নামের সংস্কৃতি

কাকন রেজা--ফাইল ছবি।

নামের সংস্কৃতি

কাকন রেজা

কানকাটা রমজান, গালকাটা শামছু, গলাকাটা কাশেম এসব নামের নয় মাহাত্ম্য রয়েছে। কারো কোনো অকাজে কান কাটা গেছে, নাম হয়েছে কানকাটা রমজান। কেউ কারো গলাকেটে নাম পেয়েছে গলাকাটা কাশেম। হতে পারে তা গলাকাটা পাসপোর্টের জন্যও।

প্রত্যেকের এমন নামের পেছনে একটা না একটা অপকর্মের ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু  আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের নামের মাহাত্ম্য কী? পিতৃ-মাতৃ প্রদত্ত নামকে তারা কেন অপছন্দ করেন? নিজের নাম নিজেই রাখেন। বিপ্লবী বাঙ্গাল, তিহার চিকন, জর্জর কৈবর্ত্য, বিকৃত ফরমান, জঙ্গলে আরমান এমন ধরণের সব অদ্ভুত নাম।  
যারা বিখ্যাত হয়েছে আমাদের দেশে, তারা কজন নামের এমন কারিশমা দেখিয়েছেন বলেন তো।
জানা মতে, সৈয়দ শামছুল হক, হুমায়ূন আহমেদ, আল মাহমুদ তারা কেউই অদ্ভুত নাম ধারণ করেননি কখনো। জীবিতদের মধ্যে মঈনুল আহসান সাবের, জাকির তালুকদার, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, কামাল চৌধুরীদের কারোরই এমন নামের ইতিহাস নেই। কেউ হয়তো নামকে সংক্ষিপ্ত করেছেন, কিন্তু বিস্ময়কর নাম ধারণের কাণ্ড ঘটাননি। নতুন করে আকিকা করার প্রয়োজন হয়নি তাদের।  
সেদিন এক কবির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন একজন। নাম শুনে চমকে গেলাম। বলতে পারেন ভিরমি খাবার জোগার। সঙ্গতই নামটা বলছি না। কারণ এবারও তার কবিতার বই বেরুচ্ছে। সাহস করে তার প্রকৃত নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম। বেচারা আমার উপর ভীষণ মাইন্ড খেয়েছিলেন। কলেজ জীবনে যখন লিখি, তখন এমন নাম পরিবর্তনের ঘটনার সাক্ষী আমি এবং বন্ধু রোমান জাহান। তখন আমাদের জেলা শহরে আমরা একটা জায়গায় আড্ডা দিই। সেখানে কবিকুল আসেন, সাহিত্য নিয়ে আলাপ হয়। একদিন আমাদের এক বেশ সিনিয়র কবি এলেন। বললেন, তার নামটা বড্ড কমন, পরিবর্তন করা দরকার। আমরা ঠাট্টাছলে বললাম, করে ফেলেন এবং সাথে একটা আকিকা দেন। তিনি বিষয়টিকে সিরিয়াস ভাবেই নিলেন। নামের একটা অংশ রেখে, আরেকটা অংশে বিভিন্ন অদ্ভুত শব্দ ব্যবহার করে ট্রায়াল শুরু করলেন। আর সেই ট্রায়ালের অংশ হিসেবে আমরা মতামত দিতে লাগলাম। একসময় একটা শব্দ লেগে গেলো। বদলে গেলো কবির পিতৃ-মাতৃ প্রদত্ত নাম। কিন্তু আফসোসের বিষয় আমাদের আকিকাটা খাওয়া আর হয়নি। কারণ, নাম বদলের সাথে সাথে কবি রবি ঠাকুরের ভাব নিলেন, অবতারও বলতে পারেন। রবি ঠাকুরের সেই অবতারের কাছে আমাদের আকিকার খাওয়াটা মার গেল।  
জানি না, আমাদের হালের কবিকুল কেন এমনসব অদ্ভুত নামের প্রতি সমর্পিত। বিখ্যাতদের কেউ কেউ ছদ্ম নামে লিখতেন, যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখতেন নীল লোহিত নামে। কিন্তু তিনি সে নামকে টিকিয়ে রাখতে চাননি। নিজ নামে প্রকাশিত ও বিকশিত হয়েছেন। এমন হয় লেখার শুরুতে। কারো কারো লজ্জা থাকে সাহিত্য করা নিয়ে। এর কারণও রয়েছে। কবিদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে এর আগের একটা লেখায় আমি বলেছিলাম, মানুষ মূলত কবিদের নির্বোধ ভাবে। অবশ্য ভাবনাটা মিথ্যে নয়, ‘কবি’দের বেশিরভাগই হয় নির্বোধ ধরণের। কমাবদ্ধ করলাম এ কারণে যে, এরা মূলত কবি সাজেন, কবি হন না। এদের বেশিরভাগেরই আসল লোভটা প্রচারের। অন্যকোনো প্রতিভা না থাকায়, কাগজ বা মনিটরের উপর অত্যাচার শুরু করেন। তারপর এথা-হোথা থেকে চোথা তৈরি করে তাকে কবিতা নাম দেন। কেউ কেউ রবি ঠাকুরের অবতার সাজেন। এজন্যই মানুষ ভাবে এরা কোনো কাজের না। হালের ‘তারছিড়া’ আর কী। এ কারণে কিংবা এদের কারণে কেউ কেউ কবিতা লিখতে শুরু করলে নিজের নামটা লুকোতে চান। তাই কিম্ভুত কিংবা ছদ্ম নামে লিখেন। কিন্তু লেখা যদি লেগে যায়, স্পার্ক করে, তাহলে ছদ্মনাম থেকে স্বনামে আবির্ভূত হন তারা। এটাই ধারা, ধরণ। হাল সময়ে এ ধারার ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। ইমতিয়াজ মাহমুদ, সাদাত হোসাইন তারা অদ্ভুত নামের অবতার না হয়েই সফল হয়েছেন। সফল হওয়ার জন্য নাম নয় লেখাটা হওয়া দরকার। সাফল্য পেরিয়ে সার্থক হতে গেলে নাম নয় দরকার লেখা এবং সেটা যেন মানুষের পড়ার যোগ্য হয়। বলে নিই, ভালো লেখা মানেই যে সব পাঠকের পড়ার যোগ্য, তা কিন্তু নয়।  
এখানে অবশ্য জনপ্রিয় ধারণাটা এসে যায়। বইমেলা শুরু হয়েছে। এখন এসব আলাপ খুব উঠবে। যেমন ফেব্রুয়ারি এলেই কেউ কেউ বাংলা ভাষা চালুর করার কথা বলেন বক্তব্য, বিবৃতিতে আর ক্যামেরার সামনে এবং নিজের অফিস-দপ্তরে চালান ভুল-ভাল ইংরেজি। সাথে ভুল-ভাল ইংরেজি বলতে না-পারাদের মানুষ হিসেবেই গণ্য করেন না। জনপ্রিয় হওয়ার কিছু তরিকা আছে। হুমায়ূন আহমেদ নিজে লেখার গুণে জনপ্রিয় হয়েছেন। সাধারণ মানুষ যেমন তার লেখা পড়ে আনন্দ পেয়েছে, বোদ্ধারাও ফেলে দিতে পারেননি। তার জনপ্রিয়তার তরিকা হলো হিউমারের ব্যবহার। মানুষ তার অজান্তেই অনেক কাণ্ড করে, সেটা যে কতটা হিউমারাস হতে পারে, তার বর্ণনা পড়তে গিয়ে কিংবা পর্দায় দেখতে গিয়ে বোঝা যায়। হিউমার ব্যবহারের যে শিল্পবোধ এরমধ্যেই রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তার মূল রহস্য। হালের কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ যে তরিকায় জনপ্রিয় হয়েছেন, তা হলো কাপলেট- এর মাধ্যমে। যুগল লাইনের বা দুই লাইনের কবিতার মধ্যে একটা দর্শন ভরে দেয়া কিংবা এমন শব্দ দিয়ে বাক্য সাজানো যা মানুষের মনকে সহসাই ছুঁয়ে যায়। মানুষ দুই লাইন সহজে মনে রাখতে পারে। এই মনে রাখা ও সহজে ছুঁয়ে যাওয়াই ইমতিয়াজ মাহমুদের সাফল্যের কারণ। এরকম নানা তরিকায় জনপ্রিয় হন লেখকরা। কাশেম বিন আবু বাকার আবার আরেকভাবে জনপ্রিয়। তার তরিকা হলো টার্গেট সেট করা। একটা শ্রেণিকে তিনি টার্গেট করে নিয়েছেন। যারা অতশত পড়তে চান না, বুঝতে চান না। সাহিত্য নিয়ে গবেষণা তাদের দরকার নেই। তারা সারাদিন কাজ করে রাতে একটু বই খুলে বালিশ ভেজাতে চান কিংবা মিলনের আনন্দে ঘুমাতে যেতে চান, এর বেশি কিছু তাদের চাওয়া নেই। তাই তারা কাশেম বিন আবু বাকারদের বেছে নেন। পাঠকের দুটি ধারার মধ্যে একটি বেশ বড় দেয়াল রয়ে গেছে। সম্ভবত এই দেয়ালটাকে সফলভাবে ভাঙতে পেরেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। যার ফলে কাশেম বিন আবু বাকারের বলয়ের লোকজনও হুমায়ূন আহমেদের অন্তত দু’একটা বই পড়ে দেখেছেন। এই দেয়াল ভাঙতে পারাটা একটা অগ্রগতি। এবং তা অবশ্যই অগ্রসর পাঠক তৈরির ক্ষেত্রে।  
যাকগে, শুরু করেছিলাম কবি-সাহিত্যিকদের নামের মাহাত্ম্য নিয়ে, আর শেষে বড় আলাপ ফেঁদে বসলাম। বাদ দিই, তারচেয়ে চলুন নাম পাল্টানোর একটা প্রজেক্ট খোলা যাক। যেখানে উঠতি কবি-সাহিত্যিকদের নাম পাল্টানোর ব্যবস্থা থাকবে এবং তা যথাযথ সম্মানীর মাধ্যমেই। এককথায় আকিকা দেয়ার মত আর কী।
 লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট 

news24bd.tv/ডিডি

সম্পর্কিত খবর