পবিত্র কোরআনের প্রসিদ্ধ ১০ কিরাতের কারি যাঁরা

আল কোরআন

পবিত্র কোরআনের প্রসিদ্ধ ১০ কিরাতের কারি যাঁরা

মো. আবদুল মজিদ মোল্লা

কিরাত হলো পবিত্র কোরআনের পাঠপদ্ধতি। কোরআনের শব্দ ও বাক্য কিভাবে উচ্চারণ করা হবে তা কিরাতশাস্ত্রে আলোচনা করা হয়। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন শব্দ ও বাক্যের উচ্চারণ পদ্ধতি নিয়ে কোরআন গবেষকদের ভেতর মতভিন্নতা রয়েছে। যার ভেতর প্রণিধানযোগ্য ১০ কারির মতগুলো ‘১০ কিরাত’ নামে পরিচিত।

কিরাতশাস্ত্রের পরিচয়

ড. ফাহাদ বিন আবদুর রহমান রুমি কিরাতশাস্ত্রের পরিচয় তুলে ধরে লেখেন, ‘যে শাস্ত্র পাঠ করলে কোরআনের শব্দগুলোর উচ্চারণ করার পদ্ধতি ও তা আদায়ের প্রক্রিয়া জানা যায় তাকে কিরাতশাস্ত্র বলে। চাই বিষয়গুলোতে কিরাতশাস্ত্রবিদরা একমত হোক বা না হোক। ’ (দিরাসাতুন ফি উলুমিল কোরআন, পৃষ্ঠা ৩১৪)

কিরাতের সংখ্যা কত?

পবিত্র কোরআনের বিখ্যাত কিরাতের সংখ্যা সাতটি এবং তা নির্ভুল ধারাবাহিকতায় প্রমাণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ বিষয়ে বলেন, জিবরাইল আমাকে একভাবে কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন।

এরপর আমি তাঁকে অন্যভাবে পাঠ করার জন্য অনুরোধ করতে লাগলাম এবং বারবার অন্যভাবে পাঠ করার জন্য ক্রমাগত অনুরোধ করতে থাকলে তিনি আমার জন্য তিলাওয়াতের পদ্ধতি বাড়িয়ে যেতে লাগলেন। অবশেষে তিনি সাত আঞ্চলিক ভাষায় তিলাওয়াত করে সমাপ্ত করলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৯৯১)
বেশির ভাগ আলেম এ বিষয়ে একমত যে বিখ্যাত সাত কিরাতের বাইরে আরো তিনটি কিরাত নির্ভুল ও সন্দেহাতীত ধারাবাহিকতায় প্রমাণিত। তবে ১০ কিরাতের বাইরে অন্য কিরাতগুলো শাজ বা বিরল।

আল্লামা ইবনুল জাজারি (রহ.) ১০ কিরাতের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। আর আল্লামা জুরকানি (রহ.) বলেন, ‘গবেষণা ও অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে যে ১০ কিরাতের সবগুলো মুতাওয়াতির বা নির্ভুল ধারাবাহিকতায় প্রমাণিত। আল্লামা ইবনুস সুবকি, ইবনুল জাজারি ও নুওয়াইরি (রহ.)-এর মতো গবেষকদের এটাই মত। ’ (সাফহাতুন ফি উলুমিল কিরায়াত, পৃষ্ঠা ৬৯-৭১; মানাহিলুল ইরফান ফি উলুমিল কোরআন : ১/৪৪১)

কিরাতের সংখ্যা একাধিক কেন

উম্মতের সহজতার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর কাছে একাধিক কিরাতের আবেদন করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ বিষয়ে বলেন, জিবরাইল আমাকে একভাবে কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন।

এরপর আমি তাঁকে অন্যভাবে পাঠ করার জন্য অনুরোধ করতে লাগলাম এবং বারবার অন্যভাবে পাঠ করার জন্য ক্রমাগত অনুরোধ করতে থাকলে তিনি আমার জন্য তিলাওয়াতের পদ্ধতি বাড়িয়ে যেতে লাগলেন। অবশেষে তিনি সাত আঞ্চলিক ভাষায় তিলাওয়াত করে সমাপ্ত করলেন। (বুখারি : ৪৯৯১)
অপর এক হাদিসে এসেছে, জিবরাইল (আ.) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ আপনাকে আদেশ করেছেন, আপনি যেন আপনার উম্মতকে এক উপভাষায় কোরআন পড়ান। উত্তরে তিনি বলেন, আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, আমার উম্মত এর ক্ষমতা রাখবে না। এভাবে তিন তিনবার অনুরোধ করার পর আল্লাহ সাত কিরাত দান করেন। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৯৩৯)

১০ কিরাত নির্বাচনের ভিত্তি

কিরাতশাস্ত্রবিদ ও কোরআন গবেষকরা তিনটি মৌলিক শর্তের ভিত্তিতে ১০ কিরাতকে গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তা হলো—

১. বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হওয়া। অর্থাৎ বিশুদ্ধ সনদে কিরাতের ধারাবাহিকতা ও পরম্পরা প্রমাণিত হওয়া।

২. মাসহাফে উসমানির সঙ্গে মিল থাকা। উসমান (রা.)-এর যুগে সংকলিত কোরআনের অনুলিপিগুলোর যেকোনো একটির সঙ্গে মিল থাকা।

৩. আরবি ভাষারীতির অনুকূল হওয়া। আরবি ভাষার বিখ্যাত নিয়ম ও বিধানের বিপরীত না হওয়া। (মাদখালুন ইলাত তাফসির ওয়াল উলুমিল কোরআন, পৃষ্ঠা ৩৩০)

১০ কিরাতের কারি যাঁরা

পবিত্র কোরআনের গ্রহণযোগ্য ১০ কিরাতকে ১০ জন বিখ্যাত কারির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নাম দেওয়া হয়। তাঁরা হলেন :

১. নাফে ইবনে আবি নুয়াইম (রহ.) : তিনি ছিলেন মদিনার বিখ্যাত কারি। তাঁকে ‘শায়খুল কুররা’ (কারিদের শিক্ষক) বলা হতো। তিনি প্রায় ৭০ জন তাবেঈর কাছ থেকে কিরাতশাস্ত্রের জ্ঞানার্জন করেন। যাঁদের বেশির ভাগ আবু হুরায়রা, ইবনে আব্বাস ও উবাই বিন কাআব (রা.) থেকে কিরাতশাস্ত্রের পাঠ নিয়েছিলেন। তিনি ১৬৭ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

২. আবু আমর ইবনুল আলা (রহ.) : তিনি ছিলেন বসরার বিখ্যাত কারি। কোরআন ও আরবি ভাষা বিষয়ে তাঁর গভীর পাণ্ডিত্য ছিল। তাঁকে ‘সাইয়িদুল কুররা’ (কারিদের নেতা) বলা হতো। তিনি ১৪৫ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

৩. হামজা বিন হাবিব আজ-জাইয়াত (রহ.) : তাঁর উপনাম আবু উমারা। তিনি ছিলেন কুফার অধিবাসী। কিরাতশাস্ত্র ছাড়াও তিনি উত্তরাধিকারবিষয়ক জ্ঞান ও হাদিসশাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। তিনি ১৫৬ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

৪. আবদুল্লাহ বিন আমের (রহ.) : তাঁর উপনাম আবু ইমরান ও আবু নুয়াইম। তিনি মুগিরা ও উসমান ইবনে আফফান (রা.) থেকে কিরাতের শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ১১৮ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

৫. আবদুল্লাহ বিন কাসির (রহ.) : তাঁর উপনাম আবু মুহাম্মদ। তিনি ছিলেন বিখ্যাত তাবেঈ ও কারি। তিনি আনাস বিন মালিক, আবদুল্লাহ বিন জুবায়ের, আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-সহ একাধিক সাহাবির সাক্ষাৎ লাভ করেন। তিনি ১২০ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

৬. আসেম ইবনে আবিন নুজুদ আসাদি (রহ.) : তাঁর উপনাম আবু বকর। তিনি ছিলেন কিরাতশাস্ত্রে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি এবং সুমিষ্ট কণ্ঠের অধিকারী। তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর শিষ্য জুর ইবনে হুবাইস (রহ.)-এর কাছে কিরাত শেখেন। তিনি ১২৭ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

৭. আলী ইবনে হামজা কিসায়ি (রহ.) : তাঁর উপনাম আবুল হাসান। তিনি তাঁর যুগে ভাষা ও কিরাত বিষয়ে কুফার সবচেয়ে পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। ১৮৯ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

৮. ইয়াজিদ ইবনে কা’কা (রহ.) : তিনি আবু জাফর মাদানি নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন মদিনার বিখ্যাত কারি। আবদুল্লাহ ইবনে আবি রাবিআ (রা.)-এর মুক্তিপ্রাপ্ত দাস ছিলেন তিনি। শৈশবে উম্মে সালামা (রা.) তাঁর জন্য বরকতের দোয়া করেন। তিনি ১৩০ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

৯. ইয়াকুব ইবনে ইসহাক (রহ.) : তাঁর উপনাম আবু মুহাম্মদ। তিনি বসরার বিখ্যাত কারি ছিলেন। তিনি ২০৫ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

১০. খালফ ইবনে হিশাম আল বাজ্জার (রহ.) : তিনি মূলত কারি হামজা আজ-জাইয়াত (রহ.)-এর শিষ্য ছিলেন। তবে কিছু কিছু বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করতেন। (তারাজিমুল কুররা আল আশার ও রুওয়াতিহিম, পৃষ্ঠা ১৪০-১৬৪; আল মাদখাল ইলা উলুমিল কোরআন, পৃষ্ঠা ২০৫)

উসমান (রা.) অন্য কিরাত নিষিদ্ধ করেছিলেন?

উসমান (রা.)-এর যুগে অনারব মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তিনি কোরআনের সবচেয়ে বিশুদ্ধ কিরাত, যা কুরাইশের ভাষারীতির অনুরূপ ছিল সে অনুসারে কোরআন লিপিবদ্ধ করেন এবং অন্য সব মাসহাফ জব্দ করেন। তবে তিনি কোরআনে নুকতা ও হরকত যুক্ত করা থেকে বিরত থাকেন। যেন তা ভিন্ন কিরাত অনুসারে পাঠ করার অবকাশ থাকে। (ইসলাম কিউএ ডটইনফো, প্রশ্ন নম্বর ৫১৪২)

আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।

news24bd.tv/আইএএম

এই রকম আরও টপিক