ফুসফুস ক্যান্সার : প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

ফুসফুস ক্যান্সার : প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

 ডা. এস এম আব্দুল্লাহ আল মামুন

ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণে প্রতিবছর বিশ্বে ১৩ লাখ মানুষ মারা যায়। ফুসফুসের ক্যান্সার হলো পুরুষদের ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর প্রধান কারণ এবং মহিলাদের এ রকম মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ। ২০২০ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ২.২ মিলিয়ন নতুন ক্যান্সার রোগী পাওয়া যায় এবং ১.৮ মিলিয়ন মৃত্যু ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণে হয়েছে, যা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ১৮ শতাংশ।

ফুসফুসের ক্যান্সার ফুসফুসে শুরু হয়ে লিম্ফনোড বা শরীরের অন্যান্য অঙ্গ যেমন—মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

অন্যান্য অঙ্গ থেকেও ক্যান্সার ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যখন ক্যান্সার কোষ এক অঙ্গ থেকে অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে তখন সেটিকে মেটাস্টেসিস বলে। প্রাথমিক ফুসফুসের ক্যান্সারের বেশির ভাগই ফুসফুসের এপিথেলিয়াল কোষগুলোতে ধরা পড়ে।

লক্ষণ
ফুসফুসের ক্যান্সারের সাধারণ লক্ষণ শ্বাস নিতে সমস্যা হওয়া, কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়া এবং ওজন কমে যাওয়া।

কাশি : ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রথম দিকের সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে একটি হলো কাশি, যা দীর্ঘদিন ধরে চলে। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ রোগীর ক্ষেত্রেই ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে কাশি দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে শুকনা কাশি অথবা ঘন ঘন কাশি হতে পারে, কাশির সঙ্গে অতিমাত্রায় কফ যেতে পারে অথবা রাতের দিকে কাশি প্রচণ্ড বেড়ে যেতে পারে।

কাশির সঙ্গে রক্ত পড়া : আপনার কাশি বা কফের সঙ্গে যদি লাল রং দেখা যায় বা আপনার যদি কাশতে কাশতে রক্ত আসে তাহলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

শ্বাসকষ্ট : শ্বাসকষ্ট ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সাধারণ একটি উপসর্গ, যা ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে শ্বাসকষ্ট বলা হয়। শ্বাসকষ্ট অন্যান্য অনেক রোগের কারণেও হতে পারে, তাই শ্বাসকষ্ট মানেই যে ক্যান্সার তা কিন্তু নয়। তাই আপনার শ্বাসকষ্টের কারণ জানার জন্য ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করাই সবচেয়ে ভালো উপায়।

ক্ষুধা হ্রাস : যদিও খিদে কমে যাওয়া অন্যান্য অনেক অসুস্থতার উপসর্গ হতে পারে।

তবে যদি এটি কাশি বা বুকে ব্যথার মতো অন্য লক্ষণগুলোর সঙ্গে থাকে তবে এটি ফুসফুসের ক্যান্সারের ইঙ্গিত হতে পারে।
অস্বাভাবিক ওজন হ্রাস : খাবারে অরুচিকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলা হয় অ্যানোরেক্সিয়া, অন্যদিকে অপুষ্টির কারণে অনিচ্ছাকৃত ওজন হ্রাসকে ক্যাচেক্সিয়া বলা হয়। এই দুটি সংযুক্ত হয়ে ক্যান্সার অ্যানোরেক্সিয়া-ক্যাচেক্সিয়া সিনড্রোম বা সিএসিএসে পরিণত হয়। ফুসফুসের ক্যান্সার রোগীদের রোগ নির্ণয়ের সময় প্রায় ৬০ শতাংশের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে ওজন কমতে দেখা যায়। ক্যাচেক্সিয়া নির্ণয় করা হয়, যখন একজন রোগী অনিচ্ছাকৃতভাবে ছয় মাসের মধ্যে তাদের শরীরের ওজনের ৫ শতাংশের বেশি ওজন কমে যায়।

বুকে ব্যথা : কাশি দেওয়ার সময় বা হাসার সময় অথবা গভীর শ্বাস নেওয়ার সময় যদি বুকে চরম ব্যথা অনুভব করেন, সেটা ফুসফুসের ক্যান্সারের আরেকটি সাধারণ লক্ষণ হতে পারে।

ফুসফুসের ক্যান্সার নির্ণয়
ফুসফুসের ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ার সময় যদি রোগ অনেক দূর ছড়িয়ে পড়ে তাহলে রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়। সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৭০ শতাংশ রোগী এক বছর বেঁচে থাকে যদি ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করা যায়।

প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে রোগ প্রতিকার করা সহজ হয়। ফুসফুসের ক্যান্সারের চিকিৎসাপদ্ধতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সার্জারি, কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন থেরাপি। টার্গেটেড থেরাপি বর্তমানে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

বুকের এক্স-রে : একটি বুকের এক্স-রে সাধারণত ফুসফুসের ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত প্রথম পরীক্ষা। এক্স-রে ফলাফলে যদি সন্দেহভাজন কিছু পাওয়া যায় তখন রোগীকে সিটি স্ক্যান করাতে বলা হয়। এরপর প্রয়োজন অনুযায়ী পেট-সিটি স্ক্যান, ব্রংকোস্কোপি ও বায়োপসি করানো হয়।

ফুসফুসের ক্যান্সার সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপি, টার্গেটেড থেরাপি, ইমিউনোথেরাপি বা এই ট্রিটমেন্টগুলোর সংমিশ্রণের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যেতে পারে। গত কয়েক বছরে গবেষণার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুসের ক্যান্সারের চিকিৎসায় নানা পরিবর্তন এসেছে। ফুসফুসের ক্যান্সারের চিকিৎসা নির্ভর করে রোগের প্রকারের ওপর।

সর্বোপরি ফুসফুসের ক্যান্সার রোধ করতে আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণ ও উপসর্গ সম্পর্কে জানা থাকলে এবং এই লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে এ ধরনের রোগ মোকাবেলা করা সম্ভব।

লেখক : সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও কো-অর্ডিনেটর, রেসপিরেটরি মেডিসিন, এভারকেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা।