশোবার করে ভাবে। আমিও ভাবি।

ছাত্র-শিক্ষক বিয়ে জগতে আনকমন কোনো বিষয় না হলেও আমরা আজীবনই আনকমন রয়ে গেলাম।  

ক্লাসরুমে তাঁর লেকচার মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম, সবাই। ক্লাসের সব থেকে সুন্দর (তথাকথিত) মেয়ে থেকে একেবারে চোখ পাতা যায় না টাইপের (ক্লাসের বিভিন্ন সতীর্থের ভাষ্য মতে) মেয়ে পর্যন্ত মোহাম্মদ আজমের ভক্ত। জুনিয়র সিনিয়র, ছেলে-মেয়ে, নিজের বিভাগ পরের বিভাগ – এরকম অনেককেই তিনি মোহাবিষ্ট করে ফেলেছিলেন।

আমিও আবিষ্ট ছিলাম। শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রছাত্রীদের মোহ থাকবারই কথা, ফলে আমার মোহরূপ যথেষ্ট স্বাভাবিক। কিন্তু উনি যে ছাত্রীকে বিয়ে করলেন, এটা তখন ভীষণ আলোচিত ঘটনা হয়ে পড়লো। বিশেষ করে 'আজম স্যার বিয়ে করেছেন?'- এর মতো বিস্ময়ের হাওয়া আমাদের চারপাশকে মোটামুটি কব্জা করতে সমর্থ হয়েছিলো। আমাদের মধ্যে যা ঘটেছিলো তা যে দৈবক্রম, সেটা আগেও বলেছি। তিনি তাঁর পরিবারের লোকজনকে নাকি বলেছিলেন 'তিনি তাঁর একটা ছাত্রীকে পটাবার চেষ্টা করছেন। ' পরিবারে মা এবং বড়োভাই মুরুব্বি থাকলেও তাঁর ব্যক্তিত্বের কারণে তাঁকেই সবাই মুরুব্বি মানতেন।

ফলে আমাদের বিয়েটা হয়ে গেল।

'ইনডিসেন্ট প্রোপোজাল' নামে ডেমি মুরের একটা মুভি দেখেছিলাম করোনার সময়। তখন রুটিন করে আমরা বর-বৌ মিলে মুভি দেখতাম৷ গত কিছুদিন আগে জেনেছি দস্তয়েফস্কি নাকি প্রচুর জুয়া খেলতেন। জুয়ার নেশায় তিনি কখন যে তাঁর 'সুন্দরী' স্ত্রীকে বাজি রেখে ফেলেন টেরই পাননি। আমার দেখা ওই মুভির মতো দস্তয়েফস্কিও নিজের স্ত্রীকে বাজি রেখে জুয়া খেলতেন।

আমি ভেবেই পাই না দস্তয়েফস্কি কতো বিচিত্ররূপে আমাদের মনস্তত্ত্বকে নিয়ে খেলে গেছেন! 

আজ ৯ ফেব্রুয়ারি। দস্তয়েফস্কির মৃত্যুদিবস। এই ভদ্রলোক শুধু কাফকা নন, তারাকোভস্কিকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিলেন।

এই ভদ্রলোক এবং আমার বর আমার চেতন মনে প্রবলভাবে ধাক্কা মেরেছেন।

এই দুই ব্যক্তিকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করবো না।

( চলবে)

লেখক পরিচিতি : কবি, লেখক ও শিক্ষক। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।   বর্তমানে সরকারি বিজ্ঞান কলেজে কর্মরত।

news24bd.tv/ডিডি

 

এই রকম আরও টপিক