যেসব আমলে আল্লাহর ওলি হওয়া যায় 

যেসব আমলে আল্লাহর ওলি হওয়া যায় 

আলেমা হাবিবা আক্তার

উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুজুর্গ আলেম শাহ হাকিম মুহাম্মদ আখতার (রহ.) আল্লাহর ওলি তথা তাঁর প্রিয়ভাজন হওয়ার পাঁচ উপায় বর্ণনা করেছেন। তা হলো—ক. আল্লাহওয়ালাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা, খ. গুনাহ ত্যাগ করা, গ. গুনাহের উপকরণ ত্যাগ করা, ঘ. নিয়মিত আল্লাহর জিকির করা, ঙ. সুন্নত অনুসারে চলা।

কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে পাঁচটি বিষয়ের গুরুত্ব তুলে ধরা হলো—

১. আল্লাহর ওলির সঙ্গে সম্পর্ক রাখা : ভালো মানুষের সঙ্গ মানুষকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করে এবং মন্দ মানুষের সঙ্গ মানুষকে মন্দ কাজে প্ররোচিত করে। বাংলা ভাষায় বলা হয় ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’।

মানুষ যখন কোনো আল্লাহর ওলি ও নিকটবর্তী বান্দার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে, তখন তার ভেতরও আল্লাহর ভালোবাসা প্রবল হয় এবং তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলতে থাকে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো। ’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১১৯)

রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহপ্রেমী মানুষকে ভালোবাসা অর্জনের দোয়া শিখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দাউদ (আ.) দোয়া শিখিয়েছেন, হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে তোমার ভালোবাসা এবং যে তোমাকে ভালোবাসে তার ভালোবাসা প্রার্থনা করি এবং এমন আমল করার সামর্থ্য চাই, যা তোমার ভালোবাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেবে।

হে আল্লাহ! তোমার ভালোবাসাকে আমার নিজের জান-মাল, পরিবার-পরিজন ও ঠাণ্ডা পানির চেয়েও বেশি প্রিয় করে দাও। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৯০)

২. গুনাহ ত্যাগ করা : গুনাহ ও পাপ হলো অন্ধকারস্বরূপ। যখন মানুষ কোনো পাপ করে, তখন তার অন্তরে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি এক পর্যায়ে তা অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায়।

আর অন্ধকার হৃদয়ে আল্লাহর ভালোবাসা ও জ্যোতি জন্ম নিতে পারে না। তাছাড়া গুনাহ হলো আল্লাহর অবাধ্যতা। কোনো অবাধ্য ব্যক্তি আল্লাহর ভালোবাসা প্রত্যাশা করতে পারে না। তাই আল্লাহর ওলি হওয়ার প্রথম শর্ত হলো গুনাহ ত্যাগ করা। পবিত্র কোরআনে গুনাহের ভয়াবহতা তুলে ধরে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অবাধ্য হলে এবং তাঁর নির্ধারিত সীমালঙ্ঘন করলে তিনি তাকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করবেন। সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি রয়েছে। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৪)

আল্লাহ তাওবার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই সেসব লোকের তাওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে এবং সত্বর তাওবা করে, তারাই তারা যাদের তাওবা আল্লাহ কবুল করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৭)

৩. গুনাহের উপকরণ ত্যাগ করা : মুমিন বান্দার জন্য গুনাহ ও গুনাহের উপকরণ উভয়টি ত্যাগ করা ফরজ। গুনাহের উপকরণ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এমন ব্যক্তি, বিষয়, বস্তু, পরিবেশ ও প্রতিষ্ঠান, যা মানুষকে আল্লাহর অবাধ্য হতে প্ররোচিত করে অথবা যা কিছু গুনাহের কারণ হয়। যেমন কোনো বন্ধু যখন ব্যক্তিকে কোনো পাপ কাজে প্ররোচিত করে, তখন মুমিন এমন বন্ধু ত্যাগ করবে। কোনো প্রতিষ্ঠান যখন কর্মীকে পাপ করতে বাধ্য করে, তখন কর্মী সে প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না, এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ। ...এতিম বয়োপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সদুপায় ছাড়া তার সম্পত্তির নিকটবর্তী হয়ো না এবং প্রতিশ্রুতি পালন কোরো; নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি পালন কোরো; নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে। ’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩২ ও ৩৪)

৪. নিয়মিত আল্লাহর জিকির করা : জিকির অর্থ স্মরণ। তাসাউফের পরিভাষায় জিকির হলো আল্লাহর তাসবিহ পাঠের এমন অনুশীলন, যা বান্দার অন্তরে আল্লাহর স্মরণকে সদা জাগ্রত রাখে। আল্লাহর জিকির বান্দাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়। মহান আল্লাহ জিকির নির্দেশ দিয়েছেন এবং তার ফলাফল তুলে ধরেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহকে অধিক স্মরণ কোরো এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কোরো। তিনি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তাঁর ফেরেশতারাও তোমাদের জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করে অন্ধকার থেকে তোমাদেরকে আলোতে আনার জন্য এবং তিনি মুমিনদের প্রতি পরম দয়ালু। ’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৪১-৪৩)

অন্য আয়াতে আল্লাহর জিকির থেকে বিমুখ থাকার ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আমার স্মরণে বিমুখ থাকবে, অবশ্যই তার জীবনযাপন হবে সংকুচিত। আর তাকে কিয়ামতের দিন ওঠাব অন্ধ করে। ’ (সুরা : তাহা, আয়াত : ১২৪)

মহানবী (সা.) আল্লাহর স্মরণবিমুখ মানুষদের মৃত ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, যারা আল্লাহর জিকির করে এবং যারা আল্লাহর জিকির করে না—তাদের দৃষ্টান্ত জীবিত ও মৃত ব্যক্তির মতো। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৪০৭)

৫. সুন্নতের অনুসরণ করা : আল্লাহর ভালোবাসা লাভের অন্যতম শর্ত হলো আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সুন্নতের অনুসরণ করা। বুজুর্গ আলেমরা বলেন, আল্লাহর দরবারে কোনো আমল কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো তা রাসুলের সুন্নত মোতাবেক হওয়া। কেননা আল্লাহ তাঁর রাসুলের আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস করো, তবে তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো রাসুলের এবং তাঁদের যাঁরা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারী। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৯)

অন্য আয়াতে নবীজি (সা.)-এর আনুগত্যের বিনিময়ে আল্লাহর ভালোবাসাকে পুরস্কার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘বলো, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৩১)

আল্লাহ সবাইকে তাঁর ওলি হওয়ার তাওফিক দিন। আমিন।

এই রকম আরও টপিক