বাংলাদেশের বন্ধু এ্যালেন গিন্সবার্গ

এ্যালেন গিন্সবার্গ ও কৌশিক আহমেদ--ছবি লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত।

স্মৃতিচারণ

বাংলাদেশের বন্ধু এ্যালেন গিন্সবার্গ

কৌশিক আহমেদ

ইউরোপ দেখার দুই বছর পর নিউইয়র্কে আসছি। আমার স্বপ্ন যেন সোনালি ডানার চিল। আহা নিউইয়র্ক। ওহ ক্যালকাটা নেই ব্রডওয়েতে, কিন্তু আছে লা মিজারেবল আর মিস সাইগন।

অবশ্য নাটক বা মিউজিক্যালের কথা আমি তখন ভাবিনি। এসব নিয়ে ভাবনা এসেছে নিউইয়র্কের কংক্রিটে কিছুদিন থাকার পর। আমার ভাবনা তখন ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’র শহর নিউইয়র্ক, জোয়ান বায়েজের শহর নিউইয়র্ক, একজন প্রফুল্ল মুখার্জির শহর নিউইয়র্ক নিয়ে। প্রফুল্ল মুখার্জি উনিশশ একাত্তরে দিনের পর দিন টাইমস স্কয়ারে একটি প্লাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থেকেছেন।
একা একা। প্লাকার্ডে লেখা  ‘Free Bangladesh’। নিউ ইয়র্কে এসে আশা করে আছি ‘বহে না সুবাতাস’, সিতাংশু তোর সমস্ত কথা’ ও ‘দুর্বিনীত কালের’ লেখক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত আর ‘খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ’ কাব্যের কবি ফরহাদ মজহারের  সাথে দেখা হবে বলে। কবি এ্যালেন গিন্সবার্গের জন্যও যিনি সশরীরে শরণার্থী ক্যাম্প ঘুরে এসে ১৯৭১ এ ‘সেপ্টেম্বর অন যেশোর রোডের মতো অসাধারণ চোখ ভেজানো কবিতা লিখেছিলেন। আহা! যদি দেখা পেতাম।  
আমি জানি না তাদের কারো সাথে দেখা হবে কিনা। নাইবা হলো। তাদের পদস্পর্শ পেয়েছে যে কংক্রিট, তার ওপর দিয়েই না হয় আমি হাঁটবো। তাতেই অনেক সুখ। মানুষ কত কত সুখ চায়, আমি ছোট ছোট সুখ নিয়েই খুশি। নিউইয়র্কে এসে জানতে পারলাম জ্যোতিদা’রা বাংলাদেশে ফিরে গেছেন। জোয়ান বায়েজ কোথায় কে জানে। প্রফুল্ল মুখার্জি পরলোকে। তাঁর স্ত্রী রোজ মুখার্জি বেঁচে আছেন এবং এ্যালেন গিন্সবার্গ। তখন ১৯৮৮। ৮৯ তে একদিন নিউইয়র্কার ম্যাগাজিনে দেখলাম প্রখ্যাত সোভিয়েট কবি ইভজেনি ইভতুশেংকোর কবিতা পাঠের আসর হবে ভিলেজ ক্যাফেতে। রবিবার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান। দুপুরে বেলভ্যু হাসপাতালে বিখ্যাত আবৃত্তিকার কাজী আরিফকে দেখে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম ভিলেজ ক্যাফেতে। আরিফ ভাই তখন হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে। অনুষ্ঠান শুরু হতে ঘণ্টা দুয়েক বাকি। দশ ডলারের টিকিট কিনে একেবারে মঞ্চের সামনে গিয়ে বসলাম। ভিলেজ ক্যাফের সেমি-বেসমেন্টে যাত্রার মতো উন্মুক্ত প্রসেনিয়াম মঞ্চ। সেখানেই দীর্ঘ দেহের ইভতুশেংকো শুরুতেই লম্বা একটা কবিতা আবৃত্তি করলেন। মুখস্থ। রুশ ভাষায়। তার আবৃত্তির মাধুর্যে ভাষার দূরত্ব যেন ঘুচে যাচ্ছিল।  
কবিতা শেষে ইভতুশেংকো যখন জলপান করছেন মঞ্চের কোণে দাঁড়িয়ে, তখন মঞ্চে এলেন হালকা শশ্রুমন্ডিত, বড় ফ্রেমের চশমা পরা এক মাঝারি কান্তির ব্যক্তি। তিনি কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ পাঠ শুরু করতেই দর্শকরা সমস্বরে বলে উঠলেন প্রয়োজন নেই এ্যালেন, অনুবাদের প্রয়োজন নেই। দর্শকদের মধ্যে অধিকাংশই তরুণ-তরুণী। ধারণা করি তারা এই এলাকার আশেপাশের তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। নিশ্চয়ই কিছু রুশ ভাষীও ছিলেন। যে ব্যক্তি অনূদিত কবিতাটি পাঠ করতে মঞ্চে এসেছিলেন তিনিই এ্যালেন গিন্সবার্গ, জানতে পারি পাশে বসা তরুণীর কাছ থেকে। এরা নামের প্রথম অংশ ধরেই ডাকে, ততদিনে জেনে গেছি। এর পরে আরো তিনবার দেখা। দু’বছর পর দেখা কথা এবং মধ্যরাত পর্যন্ত আড্ডা, মদ্যপান ইস্ট ভিলেজের সেন্ট মার্কস চার্চে। সেখানে ছিলেন কবি এ্যালেন গিন্সবার্গের সাথে বিট জেনারেশনের অপর কবি গ্রেগরি কোরসোসহ অনেক কবি আর আমাদের কবি নির্মলেন্দু গুণ। মূলত গুণদা’র অনুরোধে গুণদাকে জ্যোতিদার কিউ গার্ডেন হিলসের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলাম ওই চার্চে। আমার সাথে ছিলেন মোশাররফ। গুণদা সেন্ট মার্কস চার্চের মঞ্চে গিয়ে কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বয়ে যাওয়া টর্নেডোয় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। সেই সুযোগ করে দিয়েছিলেন এ্যালেন। দেশের জন্য গুণদার এই আবেগকে অত্যন্ত সহৃদয়তার সাথে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। এরপর গুণদা আর আমার সাথে এ্যালেনের একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো।
এ্যালেনের মহানুভবতা দেখে বিস্মিত হই। কারণ বুদ্ধদেব বসু এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা পড়ে তাদের উচ্ছৃঙ্খল, বোহেমিয়ান এবং উড়নচন্ডি জীবনের কথাই জেনেছিলাম। তবু সেপ্টেম্বর অন যেশোর রোডের এই কবি ছাত্রজীবনে আমাদের বিপুলভাবে আলোড়িত করেছিলেন। সে সময় লন্ডন থেকে পিএইচডি করে ফেরার সময় আমার ভাই কয়েকটি বই এনে দিয়েছিলেন। তার একটি ছিল পেঙ্গুইনের সেই বিখ্যাত বই। বইটিতে ছিল তিন কবি এ্যালেন গিন্সবার্গ, গ্রেগরি কোরসো আর লরেন্স ফারলেংহাটির কবিতা। প্রায় সব কবিতাই অনুবাদ করে ফেলেছিলাম। এর প্রায় মাসখানেক পরে ক্যামেরার কবি নাসির আলী মামুন (তখন তিনি নিউইয়র্কে বাস করতেন) নিয়ে গেলেন গিন্সবার্গের ইস্ট ভিলেজের বাসায়, ইস্ট রিভারের কাছাকাছি একটি জরাজীর্ণ এপার্টমেন্ট ভবনে। তিনি নিজেই দরোজা খুলে দিয়েছিলেন। আমরাই দীর্ঘক্ষণ দরোজা নক করে তার ঘুম ভাঙিয়েছিলাম।  
নাসির আলী মামুনকে এ্যালেন আগেই পছন্দ করে ফেলেছিলেন তার সাদা-কালোয় তোলা অসাধারণ আলো-আঁধারির পোট্রের্ট ফটোগ্রাফি দেখে। সেদিনও ছিল ছবি তোলার প্লান। এ্যালেন আমাদের লিভিংরুমে বসিয়ে রেখে স্নান করতে গেলেন। প্রস্তুত হয়ে ঘড়ির স্ট্র্যাপ বাক্লসে বাঁধতে বাঁধতে বললেন ‘আজ ছবি তোলার সময় হবে না। কারণ ক্যাফেতে কিছু মানুষ এসেছেন ডকুমেন্টারি তৈরির ব্যাপারে চুক্তি করতে’। আমরা তিনজনই বের হলাম এপার্টমেন্ট থেকে। প্রায় ৫/৬ মিনিট হেঁটে পৌঁছলাম ক্যাফেতে। সেখানে অনেক মানুষ। সকলে অপেক্ষা করছেন এ্যালেনের জন্য। তার নাকি আরো ঘন্টা খানেক আগে আসার কথা ছিল। আমরা ঘুম না ভাঙালে আরো কত দেরি হতো কে জানে। রাস্তা দিয়ে আমরা তিনজন হাঁটছিলাম। কথা বলছিলাম সুনীল দা, শক্তি দা এবং কবি তারাপদ রায় সম্পর্কে। জানতে চেয়েছিলাম শামসুর রাহমানের নাম শুনেছেন কিনা। আর মূল কথা ছিল সেপ্টেম্বর অন যেশোর রোড নিয়ে। তিনি প্রশ্নের তেমন উত্তর দিচ্ছিলেন না। কিন্তু প্রশ্ন করছিলেন, প্রধানত কলকাতার কবিদের সম্পর্কে। জানতে চেয়েছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ সম্পর্কে, তখনও তিনি নিউইয়র্কে আছেন কিনা। হাঁটতে হাঁটতে তার হাতের সাথে আমার হাতও স্পর্শ পেল। তার হাতে ছিল অনেক কাগজপত্র। এক ফাকে বললেন এগুলো ধরো। আমি ধরার পর তিনি পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে ডলার গুনলেন। আর নাসির আলী মামুন অনর্গল ছবি তুলে যাচ্ছিলেন। এটা সেইসব ছবির একটি। ১৯৯১ সালের।  
জ্যোতিদা-পূরবীদি ফিরে এলেন নিউইয়র্কে। কবি এ্যালেন গিন্সবার্গ চলে গেলেন পরপারে ১৯৯৭ তে। অনেক পরে জোয়ান বায়েজের গান শুনলাম। ম্যানহাটানে গেলে মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি। ডা. খন্দকার আলমগীর দেখিয়েছিলেন কোথায় প্রফুল্ল মুখার্জি দাঁড়িয়ে থাকতেন টাইমস স্কয়ারে। সেখানে গেলেই কেমন যেন হতো মনের ভিতরে। আহা নিউইয়র্ক ।  

News24bd.tv/ডিডি