বাংলা : বারবার রক্ত দিতে হয়েছে যে ভাষাকে

সম্রাট দেব চৌধুরী-ফাইল ছবি।

বাংলা : বারবার রক্ত দিতে হয়েছে যে ভাষাকে

সম্রাট দেব চৌধুরী 

কমলা ভট্টাচার্যের  ছিলো বাঁচার বড় তাগিদ। তাই তো নিজের পিতৃভুমি পূর্ব পাকিস্তানের সিলেট ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন আসামের বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল শিলচরে,১৯৫০ এর সাম্প্রদায়িক গণহত্যা থেকে বাঁচতে। পড়াশোনাটা করতে চেয়েছিলেন একটু ভালোভাবে বাঁচতে।  বই কেনার সামর্থ্য ছিলো না।

একটি অভিধান কিনে দিতে বলেছিলেন বোনকে ,তাও পাননি। অন্যের বই দিয়ে পড়ে পড়ে মেট্রিক পাশ করেছিলেন কমলা। আর তার পরই জানতে পেরেছিলেন এখানে থাকলে চাকরি চাই বা শিক্ষা , শিখতে হবে অহমিয়া ভাষাই , নইলে জুটবে না ভাত , বিদ্যাশিক্ষা তো দূর। কিন্তু কমলার যে তখন পিছু ফেরারও সব পথ বন্ধ! তাই কমলাও এবার ফুসে উঠেন ।
আর কত পালাবেন তিনি? আর কত এখান থেকে ওখানে , এই দুয়ার থেকে ওই দুয়ারে ঘুরে ঘুরে বেড়াবেন? তাই এবার কমলাও প্রতিবাদী , প্রতিবাদী হাজারো জনতার ভীড়ে মিশে একাকার হোন কমলা। সবারই যে একটাই চাওয়া, বাঁচতে চাই ,আমিও মানুষ ।  

কমলাকে তার মা একটি রুমাল দিয়েছিলেন কাঁদানে গ্যাস থেকে বাঁচতে । কিন্তু শাসক চালিয়েছিলো গুলি! তাও হয়তো বাঁচতেন কমলা, কিন্তু বোন মঙ্গলাও যে ওখানেই! লড়াইটা তো একজনের ছিলো না, সবাই যে সেদিন  রণাঙ্গনে, বোনের আর্তচিৎকারে  আবার ফিরে গিয়েছিলেন কমলা, বোনকে বাঁচাতে।  মাথায় গুলিবিদ্ধ হোন  কমলা। মারা যান কমলা, ভীষণ বাঁচার ইচ্ছে নিয়েও বাঁচতে পারেননি তিনি। কারণ অন্য কোনো জাতির অন্য কারোর দরকার ছিলো নিজের সন্তানদের অধিকতর দুধেভাতে রাখার নিশ্চিত বন্দোবস্তটি করা।

কমলা সহ সেদিন যে এগারো জন বাঙালি মারা গিয়েছিলেন তাদের মৃত্যুর কারন ছিলো এটাই যে তারা তাদের মাতৃভাষার অধিকার চেয়েছিলেন। তারা চেয়েছিলেন তাদের নিজের দেশে যেন তাদের অন্যের ভাষায় পড়তে, শিখতে বা কাজ করতে বাধ্য করে জন্মগত ভাবেই পিছিয়ে  দেওয়া না হয়, যেমনটা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিলো তাদের পূর্বজদের বিগত সহস্রাব্দ জুড়ে তাদেরই দেশে; কখনো সংষ্কৃত , কখনো ফার্সী কখনো ইঙ্গরেজীকে একমাত্র কার্যকর ভাষা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য করে। অর্থাৎ বিবাদটা ছিলো ভাষা নিয়ে।

ভাষা, মানুষের যোগাযোগের প্রাচীনতম মাধ্যম, প্রাচীন যুগের মানুষের দলবদ্ধ পশু শিকারের সময় থেকে আধুনিকতম স্থাপত্যে আকাশ ছোঁয়ার জন্যে মানুষকে সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতে হয়েছে এই ভাষার উপরই, এই ভাষাই উত্তর আর দক্ষিণকে একত্র করেছে এক দিগন্তে,  আর ভাষার বিকাশের সাথে সাথেই ভাষা মাধ্যম হয়েছে বিবাদেরও । মাধ্যম হয়েছে জাতিগত দমনের। এক জাতি অন্য জাতিকে অবদমিত করতে ,সবল দুর্বলকে নিয়ন্ত্রণ করতে , সাম্রাজ্যবাদী তার সাম্রাজ্যকে ছড়িয়ে দিতে বারবার সবচেয়ে সুচতুর ব্যবহারটি করেছে যে মাধ্যমের তার নাম ভাষা। আর তাই কোনো ভাষা যেমন আজ বিশ্বে হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য ও সার্বজনীন , ঠিক তেমনি কালের স্রোতে হারিয়েও গিয়েছে অনেক ভাষা ।
কিন্তু আজকের বিশ্বের ৪২০০টি ভাষার মাঝে আর কোনো ভাষাকে কি বাংলার মত এতোবার রক্ত ঝরিয়ে নিজের অস্তিত্ব বাঁচাতে হয়েছে? আর কোন ভাষা কি এতো ভয়াবহ অবদমনের শিকার হয়েছে? সহস্র বছর ধরে ধুর্ত কৌশলীদের শত প্রচেষ্টার সাথে লড়ে বাঁচতে হয়েছে কি আর কোনো ভাষাকে? 
উত্তরটি স্পষ্ট। না,আর কোন ভাষাকে বাংলার মত এতো বার রক্ত দিতে হয়নি। আর কোনো ভাষাকে এতো বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নের মতো সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি শুধু নিজ সন্তানদের জাতিগত পরিচয়কে টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু সেই রক্তাক্ত শতাব্দী প্রাচীণ সংগ্রাম সম্পর্কে কি আদৌ কিছু জানে আজকের প্রজন্ম? আছে কি বিন্দুমাত্র সচেতনতা? আজকের লেখা সেই রক্তাত অতীতকে স্মরণ করিয়ে দিতে আর কিছুটা বর্তমানের বাস্তবতায় কোথায় আছে বাংলার অবস্থানগত পরিস্থিতি তা ভেবে দেখতেই লিখা।

ভাষা হিসেবে বাংলার অবদমনের ইতিহাসও বাঙালির অবদমিত হওয়ার ইতিহাসেরই সমান্তরাল। যুগ যুগ ধরে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারতবর্ষের উর্বরতর এই বঙ্গভূমি লক্ষ্যবস্তু ছিল প্রতিটি সাম্রাজ্যবাদি জাতির। সেই প্রাচীণ হিন্দু শাসকদের  শাসনামল হয়ে মধ্যযুগের সুলতানি আমল, তৎপরবর্তী মোঘল আমল , তারপর আধুনিক যুগে ইঙ্গরেজ আমল, সর্বশেষ এই বাংলায় পাকিস্তান আমল আর ওই পাড়ে  ভারতের লোকতান্ত্রিক  শাসনামলে বাংলাকে লড়তে হয়েছে কখনো তারই উৎস ভাষা সংষ্কৃতের সাথে তো কখনো দূর প্রাচ্যের আরবী বা ফার্সীর সাথে , কখনো আবার সুদূর ইউরোপের ইঙ্গরেজীর সাথে ,  প্রাকৃতিক ভাষাগুলির সাথে যেমন লড়াই করে টিকতে হয়েছে বাংলাকে, ঠিক তেমনি লড়তে হয়েছে উর্দুর মতো কৃত্রিম ভাষার সাথেও।

ভাষাগত কারণে একটি জাতিকে বিভিন্ন সঙ্কটের মুখে পড়তে হয়, যেমন  রাজনৈতিক , প্রশাসনিক, ধর্মীয় ইত্যাদি। এর প্রতিটিই একটি জাতির স্বাভাবিক অগ্রগতির অন্তরায় ও আত্মপরিচয় গড়ে তোলার মত বিকাশের পথে বাধা।
যেমনটি ঘটেছিলো বাঙালির ধর্মীয় জীবনেও। এক সময় যখন এখানে মুল জনগোষ্ঠী  ছিলো সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তখনো উত্তর ভারত থেকে আগত শাসক হিন্দু নৃপতিরা এই বাঙালির সাথে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি করতেই সংষ্কৃতকে করেছিলো ধর্মচর্চার ভাষা, আর ধর্মচর্চায় বাংলা হয়েছিলো অপাঙ্কতেয়। এভাবেই ধর্মের জায়গাটিতে দ্বি-তরবারি নীতির প্রতিস্থাপন করিয়ে শাসক রাজারা চেয়েছিলো জনসাধারণকে ক্ষমতার অক্ষ থেকে চিরবিচ্যুত করে দিতে আর উত্তরাধিকার ও রাজতন্ত্রকে চিরপ্রতিষ্ঠিত করতে। সে সেন বংশের সময়ের কথা, ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে যখন সমাজে  কৌলীণ্য প্রথা এনে অভিজাত আর অনভিজাতের বিভাজন টানা হয়েছিলো, সে বিভাজনে আলাদা হয়েছিল সব , বসার জায়গা খাওয়ার জল থেকে চলার পথও যখন আলাদা হয় , মুখের ভাষাও তখন আলাদা হতে দেরী হয়নি। যদিও তা বৃহদার্থে শুধু ধর্মচর্চার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিলো।

তারপর সময়ের পরিক্রমায় শতাব্দী কেটে গেলো। মাঝখানে অবশ্য বাংলা স্থিতিশীল হওার সুযোগ পেয়েছিলো আর পেয়েছিলো বলেই ইঙ্গরেজী সাহিত্যেরও আগে নিজের ভিত্তি গড়ে তুলতে পেরেছিলো বাংলা ভাষা।  
কিন্তু বাংলা ও বাঙালিকে আবারও আক্রান্ত হতে হয়েছিলো , এবার মধ্যপ্রাচ্য আগত লুটেরার অস্ত্র কেড়ে নিলো বাঙালির স্বাধীনতা।  আর তার ঠিক পরের ধাপেই বাঙালিকে আবিষ্কার করতে হলো তারই বাংলায় এখন প্রশাসনিক , দাফতরিক বা নৈমিত্তিক যেকোনো কাজে বাংলাই অচল বলে গণ্য হবে। এটাই স্বাভাবিক , দখলদার সব সময় নিজের ভাষাকেই দখলকৃত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় আর এবারে তাই সুলতানী আমলের শাসকদের দ্বারা বাংলায় আবির্ভাব ঘটলো আরবী ও ফার্সী ভাষার, বিশেষত রাজকার্য বা প্রশাসনিক কার্যে। আবারও তাই নিজভূমে পরবাসী হল বাঙ্গালি, তারই দেশে সে অযোগ্য হয়ে উঠলো দেশ পরিচালনায় , এমনকি নিজেরই গৃহে ভৃত্য হওয়ার যোগ্যতাও হারাতে হলো বাঙালিকে।  
এভাবেই ভাষাগত জায়গায় নিয়ন্ত্রক ভাষার অর্থাৎ যাকে কিনা বলে রাষ্ট্র ভাষা তার অবস্থান হারাতে হয়েছে বাংলাকে বারবার , এই বঙ্গেই। সুলতানি আমলের পর মোঘল আমলেও তদ্রুপ। তারপর ব্রিটিশ আমলে এসে সার্বজনিন দাফতরিক ভাষা হলো ইঙ্গরেজি। বাঙালিকে আবারও জানতে হলো তার এতো দিনে অর্জিত ভাষাজ্ঞান মূল্যহীন। তাকে নতুন করে শিখতে হবে  ইংরেজি   ভাষা, নইলে জুটবে না কাজ, সন্তুষ্ট হবে না ব্রিটিশ রাজ। এবারেও ভাষার বিভেদে বাঙালিকে বিভক্ত হতে হয়েছে, দীর্ঘদিনের মুসলিম শাসনকে আপন করে নেওয়া  বাঙ্গালি মুসলিম জনগোষ্ঠী মেনে নিতে পারেনি ইঙ্গরেজি শিক্ষা, যার ফলে বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠী বিশ্বজনীন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় এত বাজে ভাবে যার ফলে আজও বাঙ্গালি হিন্দুর তুলনায় বাঙ্গালি মুসলমান জনগোষ্ঠী শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে অনেক জায়গায় , অথচ  এমনটা হওয়ার কথা ছিলো না, নির্দিষ্ট একটি ভাষা না জানায় কেউ পিছিয়ে থাকতে হওয়ার কথা না , পিছিয়ে থাকতে বাধ্য হওয়াটা স্বাভাবিক না। শুধুমাত্র একটি ভাষা শিখতে পারা না পারার কারণে একই জাতির দুটি অংশে পরিনত হওয়া বা বড় ধরণের পার্থক্যের শিকার হওয়াটাও স্বাভাবিক নয়, তাই আজ যখন বাঙালি মুসলিমের ব্রিটিশ আমলে দীর্ঘদিন অনগ্রসর থাকার কারন অনুসন্ধানে  গিয়ে এই আলাপ তোলা হয় যে বাঙ্গালি মুসলিম ইঙ্গরেজীর প্রতি অনীহার নিজস্ব দায়ে পিছিয়ে ছিলো এতগুলো বছর তখন প্রকৃত সমস্যার শিকড়টি উহ্য থেকে যায় যে বাঙ্গালি তখন মূলত বঞ্চিত ছিল নিজের মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহন ও দাফতরিক কাজ করতে পারার সুযোগটি থেকেই।

লক্ষ্য রাখতে হবে প্রায়  আটশো বছর ধরে একটি বিপুল অঞ্চল ও পৃথিবীর জনসংখ্যার বিপুলতর এ জনগোষ্ঠীটিকে বঞ্চিত হতে হয়েছে তারই নিজ অঞ্চল নিজ ভাষায় পরিচালনা করার সুযোগ থেকে, বঞ্চিত হতে হয়েছে তার সন্তানদের, নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে। ফলে এই জাতি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পেলো কেবল কৃষক আর কায়িক শ্রমিক শ্রেনী, অথচ গড়ে উঠলো না একটি দক্ষ ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজন্ম। অথচ না গড়ে ওঠার কোনো কারণ ছিলো না। কারণ কেবল এই যে একটি জাতিকে এমন ভাবেই দমন করে রাখা হয়েছিলো যাতে তারা কেবল আদর্শ ভৃত্য উৎপাদন করতে পারে এবং নিজস্ব স্বনির্ভরতা সৃষ্টিতে যেনো তাদের সক্ষমতা অর্জিত না হয়।

কিন্তু এই বিপুল সময় ধরে অদম্য প্রাণশক্তিসম্পন্ন এই জাতি চালিয়ে গিয়েছে এক নিরন্তর লড়াই। এই পুরোটা সময়েই বাঙালি এই সুবৃহৎ ভারত ভূমির ইতিহাসের গতিপথের নিয়ন্ত্রক জাতিগুলোর একটি হয়েই থেকেছে। মোগল আমল থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সময় জুড়ে বাঙালি লড়েছে তার আত্মপরিচয় ও স্বাতন্ত্র রক্ষা করে মানুষের জীবন পেয়ে বাঁচতে। বাঙালি লড়েছে কখনো বারো ভুঁইয়া হয়ে, কখনো বাঘা যতীন হয়ে। কখনো প্রাণ দিয়েছে অকুতোভয় ক্ষুদিরাম হয়ে। আর তাই যখন সাম্রাজ্যবাদের অবসানে লোকতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার আগমন ঘটে একটি তুলনামূলক সভ্য বিশ্বব্যবস্থায়, বাঙালি তখন ভেবেছিলো এবার বাঙালিও পাবে একটি শান্ত, স্বাধীন ও সুস্থিত জীবনের অধিকার।  
কিন্তু নবগঠিত দুই রাষ্ট্রেও বাঙালিকে প্রবল বিষ্ময় আর অবিশ্বাস নিয়ে মুখোমুখি হতে হলো এক তীব্র জাতিগত আগ্রাসনের।
দুই নবগঠিত রাষ্ট্র ভারত আর পাকিস্তানে তখন বিভক্ত হয়েছে পুরো বাংলা। বিশ্বের অন্যতম বড় জাতিটিকে বিশ্বে অবিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে গিয়েছিলো ব্রিটিশ জাতি। আর কয়েক খন্ডে বিভক্ত বাঙালিকে পুরোপুরি আত্মপরিচয়হীন করে দিতে তৎপর হয়ে উঠলো তারই স্বদেশি অন্যান্য জাতিসমূহ।
এই চেষ্টা অবশ্য চলমান ছিলো বহুদিন ধরেই। বাঙালি যখন অন্যান্য সব জাতিকে সাথে নিয়ে এগোনোর চেষ্টা করে চলেছিলো সেই সময়েও এমনকি বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে যখন বাঙালিকে প্রথম বার বিভক্ত করে দেওয়া হয় তখনই বাঙালি আবিষ্কার করেছে তার একমাত্র প্রতিপক্ষ কেবল সাম্রাজ্যবাদীরাই নই, বরং সুযোগ পেলে চেহারা বদলে ফেলতে দ্বিধা করে না তারাও যাদের নিয়ে একসাথে বাঁচার লড়াই করতে চায় বাঙালি। যেমনটা ঘটেছিলো মানভূমে।
 হ্যা, যখন বঙ্গভঙ্গ হয় তখন বিহারের সাথে পড়ে যায় বাংলার আপাতক্ষুদ্র কিন্তু তবুও বেশ বড় একটি অংশ,  মানভূম।
এই মানভূমে পৃথিবীর ইতিহাসের দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন হয়েছিলো। ১৯১২ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত।
 মানভূম বর্তমান পুরুলিয়া জেলা, যা বক্সারের যুদ্ধের পরে বিহারের অন্তর্গত হয় , বঙ্গভঙ্গের সময়ও একে বিহারে রাখা হয় জনতার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও। অর্থাৎ বাঙালিকে দুটি নয় তিনটি ভাগ করা হয়েছে সে সময়ে।
ভারতের স্বাধীনতার পরে এই আন্দোলন বেগবান হয় কারণ তৎকালীন বিহার সরকার হিন্দীকে স্কুল শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম করে তোলার জন্যে ঘোষণা দেয়। এর ফলে প্রবল আপত্তি সৃষ্টি হয় এবং বাঙালিরা নিজস্ব প্রাথমিক স্কুল খোলা শুরু করে। কিন্তু বিহার সরকার তাতেও বাধা দেয়। বাংলাকে দ্বিতীয় শ্রেণীর ভাষার কাতারে ফেলে দেওয়ার ও অপাঙ্কতেয় করতে চাওয়ার এই রাজনৈতিক চেষ্টার বিরুদ্ধে তখন বাঙালি গড়ে তুলেছিলো কঠোর আন্দোলন।
যে আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত হাজারো বাঙালিকে জেলে অন্তরীণ করা হয়। এ সময়কালটা ছিলো মানভূম ভাষা আন্দোলনের প্রথম ধাপ।
দ্বিতীয় ধাপের হাল জোয়াল আন্দোলনটি গড়ে উঠে যখন বিহার সরকার বাঙালিদের কাছে হাল জোয়াল ইত্যাদি কৃষি উপকরন বিক্রি বন্ধ করে দেয়। এ সময়ে বাঙালিরা নিজ উদ্যোগে প্রকাশ্যে এসব পণ্য বিক্রি করা শুরু করেছিলো। প্রবল অসহযোগের বিরুদ্ধে, একঘরে করে দিতে চাওয়া হচ্ছে এমন একটি জাতির স্বনির্ভরতার লড়াই ছিলো মানভূম আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপ এই হাল জোয়াল আন্দোলন।
 আন্দোলনের তৃতীয় ধাপে টুসু সত্যাগ্রহ আন্দোলন  হয় টুসু গানকে উপজীব্য করে। নানান টুসু গান ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং টুসু গান গাওয়ার অপরাধে বাঙালিদের বন্দীও হতে হয়। ব্যাপক নিপীড়নের শিকার হতে হয় বাঙালিদের এ সময়ে , শিকার হতে হয় হামলা , মামলা ও অপপ্রচারের।
মানভূম আন্দোলনের শেষ ধাপটি ছিলো  পদযাত্রা আন্দোলন। এই পদযাত্রা আন্দোলনের প্রাণশক্তি ছিলো রবীন্দ্রনাথের "বাংলার মাটি বাংলার জল" গানটি। যা আন্দোলনরত বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী ঐক্যকে সংহত ও উজ্জীবিত করতে ব্যবহৃত বাংলা গানগুলোর মুখপত্র হয়ে উঠেছিলো।
এ বিষয়গুলো তৎকালীন পাকিস্তান সরকারকেও উদ্বিগ্ন করেছিলো, যার জেরে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ ছড়াতে পারে এমন আশঙ্কায়ই পাকিস্তানের সংষ্কৃতির সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ নয় দোহাই তুলে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানেও।
মানভূম আন্দোলনের এই ধাপে ৯৬৫ জন গ্রেফতার হোন এবং বারো দিন কারাবন্দী থাকেন । এছাড়া এই সময় জুড়ে বাঙালিদের উপর অবর্ননীয় যে আগ্রাসন ও নিপীড়ন চালানো হয় তার ফলে জেলে বন্দী অবস্থায় প্রাণ হারান আন্দোলনকারী একাধিক নেতাও, এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের কার্যালয়ে হামলা ও হস্তক্ষেপ এতো প্রবল ছিলো যে সে সময় মানভূম অঞ্চলের লোকগীতি টুসু গানের বই পর্যন্ত পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যেতো।
তবে এতোকিছুর পরও একাধিক বন্দীর "অন্তরীণ মৃত্যু" ও অধিকার আদায়ে অটল বাঙালিদের দাবীর মুখে, সমাধানকল্পে  গঠিত এক কমিশনের সিদ্ধান্তে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই আগস্ট বাংলা-বিহার সীমান্ত নির্দেশ বিল লোকসভায় ও ২৮শে আগস্ট রাজ্যসভায় পাশ হয়। ১লা সেপ্টেম্বর এতে ভারতের রাষ্ট্রপতি সই করেন। এর ফলে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১লা নভেম্বর ২৪০৭ বর্গ মাইল এলাকার ১১,৬৯,০৯৭ জন মানুষকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নতুন জেলা পুরুলিয়া তৈরী হয়,যদিও সম্পূর্ণ ধানবাদ মহকুমা বিহার রাজ্যে রয়ে যায় অন্য জাতিসমূহের উপস্থিতির বাহানায়, অথচ ধানবাদও বাঙালি অধ্যুষিত মহকুমা ছিলো।
এতো কিছুর পরও অন্তত ১২ লক্ষ বাঙ্গালি পান মাতৃভাষায় পড়াশোনা করার ও দাফতরিক কাজ করার অধিকার, যারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে।
এভাবে প্রবল সংগ্রাম আর নিদারুণ আত্মত্যাগের মাধ্যমে মানভূমে বাঙালি আদায় করতে পেরেছিলো নিজ ভাষার অধিকার।
কিন্তু এসব কিছু যখন চলছিলো ভারতে ঠিক সেই সময়েই এদিকে পাকিস্তানও কিন্তু উত্তপ্ত ছিলো একই "ভাষা সঙ্কটে"।  ১৯৪৭ এ পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরপরই পাকিস্তানের অভিজাত গোষ্ঠী চেয়েছিলো পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হোক অভিজাতের ভাষা হিসেবে চিহ্নিত উর্দু ভাষা। তারা এটিকেই পাকিস্তানের লিঙ্গুয়া জিরাল (সাধারণ ভাষা;বহু ভাষাভাষী অঞ্চলে সর্বজনগ্রাহ্য ভাষা) হিসাবে আখ্যায়িত করতে চায় অথচ লিঙ্গুয়া জিরাল হওয়ার অন্যান্য যোগ্যতা থাকা তো দূর উর্দু এমন কি কোনো মৌলিক ভাষাও ছিলো না।
মূলত উর্দুকে  অভিজাতরা যতোটা না নিজের সুবিধার জন্যে রাষ্ট্র ভাষা করতে চেয়েছিল তার চেয়ে বেশি চেয়েছিল বাঙালি ও পাঞ্জাবি জাতির সাধারণ জনগণকে মূলধারা থেকে বিচ্যুত করার উদ্দেশ্যে।  ভারত ও পাকিস্তান এই দুই রাষ্ট্রের স্বাধীনতায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিলো এই দুই জাতিরই, আর তাই অভিজাতদের শঙ্কা ছিলো নবগঠিত রাষ্ট্রের চালিকাশক্তিতে পরিণত হতে পারে এই দুই জাতি৷ তাই শুরুতেই এদের শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যাদিতে পিছিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যেই সর্বাগ্রে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় তাদের ভাষাগত অবস্থানকে।
এই বৈষম্য'র বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রগতিশীল বাঙালিরা প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিলেন সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই। পাকিস্তানের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই বাঙালি জাতি তার ভাষার ন্যায্য অধিকারের জন্যে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলেন, যা ধাপে ধাপে গড়ায় ১৯৫২ এর চূড়ান্ত ভাষা আন্দোলনের দিকে।
অর্থাৎ বোঝাই যায়, ৫২ শুরু ছিলো না, ৫২ শেষও ছিলো না, ৫২ ছিলো সারা ভারতবর্ষে বাঙালির বিরুদ্ধে চলমান ভাষাগত দমনের বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধে অর্জিত এক স্বর্ণমধ্যক।  
১৯৫২তে পৃথিবী অবাক হয়ে দেখলো এই পৃথিবীর বুকেই একটি জাতির মানুষদের খুন হয়ে যেতে হচ্ছে কেবল এই কারণে যে তারা তাদের নিজের ভাষায় কথা বলার, শিক্ষার ও কাজ করার অধিকারটুকু চাচ্ছেন!
৫২'র ফাগুনের সেই অষ্টম দিনে ঠিক কতজনকে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি করে মেরেছিলো তা আজ আর নিশ্চিত ভাবে জানা সম্ভব নয়। জানার কোনো সুযোগ শাসকগোষ্ঠী রাখেনি৷ কিন্তু পাওয়া গিয়েছিলো আট জন বাঙালির মৃতদেহ। যাদের মৃতদেহ সিঁড়ি হয়ে উঠেছিলো বাংলা ভাষার নিজস্ব অবস্থানে পৌঁছার। তবে ধারণা করা, হয় সেদিন অন্তত পঁচিশ থেকে চল্লিশ জন বাঙালিকে প্রাণ হারাতে হয়েছিলো পুলিশের গুলিতে৷ এছাড়াও আহত শতাধিক ব্যক্তির মাঝে কতজন পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন সে হিসাবও নেই কোনোখানে। মুছে দেওয়া হয়েছে সুকৌশলে।  
একুশে ফেব্রুয়ারীই শুধু নয় তার পরদিন বাইশে ফেব্রুয়ারীতেও চলমান আন্দোলন দমনে পুলিশি গুলি ও বেপরোয়া ট্রাকের আঘাতে প্রাণ হারান একাধিক বাঙালি, তাদের সংখ্যাও আজও অজানা।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২১ পথ দেখিয়েছিলো, ২১ একটি নিরন্তর সংগ্রামে আত্মবলিদান  ও অধিকার আদায়ের উভয় ক্ষেত্রেই প্রথম প্রভাত এনেছিলো পরবর্তীর জন্যে।

যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই একই সমসাময়িকে ভারতের উত্তর পূর্বে বাঙালির আরেক আবাসন, আসামের বরাক উপত্যকায় বাঙালির উপর ও বাংলা ভাষার উপর অহমিয়া জাতি কর্তৃক চলমান জাতিগত আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায়।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আসাম প্রদেশ ছিলো অত্যন্ত অনগ্রসর অঞ্চল প্রাচীন কাল থেকেই। ব্রিটিশ আমলে প্রগতিশীল বাঙালির সর্বব্যপী পদচারণার স্পর্শ পড়েছিলো আসামেও। ব্রিটিশ রাজের প্রয়োজন ছিলো নিজ রাজ্যের বিস্তারে সার্বিক উন্নয়নে সাম্রাজ্যের প্রতিটি অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করা, আর বাঙালির প্রয়োজন ছিলো নিজ ভাগ্য বদলের তাগিদে প্রতিটি পাথর উলটে দেখা।
এই যুগল প্রয়োজনীয়তার তাগিদেই ব্রিটিশের উন্নয়ন কর্মকান্ড এগিয়ে নিতে আসামে অভিবাসন ঘটে বিপুল সংখ্যক বাঙালির, এছাড়াও সুরমা তীরবর্তী শ্রীহট্টমন্ডলীতেও বিস্তার ঘটেছিলো বাঙালি জাতির, সে অবশ্য হাজার বছর আগের কথা।  
অর্থাৎ আসামের উত্তর-পূর্বতম প্রান্তটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হয়ে উঠেছিলো বাঙালির কর্ষিত ক্ষেত্র এবং তা নগরায়ন ও আধুনিকায়নের ছোঁয়াও পায় বাঙালির অক্লান্ত প্রচেষ্টাতেই। কিন্তু ভারত স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই স্থানীয় অহমিয়া জনগোষ্ঠীর কাছথেকে বাঙালি পেলো প্রবল অসহযোগ, বাঙালি আবিষ্কার করলো তারই হাতে গড়ে ওঠা প্রদেশটিতে অহমিয়া জাতি একমাত্র ভাষা করে তুলতে চায় তাদের নিজস্ব অহমিয়া ভাষাকে। উল্লেখ্য বাঙালিরা নিজ অধ্যুষিত অঞ্চলেও কখনো বাংলাকে কিন্তু একমাত্র ভাষা করার দাবী জানায়নি কোনো কালেই, পশ্চিমবঙ্গ বা পূর্ববঙ্গেও নয়। একচ্ছত্র আধিপত্যের প্রচেষ্টা বা সর্বোপরি আধিপত্যবাদ জিনিসটিই আবহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীত বলেই বাঙালি কখনো এমন চেষ্টা করেনি। বাঙালির চেষ্টা ছিলো সবাইকে নিয়ে বৃহত্তর এক জনপদ সৃষ্টির৷ অথচ একই আন্তরিকতা বাঙালি কখনোই তার কোনো প্রতিবেশির কাছেই পায়নি, আসামেও বাঙালি মুখোমুখি হলো এক প্রবল জাতিগত আগ্রাসনের।
যে আগ্রাসনের আঘাত কখনো ছিলো সশস্ত্র, কখনো বা  হাতের জায়গায় ভাতে মারার নীতিতেও পিছপা হচ্ছিলো না আগ্রাসনকারীরা। সে সময়ে কতো বাঙালিকে জাতিবিদ্বেষ উদ্ভুত চোরাগোপ্তা হামলার শিকার হতে হয়েছে তার হিসাব কেউ রাখেনি, প্রান হারিয়েছেন অসংখ্য বাঙালি।
কিন্তু বড় ধরণের আঘাতটা এলো দিনশেষে এই ভাষাকে কেন্দ্র করেই।
১৯৬০ সালে বরাকে অহমীয়াকে একমাত্র দাফতরিক ভাষা ঘোষণার প্রতিবাদের কারণে অহমিয়া জাতিগোষ্ঠীর আক্রমণে পঞ্চাশ হাজার বাঙালি   বাস্তুচ্যুত হয়। পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় তারা। আরো নব্বই হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় নিরাপদতর এলাকায় যাওয়ার জন্যে, তারা বরাক উপত্যকা থেকে অন্যান্য তুলনামূলক নিরাপদ এলাকায় পরিযায়ন করে, অনেকে ত্রিপুরাও চলে যায়।
পরবর্তীতে গঠিত তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে দেখা যায় সে সময়ে কেবল একটি জেলার (কামরুপ) ২৫টি গ্রামেই সহিংসতায় ৪০১৯টী কুড়েঘর ও ৫৮টী বাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়!
০৯ জন বাঙালিকে হত্যা করা হয় সেই গণহত্যায়। এই প্রবল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে  প্রতিবাদী দীর্ঘমেয়াদী সত্যাগ্রহ ও লংমার্চ চলমান থাকাবস্থায় আন্দোলনের নেতৃত্ব দানকারী বাঙালি নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। খেয়াল রাখতে হবে সময়টি ১৯৬০, এদিকে কেবলই আট বছর আগেই পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার চেষ্টা করেছে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীকে ভাষাগত ভাবে দমন করার, এবং বাংলা ব্যতীত অন্য ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করার, আর ওদিকে ভারতে আসাম সরকার চেষ্টা করলো অহমীয়াকে আসামে একমাত্র সরকারী ভাষা করার এবং ব্যাপক প্রতিবাদের মুখেও সেই সিদ্ধান্ত তারা কার্যকর করে ছাড়লো ১৯৬০ সালে।
এর বিরুদ্ধে চলমান বাঙালিদের আন্দোলনে ১৯৬১ সালের ১৯মে এক  প্রতিবাদী মিছিলে পুলিশ সারা শহর ব্যাপী গুলি করে মোট এগারো জনকে হত্যা করে। এই আলোচনার শুরুতে যে কমলা ভট্টাচার্য্যের কথা বলা হয়েছিলো সেদিনের শহীদদের একজন ছিলেন তিনিও, পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারানো কমলা ভট্টাচার্যই প্রথম বাঙালি নারী ভাষাশহীদ।
সেদিনের সেই এগারো জন বাঙালির মৃত্যু অবশ্য এই বার্তা ছুড়ে দিয়েছিলো যে, যে জাতি নিজ ভাষার অধিকারের জন্যে এগারোটি প্রাণ অবলীলায় দিতে পারে, ভাষাগত দমনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে সে আরো সহস্র প্রাণ দিতেও দ্বিধা করবে না। আর নিঃসন্দেহে এই পৃথিবীতে তারচেয়ে দুর্জেয় আর কেউ নেই যে প্রাণ দিতে দ্বিধা করে না! তাই তো ১৯৬১ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর আসাম মন্ত্রিসভা, শাস্ত্রী সূত্র অনুসরণ করে সরকারি ভাষা আইনের খসড়া সংশোধনী বিলের অনুমোদন দেয়। ১৯৬১ সালের ৭ অক্টোবর বিধানসভায় বিলটি পাস হয়।
আসাম সরকারী ভাষা (সংশোধিত) আইন, ১৯৬১ এর মাধ্যমে মূল আইনের ৫ম ধারা সংশোধন করে বাংলা ভাষাকে কাছাড় জেলার (বরাক উপত্যকা মূলত) সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ৫ম অনুচ্ছেদের সংক্ষিপ্ত সংশোধনীতে বলা হয়েছে যে:
“ "জেলা স্তরকে আচ্ছাদন করে ৩ নং ধারার বিধানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই কাছাড় জেলার প্রশাসনিক ও অন্যান্য সরকারি অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হবে। "
অবশ্য আসামে বাঙালির সংগ্রাম ও বলিদানের সমাপ্তি এতেও ঘটেনি।
এরপরও নিহত হয়েছেন বিজন চক্রবর্তী, ১৯৭২ সালে ১৭ অগাস্ট সেবা সার্কুলার প্রত্যাহারের দাবীতে সংগঠিত ভাষা আন্দোলনে।  
১৯৮৬ সালের ২১শে জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বাংলা ভাষায় পড়তে চাওয়ায় হত্যা করা হয় করিমগঞ্জের জগন্ময় দেব এবং দিব্যেন্দু দাসকে।

এভাবেই রক্তের গন্ধ মাখা ইতিহাসের প্রতিটি পাতা উলটে উলটে আমরা বাঙালির ইতিহাসের আজকের পাতা পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছি।
যে ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে বাঙালিকে রুঢ়তম আঘাতগুলোর শিকার হতে হয়েছে বারংবার, যে বাঙালি জাতি সবাইকে নিয়ে এগোনোর স্বপ্ন দেখেছে তাকেই বারবার আঘাত পেতে হয়েছে, রক্ত দিয়ে দিয়ে বহু রক্তের বিনিময়ে বাঙালিকে আদায় করে নিতে হয়েছে তার ন্যুনতম অধিকার।

তাই বহু রক্তে ও তিতিক্ষায় অর্জিত এই ভাষাটি আজ বাঙালির সবচেয়ে বড় পরিচয়। বাঙালির পরিচয়ের সবচেয়ে বড় স্মারক বাংলা ভাষা আজ কেবল বাঙালিরই নিজস্ব পরিচয় নয়, বরং বাংলা আজ সেই সমস্ত ভাষাভাষীর পরিচয় যারা বিশ্বের কোথাও না কোথাও কখনো না কখনো অবদমনের শিকার,  কোথাও না কোথাও শিকার আগ্রাসনের। তাই তো, যে পাকিস্তানের উর্দুর সাথে লড়ে নিজের অধিকার আদায় করতে হয়েছে বাংলাকে, ৫২'র ২১ ফেব্রুয়ারিতে যে পাকিস্তানের শাসকদের কাছেই ভাষার মূল্য হিসেবে দিতে হয়েছে তপ্ত তাজা রক্ত, আজ সেই পাকিস্তানেও আয়োজিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, আর কেবল তাই নয়, আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পাকিস্তানেও পাঞ্জাবি, পশতুন সহ বিভিন্ন ভাষাভাষীর কাছে আওয়াজ তোলার উপলক্ষ হয়ে ওঠে তাদের ভাষাগত অধিকার রক্ষার। সে জন্যেই তো আজ পাকিস্তানে উর্দুর পাশাপাশি পাঞ্জাবীকেও রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে লড়তে থাকা পাঞ্জাবী জাতিগোষ্ঠীর জন্যেও ২১শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানে নিজেদের অধিকারের পক্ষে আওয়াজ তোলার অন্যতম উপলক্ষ হয়ে আসে।

বাংলা তাই দিনশেষে শুধু একটি মুখের ভাষা হয়ে রয় না, বাংলা হয়ে ওঠে দ্রোহ ও প্রেমের তীব্রতম সংযুক্তির মাধ্যম, বাংলা হয়ে ওঠে এক নিরন্তর যুদ্ধে হার না মানার প্রত্যয়, বাংলা হয়ে ওঠে আত্মপরিচয়ের জন্যে সংশপ্তক হয়ে লড়ার চিরন্তন অনুপ্রেরণা।

কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায় আজও বাংলা কী নিরাপদ?
পূর্বজদের আত্মবলিদানের ফলে আজ আমরা যে ভাষার পূর্ণ অধিকার পেয়েছি তা আমাদের হাতে কতোটা রক্ষিত? 
এর উত্তরে কিছুটা শঙ্কিত হতে হবে আজকের বাস্তবতায় অবশ্যই।
স্থায়ী বাঙালি আবাসন অঞ্চল এই বিশ্বে মূলত আজ পর্যন্ত চারটি জায়গায় রয়েছে বৃহত্তর অর্থে; বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, ত্রিপুরা রাজ্য ও আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকা। আর এর বাইরে যুক্তরাজ্য সহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলেও ষাটের দশকের পর থেকে ব্যাপক বাঙালি অভিবাসনের ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাঙালি অঞ্চল গড়ে ওঠার একটি আশাব্যঞ্জক প্রবণতা দেখা দিয়েছে।
কিন্তু এই প্রতিটি অঞ্চলেই আজ বাংলা কোনো না কোনো হুমকির সম্মুখীন। যে বরাক উপত্যকায় বাংলার অধিকার পাওয়ার জন্যে মাত্র ষাট বছর আগে এতো বাঙালিকে প্রাণ দিতে হয়েছে আসামের সেই বরাক উপত্যকায় আজ বহু বাঙালি তরুণই বাংলা বলতে জানলেও পড়তে জানেন না! হ্যা, অবিশ্বাস্য শোনালেও এটি দূঃখজনক বাস্তবতা। ভারতীয় আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় ইংলিশ মিডিয়াম অধ্যয়নের প্রবণতা ভীষণ প্রসার পাওয়ার ফলে বরাকের আজকের প্রজন্মের বহু তরুণেরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন হয় ইংরেজি মাধ্যমে, এই তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ বাংলায় কথা বলতে জানলেও প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা না থাকায় বাংলা পড়তে পারেন না স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে।
অপর দিকে ভারতেরই পশ্চিমবঙ্গে চিত্রটি আরেকটু ভিন্ন। ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেই অবস্থিত ভারতের অন্যতম প্রাচীণ রাজধানী শহর কলকাতা, যা আজ একটি কসমোপলিটান নগরী৷ জীবিকা ও কর্মসংস্থানের বৈচিত্র্য এই শহরে নিয়ে আসে ভারতের হিন্দিভাষী অঞ্চলের বিপুল পরিযায়ী শ্রমিককে। আর তারা সঙ্গে নিয়ে আসেন হিন্দী ভাষাও। দূঃখজনক ভাবে বাঙালির ভাষাগত দক্ষতা জাতিগত ভাবেই চমৎকার,  যে কারণে অন্যান্য ভাষাভাষীরা যেখানে নিজের ভাষার বাইরে অন্য একটি ভাষা শিখতেও হিমশিম খান সেখানে সকল অঞ্চলের বাঙালিই নিদেন পক্ষে তিনটি ভাষায় দক্ষতা রাখেন। আর এই দক্ষতার সাথে অশোভনীয় উদারতার যোগফলেই হয়তো আজ কলকাতায়ও বাংলার চেয়ে হিন্দী বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা বাঙালির সংখ্যা দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে। তাই কলকাতায় এখন দোকানপাট বা সাধারণ সেবাসমূহে গ্রাহক ও সেবাদাতাদের অধিকাংশ আলাপনই সম্পন্ন হচ্ছে হিন্দীতে। আপাতভাবে কলকাতার বাঙালির একাংশের এই প্রবণতা মূলত এক ধরণের নিরুপায় পরিস্থিতির কারণেও যে উদ্ভুত নয় তা বলা যায় না। কেননা ভারতে বর্তমানে বিভিন্ন জাতীয় পর্যায়ে সেবাদানকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় সবকটির মালিকানা হিন্দীভাষী জাতিসত্ত্বার ব্যক্তিদের, এসব প্রতিষ্ঠানের সেবা পেতেও তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে ওঠে হিন্দী।  এছাড়া তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন সেবামূলক পেশায় নিয়োজিত তরুণদেরও ভিন্নভাষীদের সাথে আলাপনে সহজ-সম্পন্নতার স্বার্থে হিন্দীকে গ্রহণ না করে উপায় থাকে না।
অর্থাৎ দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পর বাংলা যদিও তার প্রাতিষ্ঠানিক অধিকার পেয়েছে কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে আজ তাকে অন্যান্য ভাষার সাথে নিজ ভাষাভাষী অঞ্চলেরই কিছু কিছু  স্থানে পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে, যদিও আমরা যদি দক্ষিণ ভারতের তামিল ভাষাভাষীদের পূর্বতর সংগ্রাম ও তৎপ্রেক্ষিতে তাদের ভাষাগত ব্যবহারের ক্ষেত্রে বর্তমান আপোষহীন অবস্থান দেখি সে ক্ষেত্রে বাংলার এই পিছিয়ে পড়ার দায় একান্ত ভাবে আমাদের নিজেদের জাতীয়তাবোধ-হীন  অবিমৃষ্যকারীতাকেই দিতে হয়। আজও দক্ষিণ ভারতীয়রা নিজ অঞ্চলে নিজ মাতৃভাষা ব্যতীত অন্য ভাষায় কথা বলেন না। এটি কোনো ধরণের সংকীর্ণতা নয়, বরং এটি করেন বলেই আজও তাদের অঞ্চলের কর্মক্ষেত্রে সর্বাধিক অগ্রাধিকার তারাই পান, আর পক্ষান্তরে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বঙ্গ অঞ্চলেও অর্ধ কোটি বাঙালি কর্মহীনতায় নিম্নতর জীবন কাটাতে বাধ্য হোন। এ দায় কি বাঙালির নিজের নয়?
অভিবাসী বাঙালিদের ক্ষেত্রে আশঙ্কার আরেকটি চিত্র সম্প্রতি উঠে এসেছে  যুক্তরাজ্য প্রবাসী  বাঙালি কথাসাহিত্যিক আলমগীর শাহরিয়ারের লেখনীতে। অতিসম্প্রতি নিজের এক লেখায় তিনি নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণণা করে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন যে অভিবাসী বাঙালিদের বর্তমান প্রজন্ম জীবিকার প্রয়োজনে ইংরেজি শিখতে ও ধর্মীয় কারণে আরবী শিখতে পূর্ণ মনোযোগ দিলেও দিন দিন গ্রহনযোগ্যতা হারাচ্ছে তাদের কাছে তাদের নিজের মাতৃভাষা বাংলা। এমন অভিযোগ আলমগীর শাহরিয়ারের একার নয়, প্রতি প্রজন্মে অভিবাসী বাঙালিদের মধ্যে বাংলার ব্যবহার কমার চিত্রটি বেশ পুরোনো৷ অথচ এই বাঙালিদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে রেলস্টেশন, মেট্রো স্টেশন সমূহে বাংলা দিকনির্দেশিকা ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়েছিলো,বিভিন্ন স্কুলে বাংলাকে সহশিক্ষার মাধ্যম করার আইন হয়েছিলো, এমনকি আদালতেও বাংলা এবং এমনকি বাংলার আঞ্চলিক ভাষা সিলেটিতেও স্বাক্ষ্যপ্রদানকে গ্রহণযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিলো।

আমাদের নিজ দেশে বাংলাদেশে এখনো বাংলা প্রত্যক্ষ আগ্রাসনের শিকার না হলেও নিজস্ব বিনোদন মাধ্যমের অবহেলাজনীত অবক্ষয় ও আকাশ সংষ্কৃতির আগ্রাসনে আজ বাংলাদেশীরাও নিজেদের ভাষার বিনোদন মাধ্যমের স্থানটি দিয়ে বসছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হিন্দীভাষী বিনোদন মাধ্যমকে। দীর্ঘমেয়াদে এমন চর্চা  এটিকে  বাংলা ভাষার বৃহত্তর প্রতিস্থাপনেরই পথ করে দেওয়ার কথা যদি না ভাষাবিজ্ঞান একটি ভ্রান্ত বিজ্ঞান হয়।

এই আলোচনার শুরুতেই এই প্রসঙ্গটি এসেছে যে ভাষা সব সময়ই নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কোনো জাতি এ প্রসঙ্গে সচেতন থাক বা উদাসীন,  নিয়ন্ত্রণ স্থাপনে ভাষার রাজনীতির প্রভাবমুক্ত সে থাকতে পারে না কখনোই। নিজ অস্তিত্বের স্তম্ভসমূহের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদাসীন জাতিসমূহকে বরাবরই ইতিহাস দিয়েছে শোষিতের স্থান, আর তাই আত্মপরিচয়ের উদ্ধত অহঙ্কারে,  স্বকীয় স্বাধীনতায় নিজস্ব বিকাশে পূর্ণতর জীবন পেতে আজ বাঙালিরও নিজের শিকড়ের প্রতি মনোযোগী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প নেই নিজের প্রকৃত পরিচয়কে উপলব্ধি করার, দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে ধরার। বিকল্প নেই বাঙালি জাতীয়তাবাদে জাগ্রত হয়ে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তে নিজ অস্তিত্বের বিশ্বজনীন প্রতিষ্ঠায় গতিময় হওয়ার।
সীমান্ত নির্বিশেষে বিশ্ব-বাঙালির কলতান হোক একটাই - " তুমি কে? আমি কে? বাঙালি, বাঙালি। "
ভাষার মাসে অগণিত পূর্বজের পবিত্র রক্তের স্মরণে এটাই হোক আমাদের চাওয়া।
news24bd.tv/ডিডি