সোহরাওয়ার্দী বাংলা ভাষার প্রশ্নটি অর্থহীন মনে করলেও শেখ মুজিবের চাপে মত পাল্টেছিলেন

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন 

সোহরাওয়ার্দী বাংলা ভাষার প্রশ্নটি অর্থহীন মনে করলেও শেখ মুজিবের চাপে মত পাল্টেছিলেন

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন 

মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, শুধু ভাষার লড়াই ছিলো না; ভাষা আন্দোলন ছিলো বহুমাত্রিক আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বাঙালি প্রথম আত্মসচেতন হয়। বিশেষ করে মুক্তির লক্ষ্যে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে একটি স্লোগান আছে, ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’।

আমরা পাকিস্তানি অপশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে যে প্রথম প্রতিবাদমুখর হয়েছিলাম, তা ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। সেজন্য ভাষা আন্দোলন বাঙালির মাথা নত না করার সংগ্রাম। একইসঙ্গে ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বাঙালি মুসলমান তার ঘরে ফেরার সূচনা করেছিলো। অবশ্য ঘরে ফিরেছিলো একাত্তরে।

ভাষা আন্দোলন ছিলো মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির প্রশ্নে। একটি কথা সর্বজনবিদিত যে ভাষা আন্দোলন এজন্যই হয়েছিলো প্রাথমিকভাবে যে বাংলা ভাষা হারিয়ে গেলে বাঙালির সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতো। এ কথাটা পাকিস্তানিরা জানতো। সেজন্য বাঙালিকে নিঃশেষ করে দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপই ছিলো ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনকে আমি সবসময়ই বলি, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র রক্ষা আন্দোলন। মনে রাখতে হবে, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের যতো সংগ্রাম, তার সূচনাই হয়েছিলো সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এবং সেজন্য ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালে তমুদ্দিন মজলিস যে পুস্তিকা বের করেছিলো, তার শিরোনাম ছিলো, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু না বাংলা’। ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট কলকাতার সাপ্তাহিক মিল্লাত পত্রিকার সম্পাদকের কক্ষে এক আলোচনায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতে হবে বাংলা। কারণ বাংলা পাকিস্তানের সিংহভাগ মানুষের ভাষা। বঙ্গবন্ধু ইতিহাস নির্ভর হয়েই কথা বলেছিলেন। এজন্য যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাই হয় একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা।  
দু’দিন পর সিরাজউদ্দোলা হোটেলে আয়োজিত আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু একই কথা বলেছিলেন। রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দী বাংলা ভাষার প্রশ্নটি অর্থহীন মনে করলেও শিষ্য শেখ মুজিবের চাপে মত পালটেছিলেন। ১৯৫৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের আইন সভায় বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনো ধোঁকাবাজি করা যাবে না। পূর্ববঙ্গের দাবি এই যে বাংলাও রাষ্ট্রীয় ভাষা হোক। ’

১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলা একাডেমিতে বললেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারি অফিস-আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে। ’ তা-ই হয়েছিলো। তবুও ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি হিসেবে এক আদেশে তিনি বললেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, স্বাধীনতার তিন বছর পরেও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে-এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। ’ বর্তমানে বাংলা ভাষা পরিস্থিতি গুরুতর। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আরও কষ্ট পেতেন।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ভাষাকে বিশ্বদরবারে নিয়ে গেলেন। তিনি ইংরেজিতে বলার জন্য অনুরুদ্ধ হয়েছিলেন; রাজি হননি। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে রাষ্ট্রদূত ফারুক চৌধুরী তাৎক্ষণিক ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন, যা হেডফোনে শোনা গিয়েছিলো। ১৯৫২ সালেও বঙ্গবন্ধু পিকিং এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের শান্তি সম্মেলনেও বাংলায় বক্তৃতা করেছিলেন।  

পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ৪ কোটিরও বেশির ভাষা ছিলো বাংলা। তবুও বাঙালির উপরে একধরনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার চেতনাও ছিলো উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে। পাকিস্তানিদের অবস্থানের পেছনের ইসলামী আবেগও ছিলো প্রচণ্ডভাবে কার্যকর। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ ও ২৪ মার্চ ঢাকায় যখন রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর স্বপক্ষে কথা বলেছিলেন, তখন আমার মনে হয়, দুটি কারণে তিনি তা করেছিলেন। একটি হচ্ছে ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইসলামকে রাজনীতিকরণ করেছিলেন পাকিস্তান হওয়া প্রসঙ্গেই। ফলে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি ইসলামী আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হলেন। আরেকটি তিনি দেখেছিলেন, উর্দু ভাষা যদি চাপিয়ে দেওয়া যায় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে তাহলে বাঙালিকে অনেকটা দুর্বল করা যাবে। মনে রাখতে হবে, বাঙালি যদি উর্দু ভাষায় কথা বলতো, তাহলে বাঙালি রাতারাতি একটা অশিক্ষিত জাতিতে পরিণত হতো। তথ্য-উপাত্ত কিছু পেতো না। বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি সবকিছু হারিয়ে যেতো।  

একজন মানুষ যখন কোনো আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয় বা নেতৃত্ব দেয় তখন বুঝে নিতে হয় যে, আন্দোলন নিহিত মর্মবাণী মানুষটির চেতনায় প্রগাঢ় ছায়া ফেলে আছে। ভেতরের তাগিদ না থাকলে মানুষ কোনো কর্মেই নিবেদিতপ্রাণ বা ঐকান্তিক হতে পারে না। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর সম্পৃক্তির দালিলিক প্রমাণ আছে এবং তার নিজস্ব জবানি অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা বই দুটোতে তিনি লেখেছেনও। কিন্তু এ প্রমাণগুলো ঘটনা ও ঘটনাক্রমে তুলে ধরে, বলে না (বা বঙ্গবন্ধু নিজেও বলেননি) কেন বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলনের প্রতি নৈকট্য অনুভব করেছিলেন। তবে সরাসরি না বললেও বঙ্গবন্ধু তার বাংলা ভাষাপ্রীতি ও ভাষা আন্দোলনের প্রতি নৈকট্যের কথা বলেছেন নানা ভাষণে। স্মরণে রাখা দরকার, এমন বক্তব্য শুধু ভাষা আন্দোলনের সময়ে উচ্চারিত হয়েছে তা নয়, বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় বহুবার তা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর গভীর দ্যোতনাসমৃদ্ধ এমন একটি উচ্চারণ ছিল ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারির ভাষণে। তিনি বলেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলবো, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। বাংলার মাটি আমার স্থান। ’ একটি সংক্ষিপ্ত বাক্যে মন্দ্রিত উচ্চারণে মানুষটির সামগ্রিক জীবনদর্শন ও রাজনৈতিক দর্শনের সারাৎসার উঠে এসেছে। এ মন্ত্রেই উজ্জীবিত ছিল ভাষা আন্দোলন এবং বাঙালির রাষ্ট্রসাধনার দুর্মর আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদী বাঙালির জেগে ওঠা এবং তার পরিণতি যে স্বাধীন বাংলাদেশ, তা বঙ্গবন্ধু মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন।

বাংলা ভাষার প্রশ্নে তিনি তার মত তুলে ধরেছিলেন ১৯৭১-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে এক বক্তৃতায়, ‘মুক্ত পরিবেশেই ভাষার বিকাশ হয়। ঘরে বসে ভাষার পরিবর্তন - পরিবর্ধন করা যায় না। এর পরিবর্তন পরিবর্ধন হয় ব্যবহারের ভেতর দিয়ে। ভাষার গতি নদীর স্রোতধারার মতো। ভাষা নিজেই তার গতিপথ রচনা করে নেয়। কেউ এর গতি রোধ করতে পারে না। ’ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আহবান ছিল ‘স্বাজাত্যবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে বাংলা ভাষাকে গণমুখী ভাষা হিসেবে গড়ে তুলুন। ’ ভাষার মর্যাদা যে স্বাজাত্যবোধের দ্যোতক এমন একটি বার্তা পাওয়া গেলো এমন বক্তব্যে। অন্যদিকে শুরুতে ছিল ভাষার অন্তর্নিহিত রূপ সম্পর্কে চুম্বক বক্তব্য।  
ভাষা আন্দোলনের তারিখ নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি আছে আমাদের মধ্যে। আমি যতোটুকু তথ্য পেয়েছি, তা থেকে বলবো, ১৯৪৮ সাল থেকে নয়, ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিলো ১৯৪৭ সাল থেকেই। সাতচল্লিশ থেকে ভাষা আন্দোলন শুরু হওয়ার যুক্তিসংগত তথ্য আমাদের হাতে আছে। যেমন ধরা যাক ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান তখন ২৭ বছরের তরুণ। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক মিল্লাত’ পত্রিকার সম্পাদকের কক্ষে বসে আলোচনা প্রসঙ্গে শেখ মুজিব বলেছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। আরেকটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হয় গরিষ্ঠের মুখের ভাষাই।

আবার একই সময়ে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন ইসলামী মানসিকতাকে গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত উর্দু। ড. জিয়াউদ্দিনের এই প্রস্তাবনাকে বিরোধিতা করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আজাদ পত্রিকায় লিখেছিলেন যে, ‘যদি দুই প্রদেশের মধ্যে সংযোগ ভাষা হতে হয়, তাহলে বাংলা হতে হবে। অথবা ইংরেজি করুক। বিতর্কটা শুরু হয়ে গিয়েছিলো ঠিক ওই সময় থেকেই বলা যায়। এ কারণে বঙ্গবন্ধু ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে ভাষা আন্দোলনের দ্রষ্টা হিসেবে বলি। বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনের স্রষ্টাও। কারণ ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়েছে তথ্যের ভিত্তিতে।

বাঙালির স্বাধিকার চেতনা কতোটুকু আহুত করেছিলো ভাষার এই প্রসঙ্গটি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠিত হলো ভাষা প্রশ্ন সামনে রেখে। ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস প্রকাশ করেছিলো তাদের সেই সাড়া জাগানো পুস্তিকা ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’?। ওই পুস্তিকা প্রকাশ হওয়ার পরই বুদ্ধিভিত্তিক জগতে ভাষার প্রশ্নে একটা আলোড়ন তৈরি হয়েছিলো। ওই পুস্তিকায় যারা লিখেছিলেন, তাদের কথা যদি আমরা অনুসরণ করি, তাহলে আমার বিশ্লেষণে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার পেছনে অন্তত দুটি কারণ আমি খুঁজে পাই। একটি কারণ হচ্ছে মুসলমানী আবেগ। কারণ উর্দু ভাষা লেখা হতো আরবি হরফে। যা এখনো লেখা হয়। কাজেই উর্দু ভাষা আরবি হরফের সঙ্গে থাকার কারণে অনেকটা ইসলামলগ্ন হিসেবে বিবেচনা করা হতো।  
এই কথাগুলো বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করেই বলেছিলেন ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউশনে এবং ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমিতে। বাংলা ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার লড়াই ছিলো না, এটা ছিলো আমাদের আত্মঅধিকার আদায়ের লড়াই। আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই। কাজেই বাঙালির বাঙালিত্ব খর্ব করার যে উদ্যোগ ছিলো রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে, বাঙালি তা রুখে দাঁড়িয়েছিলো। এই রুখে দাঁড়ানোটাই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে শাণিত করার একটা বড় উদ্যোগ। সে কারণেই আমরা বলি, ভাষা আন্দোলনের হাত ধরেই আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে। আর বাঙালি জাতীয় চেতনার স্ফুরণ ঘটেছিলো ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।  

লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ

news24bd.tv/ডিডি

এই রকম আরও টপিক