নওগাঁর নিভৃত পল্লীতে অন্যরকম বইমেলা

নওগাঁর নিভৃত পল্লীতে অন্যরকম বইমেলা

বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ

নওগাঁর মান্দা উপজেলার নিভৃত পল্লীর নাম মশিদপুর। জেলা শহর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এর দূরত্ব প্রায় ৫৫ কিলোমিটার। এটি জেলার মান্দা ও নিয়ামতপুর উপজেলা এবং রাজশাহীর তানোর উপজেলার সীমান্তবর্তী তিন উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম। জেলা, উপজেলা ও সীমান্তবর্তী হওয়ায় অবহেলিত গ্রামটি নিভৃত পল্লী হিসেবে পরিচিত।

এ গ্রামে রয়েছে কলেজ, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলেও নানা কারণে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রবণতা অনেক বেশি।

তবে এতো প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও নিভৃত পল্লী থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছেন একদল যুবক। নতুন প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে গড়ে তোলা হয়েছে একটি সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘মশিদপুর শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি ও পাঠাগার’।

এ সংগঠনের আয়োজনে সারা বছরই শিক্ষামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি করা হয়ে থাকে। তার মধ্যে বইমেলা অন্যতম।

এবার মশিদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে দীর্ঘ ১৪ বছর পর বইমেলার আয়োজন করা হয়েছে। আজ শনিবার স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মশিদপুর শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি ও পাঠাগারের উদ্যোগে মশিদপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আয়োজন করে। সকাল ৯টায় বইমেলা শুরু হয়ে চলে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।

মেলায় রাজশাহী ও স্থানীয় ছয়টি বইয়ের স্টল অংশ নেয়। যেখানে গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও ছোটদের জন্য ছড়া বই রয়েছে। প্রতিটি বইয়ের মূল্য ১০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি আগ্রহ কমাতে এবং শিক্ষার্থীদের বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে ব্যতিক্রমী এমন আয়োজন করা হয়। বইমেলার পাশাপাশি আলোচনা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, গল্প বলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। যেখানে ৪০টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় হাজার শিক্ষার্থীদের আগমনে তা মিলন মেলায় পরিণত হয়।

শুধু এ গ্রামের মানুষের জন্য বইমেলার আয়োজন নয়, আশপাশের তিন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের শিক্ষার্থীরা বইমেলাকে কেন্দ্র করে এক দিনের উৎসবে মেতে ওঠে। শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রত্যন্ত এলাকায় বই মেলা হওয়ায় উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী। মেলায় গুণীজনদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তারা শিক্ষার বিভিন্ন দিক তুলে ধলে ধরে এলাকাবাসীর মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন।

মশিদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হিমেল সরকার ও অষ্টম শ্রেণির সামিয়া ইসলাম বলেন, আমাদের স্কুল মাঠে বইমেলা হচ্ছে। যেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এসেছে। আমাদের এ প্রত্যন্ত গ্রামে বইমেলায় হওয়ায় অত্যন্ত আনন্দিত। পাঠ্য বইয়ের বাহিরে বই মেলা থেকে বিভিন্ন বই সংগ্রহ করা যায়। যেখান থেকে আমাদের জ্ঞান চর্চায় সহায়ক ভূমিকা রাখে। মেলা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পেরেছি।

মশিদপুর শিক্ষা উন্নয়ন সমিতির সাধারণ সম্পাদক শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, প্রত্যন্ত এ গ্রামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকার পরও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার বেশি। এর কারণ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবার হওয়ায় স্কুলে যাওয়ার প্রবণতা কম। এ কারণে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রবনতা বেশি। সংগঠনের পক্ষ থেকে শিক্ষা উপকরণ ও শিক্ষাবৃত্তি চালু করার পর ঝরে পড়ার প্রবণতা কমেছে। বর্তমানে নতুন প্রজন্ম ও শিক্ষার্থী সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝুঁকে পড়েছে। তাদের বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে প্রজন্মের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে বইমেলার আয়োজন করা হয়। এছাড়া সমিতির ব্যানারে বছরজুড়েই চলে শিক্ষার নানা কর্মসূচি।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে মানুষের মধ্যে বই পাঠের অভ্যাস গড়ে উঠেছে। এ কারণে গ্রামে পর্যায়ক্রমে এখন শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অভিভাবকরাও তাদের শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর ক্ষেত্রে আগ্রহী হচ্ছেন। প্রতি বছর শিক্ষাবিদদের ওই গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তারা শিক্ষার উন্নয়নে দিক নির্দেশনা দেন।

নড়াইল নজরুল ভাবুক ও অগ্নিবীণা কেন্দ্রীয় সংসদের চেয়ারম্যান এইচ এম সিরাজ বলেন, বইমেলা এক সময় ছিল শহরকেন্দ্রিক। পরবর্তী সময়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শুরু হয়। কিন্তু নিভৃত পল্লীতে বইমেলা দেখে আমি অভিভূত ও বিস্মিত। এলাকার ও আশপাশের মানুষের উৎসাহ দেখে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। পাঠ্যবইয়ের পর যে নতুন এক জগৎ আছে, নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা এ বইমেলা থেকে তা বুঝতে পারবে। নিভৃত পল্লীতে বইমেলার আয়োজন সারাদেশের জন্য মডেল হতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।

বইমেলায় এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের সহ-সভাপতি ও চৌবাড়িয়া হাট কলেজের অধ্যক্ষ রফিকুল আলমের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন, নড়াইল জেলার অগ্নিবীণা কেন্দ্রীয় সংসদের চেয়ারম্যান নজরুল ভাবুক কবি ও সাংবাদিক এইচ এম সিরাজ। এ সময় রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম শাহ, মশিদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম, সাবেক প্রধান শিক্ষক আব্দুর রশিদ এবং মশিদপুর শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি ও পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক বক্তব্য রাখেন।

পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি বইমেলা থেকে বিভিন্ন জ্ঞানমূলক বই পেয়ে আনন্দিত হন শিক্ষার্থীর। কবিতা আবৃতি, কৌতুক, চিত্রাঙ্কন ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার পর বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।

news24bd.tv/SHS  

এই রকম আরও টপিক