বিশ্ববিদ্যালয় ও একজন মোহাম্মদ আজম

অলংকরণ: কামরুল

কিস্তি-১২

বিশ্ববিদ্যালয় ও একজন মোহাম্মদ আজম

অনলাইন ডেস্ক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অধিকাংশেরই প্রাণের একটা জায়গা।
সবুজ চত্বর, আম চত্বর, অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সার্বক্ষণিক ছেলেমেয়েদের আড্ডা, হাসাহাসি চলে। জীবনের সব থেকে সুন্দর সময় পার করে সবাই এখানে।

চোখে মুখে মুগ্ধতার চশমা, আর বিপত্তি মাড়ানোর জন্য হাঁটুতে থাকে অদম্য লুব্রিকেন্টের শক্তি।

সবুজ চত্বরকে পাহারা দেয়া ইউক্যালিপটাস গাছের শুকনা পাতা থেকে আসা লেবুপাতার গন্ধ মুহূর্তেই ছেলেমেয়েগুলোকে অস্ট্রেলিয়া থেকে ছুটতে পারা পাপুয়া নিউগিনির জলঘেরা মাটিতে নিয়ে ফেলে দেয়। সবুজ চত্বরের ঘাসের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাজনীতি, ক্যারিয়ার, সখ্যকালীন গসিপ এবং প্রেম বিষয়ক আলোচনাগুলো বিলি কেটে কেটে বেড়ায়। এটা অবশ্য প্রথম বর্ষের চিত্র।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষ থেকে শুরু হয় নানামাত্রিক যুদ্ধের প্রস্তুতি। সবুজ চত্বরের বিশ জনের আড্ডা গিয়ে ঠেকে দুই থেকে চারজনের মধ্যে। সবুজ চত্বরে ততোদিনে নতুন প্রথম বর্ষ জায়গা করে নেয়।
বিশজনের মধ্যে দুইজন বাদে বাদবাকি সবার জীবনেই হতাশা নামে। বিশ্ববিদ্যালয় তাদেরকে কী দিলো? পাঁচ বছর যাবত শিক্ষকেরা তাদেরকে যা যা পড়ালেন তার কতোটুকু তারা বাস্তবের সঙ্গে কানেক্ট করতে পারলো? প্রেমে ছ্যাঁকা। রাজনীতিতে ধরা। আশানুরূপ চাকরি না পাওয়া। ইত্যাদি ইত্যাদি।

আরও পড়ুন:ক্ষমা

বাংলা বিভাগের প্রথম ক্লাসটি আমাদের সময় হতো ২০১৭ নম্বর রুমে। ২০১৭-এর বিশাল হলরুমে অনেক ছেলেমেয়ের একসঙ্গে বসে ক্লাস করে। অনেকদিন পর আমি বাংলাদেশের তরুণ চিন্তক তৈমুর রেজার একটা বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলাম রুমটিতে, প্রায় ১৯ বছর পরে। কানায় কানায় পূর্ণ ২০১৭ নম্বর কক্ষটি দেখে মনে পড়লো ২০০৪ সালে অধ্যাপক ফজলুল হক স্যারের কথা। এই রুমেই তিনি বাঙালির নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস পড়াতেন। তৈমুর রেজাও সেদিন কাকতালীয়ভাবে বাঙালি মুসলমানের পরিচয় নিয়ে আলাপ করেছিলেন। এটা কি আদৌও কাকতালীয়? নাকি আমার মিল খুঁজে পাওয়ার দোষ? কে জানে?

আরও পড়ুন : আমার দস্তইয়েভস্কি
বিভাগের এইসব ক্লাসরুমের মধ্যে কোনোপ্রকার বিত্তের ক্লাস ধার্য থাকে না। ভিকারুন্নেছা, নটরডেমের ছেলেমেয়েরা যেমন থাকে তেমনি গ্রামের মিঠাপানির পাড় থেকে উঠে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে এসে বসে পড়ে শিক্ষকদের লেকচার শোনার জন্য। ক্লাসরুমে ক্লাসবিহীন এইসব ছেলেমেয়েদেরকে দেখে মনে হয় বিশ্বজগতের যতো রকম জ্ঞানস্তর আছে তাদের অর্ধেক ধরে ফেলার চেষ্টায় সবাই এক নীরব প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কেউ কেউ মানুষের প্রেমে পড়ে যায়, কেউ কেউ প্রেমের পিছে মুলার টোপের মতো ছুটতে থাকে। কারো কারো প্রেম হয় বইয়ের সাথে। আবার কেউ কেউ তাদের জন্মগত ভাগ্যদেবীর রূপ পরিবর্তনের জন্য দুর্বার সারথি হয়ে ঘুরে বেড়ায় অসাধ্য সাধনায়, পাহাড়-সমুদ্রে। প্রেমে পড়ার বা প্রেমের পেছনে ছোটার অতো সময় থাকে না তাদের হাতে।

আমি প্রথম এখানে আসি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। ভাইয়ার সাথে। একদিন সন্ধ্যার দিকে ভাইয়া আমাকে নিয়ে অপরাজেয় বাংলায় ঘুরতে নিয়ে আসেন। তার কয়েক বছর আগে ছোট খালা এখান থেকে পাশ করে বের হন। ছোট খালা ছিলেন দারুণ পড়ুয়া ছাত্রী। ফলে আমার পড়ালেখার দৌড় দেখে কিছুতেই এখানে ভর্তির আশা করিনি। কিন্তু দৌড়ের গতি শেষমেশ বাড়িয়েই দিলাম। ভুল না করে থাকলে রেজাল্টের পরে সম্ভবত মাত্র দুই মাসের মতো পেয়েছিলাম। একমাত্র ফরম কিনেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। আর কোথাও ভর্তি হতে দেবে না বাসা থেকে। এখানে না হলে ইডেনে।  ইডেনে না হলে সোজা ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ।
ভাইয়ার সঙ্গে ওইদিন আমি আবছা অন্ধকারে তিনটি অপরাজেয় মূর্তিকে নিজের চোখে দেখলাম। এর আগে ছবিতে, স্ক্রিনে দেখেছি। আগেকার খাতার মলাটে অপরাজেয় বাংলার ছবি থাকতো।
এসব খাতায় কতো কতো অংক করেছি!
সেইদিন আমি সেইসব মূর্তিকে চোখের সামনে দেখলাম। ভাবলাম, উরে বাপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,  না জানি কী জিনিস! প্রাচ্যের অক্সফোর্ড মানে বিদেশ! 

আরও পড়ুন: দাঁড়িয়ে আছি মাধ্যাকর্ষণের টানে

অবশেষে এই বিদ্যাপীঠে আমার চান্স হলো। মারাত্মক খুশি হলাম। যেন স্বপ্নে প্রবেশ করলাম। স্বপ্নে প্রবেশ করা মাত্রই দেখলাম বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ দুঃস্বপ্নের মতো বইমেলায় আক্রান্ত হয়েছেন। মনে মনে ভাবলাম আহা, এতো নামকরা শিক্ষকের ক্লাস আমি পাবো না! তখন স্যারের  আক্রান্ত হবার প্রতিবাদে বিভাগের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীরা অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে প্রতিবাদ সমাবেশ করে। ওই প্রথম আমি সরাসরি এ জাতীয় প্রতিবাদ দেখি। এর আগে টিভি ও পেপার পত্রিকায় দেখেছি। তখন বিভাগের বড়ো ভাই বর্তমানে আদর্শ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মাহাবুবুর রাহমানকে দেখি। মাহাবুব ভাই তখন ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। নেতা ও সংগঠক। কিন্তু ওইদিন তাঁর বক্তৃতা শুনে আমি খুবই হতাশ হয়েছিলাম। একজন নেতার বক্তৃতা এমন আস্তে আস্তে হয়।
পরবর্তীতে অবশ্য ভাইয়ার সঙ্গে অনেকবার কথা হয়েছে এবং আমার ভ্রান্তি দূর হয়েছে। মাহাবুব ভাই কথা আস্তে বলতেন ঠিকই কিন্তু যা বলতেন তা ধারণ করার ক্ষমতা অনেকেরই সেই সময় ছিলো না৷ মাহাবুব ভাই ছিলেন হুমায়ুন আজাদের প্রভাবজাত বাংলার সন্তান। কেননা  তখন আজাদ ছিলেন খুবই প্রভাবশালী শিক্ষক। আগামী প্রকাশনীতে তখন তিনি কাজ করতেন।
আফসোস, আমরা তাঁকে পেলাম না! সে আফসোস মিটিয়ে দিতে পেরেছিলেন বিভাগের তরুণ শিক্ষক মোহাম্মদ আজম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরেও পড়ালেখা কী জিনিস সেভাবে বুঝতে শিখিনি। অল্প বিস্তর বুঝতে শুরু করলাম মোহাম্মদ আজমের ক্লাস লেকচার থেকে।

মোহাম্মদ আজমকে আমি প্রথম দেখলাম ২০০৫ সালের দিকে। তখন তিনি সদ্য বাংলা বিভাগে জয়েন করেছেন। কী ভারি, নিরাসক্ত একটা দাড়ি, ভারি চশমা আর বাবরি চুলের মুখ নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন!  বিভাগের শিক্ষক ড. রফিকউল্লাহ খান স্যার আমাদেরকে একবার 'মহাভারত' -এর ভিডিও দেখাবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেখানে আমাদের ইয়ারের সমস্ত শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলো।
হঠাৎ দেখলাম মোহাম্মদ আজম কর্নারের একটা সারিতে বসে আছেন। আমি ভালো চিনতাম না, তবে অনেক গল্প শুনেছি। সতীর্থরা বলাবলি করায় তাঁকে চিনতে পারলাম সেদিন।

আরও পড়ুন: আমার একজন হাড়ে-মজ্জায় শিক্ষক এবং জিনেটিক্যালি খামারি পিতা

তাঁকে যখন দেখলাম তখন একটা অদ্ভুত দৃশ্য মাথায় খেলে গেল। মোটা ভারি চশমা যার ফ্রেম ছিলো পেঁচার চোখের মতো গোল। বাদামী বাদামী একটা ফ্রেমের ভেতর দিয়ে অনেক পাওয়ারের কাঁচ ভেদ করে দেখা যাচ্ছে মোহাম্মদ আজমের দুর্ধর্ষ নেত্রদ্বয়। একদম পেঁচার মতো দূরদর্শী আর নিরাসক্ত। আর ছিলো কাঁধ ছুঁই ছুঁই সিল্কি চুল। আমি ভেবেই পেলাম না এমন একজন মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক? তাও আবার অল্প দিনেই ব্যাপক জনপ্রিয়!

অনেকেই বলে থাকেন জনপ্রিয়তা নাকি তরল ব্যাপার। কিন্তু মোহাম্মদ আজমের ক্ষেত্রে এটা কিছুতেই খাটে না। তিনি তখন জনপ্রিয় কিন্তু কিছুতেই তরল বলা যাবে না তাঁকে। বরং বিরাট বুজুর্গ মানুষ।

ক্লাসে টেবিল চাপড়িয়ে বাবরি চুল দুলিয়ে দুলিয়ে তিনি ছেলেমেয়েদেরকে ইতিহাস পড়াচ্ছেন। দেখার মতোই দৃশ্য। পোশাকেও কোনোপ্রকার আভিজাত্যের ব্যাপার ছিলো না। ইনছাড়া শার্ট পরতেন। আর পায়ে পরতেন বাটার বেল্টওয়ালা একটু উঁচু স্যান্ডেল। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, আমি নিজেও তখন ছেলেদের এইসব জুতা পরতাম। আগে থেকেই পরতাম। এই স্যান্ডেলগুলো হাঁটার ক্ষেত্রে খুব আত্মবিশ্বাস সরবরাহ করে।
আমাদের দুইজনের মধ্যে আপাতত এটাই ছিলো দৃশ্যমান মিল। আর অমিলের কোনো সীমা নাই।

news24bd.tv/ডিডি