ইসলামী অর্থনীতির সুফল পেতে করণীয়

ইসলামী অর্থনীতির সুফল পেতে করণীয়

 আতাউর রহমান খসরু

মুসলিম সমাজে খণ্ডিতভাবে হলেও ইসলামী অর্থনীতির কিছু নিয়ম অনুসরণ করা হয়। যেমন- জাকাত ও ফিতরা দেওয়া, ইসলামী ব্যাংকিংয়ে লেনদেন করা, সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা ইত্যাদি। কিন্তু ইসলামী এসব কাজের সামগ্রিক সুফলের পরিমাণ সামান্যই। বলা যায়, সমাজে এর প্রভাব দৃশ্যমান নয়।

সুতরাং প্রশ্ন ওঠে, ইসলামী অর্থনীতির সুফল কিভাবে পাওয়া যাবে? নিম্নে তারই উত্তর তুলে ধরা হলো :

ইসলামী অর্থনীতি অপরিহার্য কেন

ইসলামী অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্যই হলো মানবসমাজে সম্পদের সুষম ও ইনসাফভিত্তিক বণ্টন নিশ্চিত করা। আর্থিক অসততা দূর করে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর অর্থনীতি নিশ্চিত করা। আর তা নিশ্চিত হয় আল্লাহভীতি ও পরকালীন জবাবদিহির গুরুত্ব অন্তকরণে অনুধাবনের মাধ্যমে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি সেসব জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত ও আল্লাহভীতি অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের জন্য আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর কল্যাণ উন্মুক্ত করতাম, কিন্তু তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল; সুতরাং তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদেরকে শাস্তি দিয়েছি।

’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৯৬)

সুফল পেতে বাধা কোথায়

শুধু অর্থনীতি নয়, বরং মানুষ তার জীবনে যতটুকু ইসলাম মান্য করবে, ততটুকুই সুফল লাভ করবে। বর্তমান সমাজে ইসলামী অর্থনীতির যতটুকু অনুসরণ করা হচ্ছে তার সুফল অবশ্যই মানুষ পাচ্ছে। তবে ইসলামী অর্থনীতির সুফল পুরোপুরি পেতে হলে সমাজে ইসলামী অর্থনীতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন আবশ্যক। শুধু অর্থনীতিতেই নয়, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্ষেত্রেও ইসলাম অনুসরণ করতে হবে।

একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। মুসলিম সমাজের একদল মানুষ জাকাত দিচ্ছে। এতে সমাজের একটি শ্রেণির সাময়িক অভাব দূর হচ্ছে। তবে স্থায়ী দারিদ্র্যবিমোচন হচ্ছে না। কেননা জাকাতের সুফল পেতে হলে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অধীনে তা সুপরিকল্পিতভাবে বণ্টন হওয়া আবশ্যক।

বর্তমানে রাষ্ট্রীয় কাঠামো না থাকায় অনেকে জাকাত দিচ্ছে না, যারা দিচ্ছে তারা পরিকল্পিতভাবে দিচ্ছে না, জাকাতের সুফল পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যাচ্ছে না।

সুফল পেতে করণীয়

১. রাষ্ট্রের সদিচ্ছা : রাষ্ট্রের সদিচ্ছা ও সহযোগিতা ছাড়া ইসলামী অর্থনীতির সুফল পাওয়াও সম্ভব নয়। যেমন ইসলামী অর্থনীতিতে সুদের মতো লাভের নিশ্চয়তা নেই, বরং পুঁজিদাতা ও ব্যবসায়ী উভয়ে লাভের মতো লোকসানেরও অংশীদার। তবে পুঁজিগ্রহীতা যেন দায়িত্ব অবহেলা ও অসততার সুযোগ নিতে না পারে সে কথাও বলা হয়েছে। আর দায়িত্বে অবহেলা ও অসততার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইনের সহায়তা ছাড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রায় অসম্ভব। ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নে কোরআনের নির্দেশনা হলো, ‘আমি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা নামাজ কায়েম করবে, জাকাত দেবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে। ’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৪১)

২. পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন : ইসলামী অর্থনীতির সুফল পুরোপুরি পেতে হলে তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন আবশ্যক। যেমন- কোনো রাষ্ট্রের আর্থিক অবকাঠামো সুদভিত্তিক এবং রাষ্ট্রীয় আইনও সুদি অর্থনীতির পক্ষে, বিপরীতে সেখানে কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামী নীতিমালা মেনে চলে। প্রকৃতপক্ষে এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ইসলামী অর্থনীতির পরিপূর্ণ সুফল পৌঁছানো সম্ভব নয়। আর ইসলামের সাধারণ দাবি হলো—মুমিন ইসলামের পরিপূর্ণ আনুগত্য করবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমরা সর্বাত্মকভাবে ইসলামে প্রবেশ কোরো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। ’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২০৮)

৩. নৈতিক পুনর্গঠন : ইসলামী অর্থনীতির পূর্ণ সুফল পেতে সাধারণ মানুষের নৈতিক মানদণ্ডও উন্নত করা প্রয়োজন। নৈতিক পুনর্গঠন দ্বারা উদ্দেশ্য মানুষের ভেতর এতটুকু আল্লাহভীতি জাগ্রত করা যেন সে তার ওপর অর্পিত আর্থিক দায়িত্ব পালন করে। পাশাপাশি সব ধরনের আর্থিক অসততা থেকে বেঁচে থাকে। কেননা এর সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকার গভীর সংযোগ রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার পথ করে দেন এবং তাকে জীবিকা প্রদান করেন ধারণাতীত উৎস থেকে। ’ (সুরা : তালাক, আয়াত : ২-৩)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি ফেরাউনের অনুসারীদের দুর্ভিক্ষ ও ফল-ফসলের ক্ষতির দ্বারা আক্রান্ত করিয়েছি, যাতে তারা অনুধাবন করে। ’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৩০)

৪. আইনি কাঠামো ও জবাবদিহি : আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইনি কাঠামো ও সহায়তা ছাড়া কোনো অর্থনীতির বিকাশ সম্ভব নয়। আইনি কাঠামোই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মপরিধি, আর্থিক সক্ষমতা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ইত্যাদির সীমা নির্ধারণ করে দেয়। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, পৃথক ব্যাংকিং আইন না থাকায় বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বিকাশ নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকিংসংক্রান্ত চূড়ান্ত আইন না থাকায় ইসলামী ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি ও ব্যাংকগুলোর পরিচালনা উভয়টি দুর্বল অবস্থায় চলছে।

৫. আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ : আধুনিক বিশ্বব্যবস্থা মানুষের অর্থনৈতিক চিন্তাকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে বহু নতুন আর্থিক প্রসঙ্গ সৃষ্টি হয়েছে। ড. এম ওমর চাপড়া বলেন, ‘মানবজাতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে সংকট মোকাবেলা করছে, তা উত্তরণে ইসলামকেই একটি কল্যাণমুখী ব্যবস্থা উপহার দিতে হবে। এ জন্য এমন একটা বিশেষ কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যাতে এই দুইয়ের ব্যবধানকে নিয়ন্ত্রণসাধ্য সীমার মধ্যে সামনে আনা যায় এবং এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য দূরীকরণ, মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং আয় ও সম্পদ বণ্টনে বৈষম্য হ্রাস করা যায়। ’ (ইসলাম ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, ভূমিকা)

৬. প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ : প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও উচ্চতর দক্ষতার অভাব ইসলামী অর্থনীতির বিকাশ ও প্রয়োগকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। সেন্টার ফর ইসলামিক ইকোনমিকস বাংলাদেশের সিইও মুফতি শাহেদ রহমানী বলেন, ইসলামী পদ্ধতিতে পরিচালিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। এর অন্যতম কারণ হলো, সে প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইসলামী অর্থনীতিতে দক্ষ ও সচেতন জনবলের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তাই ইসলামী অর্থনীতির মতো সূক্ষ্ম ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বাস্তবায়নে বর্তমান যুগে অর্থনীতিবিষয়ক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অপরিহার্য। (দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)

৭. নীতিমালার পুনর্গঠন : আধুনিক সমাজ ও বিশ্বব্যবস্থায় ইসলামী আইনগুলোর প্রায়োগিক রূপ কী হবে তা নিয়ে ব্যাপক চিন্তা ও গবেষণার অবকাশ রয়েছে। ড. এম ওমর চাপড়া বলেন, ‘শরিয়তের মূলনীতির মধ্যে যেকোনো কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সব মৌলিক উপাদান ও অনুষঙ্গ বিদ্যমান আছে। তবু প্রায়োগিক কর্মসূচি রচনার জন্য শরিয়তের মধ্যে পুঙ্খানুপুঙ্খ সব বিষয় বর্ণিত হয়নি। কেননা স্থান-কালের পরিসরে কঠোর অনমনীয়তা যেন কোনো বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। খুঁটিনাটি বিষয়াবলির কাঠামো এখানে গড়ে তুলতে হবে। ’ (ইসলাম ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, পৃষ্ঠা ২৩৩)

আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দিন। আমিন।

 

এই রকম আরও টপিক

সম্পর্কিত খবর