ক্ষুধার্তকে খাবার না দিয়ে কষ্ট দেওয়ার কঠিন পরিণতি

ক্ষুধার্তকে খাবার না দিয়ে কষ্ট দেওয়ার কঠিন পরিণতি

 মো. আবদুল মজিদ মোল্লা

মৌলিক মানবাধিকারের প্রশ্নে সব মানুষ এক। মানুষকে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ইসলামে নিষিদ্ধ। মানুষকে খাদ্যে ও ক্ষুধায় কষ্ট দেওয়া নিন্দনীয়। শুধু মানুষ নয়, কোনো জীবকে ক্ষুধায় কষ্ট দেওয়া গুরুতর পাপ।

জীবিকার নিয়ন্ত্রা আল্লাহ

মহান আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম ‘রাজ্জাক’ (জীবিকা দানকারী)। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ নিজেকে জীবিকা দানকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন, বরং তিনি নিজেকে সমগ্র সৃষ্টিজগতের জীবিকা দানকারী বলেছেন। সুতরাং যারা অন্যের জীবন-জীবিকার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়, তারা মূলত আল্লাহর ইচ্ছা ও প্রত্যাশার বিরোধিতা করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমার প্রতিপালক যার জন্য ইচ্ছা তার জীবিকা বর্ধিত করেন এবং যার জন্য ইচ্ছা তা সীমিত করেন; তিনি তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক পরিজ্ঞাত, সর্বদ্রষ্টা।

’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩০)

জীবনের নিরাপত্তা সবার জন্য

ইসলামী শরিয়তের পাঁচটি মৌলিক উদ্দেশ্যের একটি মানুষের জীবন রক্ষা করা। অন্যায় ও অপরাধে যুক্ত নয় এমন সব মানুষ জীবনের নিরাপত্তা লাভ করবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমরা পরস্পরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না; কিন্তু তোমাদের পরস্পর রাজি হয়ে ব্যবসা করা বৈধ; তোমরা পরস্পরকে হত্যা কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)

ইসলামী আইন গবেষকরা বলেন, জীবন রক্ষা করা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মানবজীবনের সুস্থ-স্বাভাবিক বিকাশ এবং জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কিছুর নিরাপত্তা। যেমন খাদ্য-পানীয়, চিকিৎসা ও আবাসনের নিরাপত্তা।

জীবনোপকরণ ধ্বংস করা পাপ

একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ইসলাম মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করাকে পছন্দ করে না, বিশেষ করে জীবনোপকরণ ধ্বংস করে মানুষের জীবনকে সংকীর্ণ করে তোলা গুরুতর পাপ। পবিত্র কোরআনে এমন ব্যক্তিদের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, ‘যখন সে প্রস্থান করে, তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টির এবং শস্যক্ষেতে ও জীবজন্তু নিপাতের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ অশান্তি পছন্দ করেন না। ’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২০৫)

ক্ষুধায় কষ্ট দেওয়া পাপ

কোনো প্রাণীকে ক্ষুধায় কষ্ট দেওয়া পাপ। আর মানুষের ক্ষেত্রে হলে তা মহাপাপ, এমনকি বিভিন্ন অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্তকেও খাদ্য-পানীয় ও পোশাক দেওয়া আবশ্যক। কেননা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আহার্যের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দিকে আহার্য দান করে। ’ (সুরা : দাহর, আয়াত : ৮)

ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) লেখেন, ‘খলিফারা এই নিয়ম মেনে চলেছেন যে বন্দিরা খাদ্য, তরকারি ও শীত-গরমের পোশাক পাবে। সর্বপ্রথম ইরাকে এই নিয়ম চালু করেন আলী (রা.)। এরপর মুয়াবিয়া (রা.) শামে এবং একইভাবে পরবর্তী খলিফারা ওই নিয়ম চালু করেন। ফকিহ আলেমরা বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে যদি বন্দিকে খাবার দেওয়া না হয় এবং এ কারণে তাঁর মৃত্যু হয়, তবে তা হত্যা। এই অপরাধে ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। কেননা প্রকৃতপক্ষে সে ব্যক্তিকে হত্যাই করতে চেয়েছিল। (আল আসরু ওয়াস সিজনু ফি শারয়িল আরব, পৃষ্ঠা ১২)

পশুপাখিতেও কষ্ট নয়

শুধু মানুষ নয়, বরং পশুপাখিকেও ক্ষুধায় কষ্ট দেওয়া পাপ। হাদিসে এসেছে, বিড়ালের কারণে এক নারীর শাস্তি হবে। কেননা সে বিড়ালকে মারা যাওয়া পর্যন্ত আটকে রাখে। সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে এবং খাবার ও পানীয় দেওয়া হবে না। কারণ সে বিড়ালটি আটকে রেখেছিল এবং তাকে ছাড়েনি, যেন বিড়াল জমিনের উচ্ছিষ্ট খেতে পারে। (রিয়াজুস সালিহিন, হাদিস : ২৮২)

মুসলমানের করণীয়

মুসলমানের দায়িত্ব হলো যারা খাদ্যসংকটে কষ্ট পাচ্ছে তাদের সাহায্য করা, বিশেষত অবরুদ্ধ গাজার মুসলমানদের জন্য খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ পাঠানো খুবই প্রয়োজন। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা জাহান্নাম থেকে বেঁচে থাকো একটি খেজুরের বিনিময়ে হলেও। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৪১৭)

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, ইসলামের কোন আমলটি উত্তম? তিনি বলেন, তুমি মানুষকে আহার করাবে এবং যাকে চেনো বা চেনো না উভয়কে সালাম দেবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১২)

মহান আল্লাহ বলেন, ‘পরিণামে আল্লাহ তাদের (খাদ্য দানকারী) রক্ষা করবেন সেদিনের অনিষ্ট থেকে এবং তাদের দেবেন উত্ফুল্লতা ও আনন্দ। ’ (সুরা : দাহর, আয়াত : ৮-১১)

সাহায্য না করার শাস্তি

সামর্থ্য থাকার পরও কেউ যদি খাদ্য দান না করে, তাহলে কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে এবং পরকালে তারা শাস্তির মুখোমুখি হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি কি তাকে (তার পরিণতি) দেখেছেন? যে দ্বিন অস্বীকার করে। সে তো এতিমদের রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয় এবং সে অভাবগ্রস্তদের খাদ্যদানে উৎসাহ দেয় না। ’ (সুরা : মাউন, আয়াত : ১-৩)

হাদিসে কুদসিতে এসেছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ বান্দাকে বলবেন— ‘...হে আদম সন্তান আমি তোমার কাছে আহার চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে আহার করাওনি। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক আমি আপনাকে কিভাবে আহার করাব অথচ আপনি জগত্গুলোর প্রতিপালক! আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে আহার চেয়েছিল তুমি তাকে আহার করাওনি। তুমি কি জানতে না! যদি তুমি তাকে আহার করাতে তবে তার কাছে আমাকে পেতে। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৯)

হে আল্লাহ! আপনি অত্যাচারীদের হাত থেকে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করুন। আমিন।

এই রকম আরও টপিক