পোলার উলফ কারাগারে নাভালনির কাটানো দিনগুলো

রাশিয়ার দূরবর্তী খার্প শহরে রাত ও দিনের মাঝে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।

পোলার উলফ কারাগারে নাভালনির কাটানো দিনগুলো

অনলাইন ডেস্ক

রাশিয়ার দূরবর্তী খার্প শহরে রাত ও দিনের মাঝে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। আর্কটিক সার্কেলের উপরে অবস্থিত এ অঞ্চলটি বছরের বেশিরভাগ সময় রাতের আঁধারে ডুবে থাকে। এসবের পরেও আলেক্সেই নাভালনির উপস্থিতি অঞ্চলটিকে আলোকিত করে তুলেছিল।

মাত্র কিছুদিন আগেই তাকে অত্র অঞ্চলে অবস্থিত এবং দুর্নাম কুড়ানো পোলার উলফ বা আইকে-৩ কারাগারে আনা হয়েছিল।

কারাগারে থাকাবস্থায় নাভালনি এক্সে লিখেছিলেন 'যখনই আমি জানালা দিয়ে তাকাই তখনই আমি দেখি বাইরে রাত। '

তিন বছর কারাগারে কাটালেও পোলার উলফ ছিল নাভালনির জন্য খুবই কষ্টদায়ক এক জায়গা। বিশ্লেষকদের মতে, বন্দীদেরকে শারিরীক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করার জন্যই এই কারাগার বানানো হয়েছে। এই কারাগারের বন্দীদেরকে প্রহার করা হয়, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং সেলের বাইরে ভেজা কাপড়ে দীর্ঘক্ষণ রাখা হয়।

নিজের আইনজীবীদের দ্বারা লিখিত বার্তার মাধ্যমে নাভালনি কারাগারটি সম্পর্কে অনেককিছুই জানিয়ে গেছেন।

সোভিয়েত আমলের বাধ্যতামূলক গুলাগ শ্রমব্যবস্থার অংশ হিসেবে ১৯৬০ এর দশকে পোলার উলফ নির্মাণ করা হয়। খার্প শহরের ইয়ামাল-নিনেতস অঞ্চলে অবস্থিত কারাগারটি মস্কো থেকে ১ হাজার ৯০০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এবং আর্কটিক সার্কেল থেকে ৬০ কিলোমিটার উপরে অবস্থিত এবং গুলাগ বন্দীদের দ্বারা নির্মিত।

লাট্রোব বিশ্ববিদ্যালয়ে রাশিয়ার সরকারব্যবস্থা বিশ্লেষক রবার্ট হরভাথের মতে, পুরো রাশিয়াজুড়ে পোলার উলফের মতো আরও ৭০০টি কারাগার রয়েছে। খুবই নির্দয় এক ব্যবস্থার অধীনে থাকা সবচেয়ে খারাপ কারাগারে নাভালনির জায়গা হয়েছিল। কারাগারটি এমন এক জায়গায় অবস্থিত যেখানে আর কিছুই নেই। কারাগারটি পাহাড় ও বরফ দ্বারা ঘেরা, এবং এখান থেকে পালানো অসম্ভব।

নাভালনির প্রধান কৌশলবিদ লিওনিদ ভলকভের মতে, এই কারাগারে যাওয়া এবং চিঠি পাঠানো দুটোই প্রায় অসম্ভব।

পুতিনের সমালোচক নাভালনিকে ২০২১ সালে প্রথমে ১১ বছরের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়। গত বছর তার শাস্তি দুই দশকের জন্য বৃদ্ধি করা হয়।

বছরের বেশিরভাগ সময় খার্প অঞ্চলের তাপমাত্রা মাইনাস ৩০ ডিগ্রীর নিচে থাকে। গ্রীস্মকালে অঞ্চলটিতে মশা এবং জোঁকের উপদ্রব হয়। টেলিগ্রাম অ্যাপে নাভালনি বলেছিলেন, তাপমাত্রা এখনও মাইনাস ৩২ ডিগ্রীর নিচে নামেনি। ইয়ামাল অঞ্চলে ভোর ছয়টার সময় হাটতে বের হওয়া এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

নাভালনির পোস্ট করা এক ছবিতে দেখা যায়, তার হাটার জায়গাটুকু ১১ কদম লম্বা এবং তিন কদম প্রশস্ত।

মানবাধিকার কর্মী ওলগা রোমানোভা এই কারাগারে থাকা একজন সাবেক বন্দীর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, এ কারাগারে বন্দীদেরকে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় শরীর হিম করে দেওয়া তাপমাত্রায় ৪০ মিনিট ধরে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়, এবং কেউ নড়াচড়া করলে সবার গায়ে পানি ছিটানো হয়।

পোলার উলফ কারাগারে অধিকাংশ বন্দীকে একাকী রাখা হয়। নাভালনির একজন মুখপাত্র জানান, নিরাপত্তা প্রহরীর কাছে নিজেকে সঠিকভাবে পরিচিত না করানোয় তাকে ১০ দিনের জন্য একাকী বন্দিদশায় রাখা হয়েছিল।

কিরা ইয়ারমিশের মতে, নাভালনিকে মোট ২৮৩ দিন একাকী বন্দিদশায় রাখা হয়েছিল।

আরও পড়ুন: নাভালনির সমর্থকদের ওপর পুলিশের ধরপাকড়ে আটক ৪০০

পোলার উলফ কারাগারে নাভালনিকে মাঝেমাঝে শারিরীক ও মানসিকভাবে অসুস্থদের সাথে থাকতে হতো। জানুয়ারি মাসে নাভালনি দিনে ১৪ ঘন্টা ও রাতে তিন ঘন্টা চিৎকার করা এক মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তির সাথে বন্দী থাকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন।

শারিরীকভাবে অসুস্থ নাভালনিকে গ্যাস্ট্রিক, ডায়রিয়া ও টিবি আক্রান্ত বন্দীদের সাথেও রাখা হয়েছিল।  

প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় পুতিন সমর্থক এক গায়কের গান শুনতেও বাধ্য করা হয় নাভালনিকে। এমনকি, প্রতিদিন আট ঘন্টা ধরে নাভালনিকে রাশিয়ার সরকারী টিভি চ্যানেল ও চলচ্চিত্র দেখতে হতো। ২০২১ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাভালনি বলেছিলেন, কারাবন্দী থাকার সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা হচ্ছে রাশিয়ান প্রোপাগান্ডা হজম করা।

প্রফেসর হরভাথের মতে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে গুলাগ কারাগার ব্যবস্থায় তেমন কোনো পরিবর্তন না এলেও অবস্থা বদলাতে শুরু করেছে।

news24bd.tv/ab