তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিয়েছেন যে ৯ জন 

উপরের বাঁ থেকে তন্বী নন্দিনী ইসলাম, নাজরিন চৌধুরী, মোহাম্মাদ হেলাল, সাগুফতা শারমীন তানিয়া, জিয়া হায়দার রহমান, তাহমিমা আনাম, ফাহমিদা আজিম, আদিবা জায়গিরদার ও জামাল নজরুল ইসলাম

বিশ্বে বাংলার উজ্জ্বল মুখ

তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিয়েছেন যে ৯ জন 

দেবদুলাল মুন্না

তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর/ পাড়ি দেবো রে। / আমরা ক'জন নবীন মাঝি/হাল ধরেছি, শক্ত করে রে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব গান স্বাধীনতা অর্জনে সবাইকে উজ্জীবিত করেছিল এরমধ্যে এই গান অন্যতম। বেশ কয়েকজন শক্ত করে হাল ধরেছেন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে।

লেখছেন ইংরেজি ভাষায়, বাংলার মুখ।
 
তন্বী নন্দিনী ইসলাম
২০২২ সালে নন–ফিকশন বিভাগে কারকাস সাহিত্য পুরস্কার ২০২২ পেয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন সাহিত্যিক তন্বী নন্দিনী ইসলাম। স্মৃতিকথাধর্মী বই ইন সেনসোরিয়াম: নোটস ফর মাই পিপল-এর জন্য ৫০ হাজার মার্কিন ডলার অর্থমূল্যের এ পুরস্কার পেলেন তিনি। লেখালেখির পাশাপাশি ব্রুকলিনে একটি সুগন্ধী ও প্রসাধনসামগ্রীর প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন তন্বী নন্দিনী ইসলাম।
নিজের পূর্ণ নামের তিনটি অংশের প্রথম দুটি করে বর্ণ (তন্বীর ‘টি’ ও ‘এ’, নন্দিনীর ‘এন’ ও ‘এ’এবং ইসলামের ‘আই’ ও ‘এস’) নিয়ে তিনি লেখালেখি করেন ‘তানাইস’(Tanais) নামে। তার লেখায় বাংলাদেশের মানুষের একেকটা মুখ যেন ফুটে উঠেছে।  

নাজরিন চৌধুরী
অস্কার মনোনয়নের তালিকায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নির্মাতা নাজরিন চৌধুরী।
৯৬তম অস্কারে চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ-আমেরিকান চিত্রনাট্যকার, পরিচালক ও অভিনেত্রী নাজরিন চৌধুরী। বিশ্ব চলচ্চিত্রের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কারের লাইভ অ্যাকশন শর্ট বিভাগে মনোনীত হয়েছে তাঁর পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘রেড, হোয়াইট অ্যান্ড ব্লু’। তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে মনোনয়ন পেয়েছেন সিনেমাটির প্রযোজক সারা ম্যাকফারলেন। এতে অভিনয় করেছেন হলিউড অভিনেত্রী ব্রিটানি স্নো।
যুক্তরাষ্ট্রের আরকানসাস রাজ্যের র্যা চেল নামের এক সিঙ্গেল মায়ের গল্পকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি। কাহিনি এগিয়েছে ওয়েট্রেস পেশার ওই নারী তাঁর দুই সন্তান নিয়ে চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা নিয়ে। ওই রাজ্যে গর্ভপাত নিষিদ্ধ থাকায় তিনি অন্যত্র গিয়ে সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। এর জন্য তাঁকে টাকা জোগাড় করতে হয়। এমন ঘটনাগুলোর মধ্যে কিছু হৃদয়বিদারক সত্যের সম্মুখীন হন তিনি; যা তাঁর জীবনের গতিপথকে পরিবর্তন করে দেয়। নাজরিন চৌধুরী লেখক হিসেবে আমাজন প্রাইমের ‘জ্যাক রায়ান’ সিরিজের একটি, বিবিসি ওয়ানের ‘ইস্টএন্ডারস’ সিরিজের দুটি, এএমসি চ্যানেলের ‘ফিয়ার অ্যান্ড ওয়াকিং ডেড’ সিরিজের আটটি পর্ব লিখেছেন তিনি। এ ছাড়া বেশ কিছু টিভি অনুষ্ঠানের চিত্রনাট্যকার হিসেবেও কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। বাংলাদেশি মা-বাবার সন্তান নাজরিন চৌধুরীর বেড়ে ওঠা ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনে। তিনি কিংস কলেজ লন্ডনে বায়োমেডিকেল সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং ডাক্তার হওয়ার জন্য বিএসসি অনার্সসহ স্নাতক পাস করেন। কিন্তু অবশেষে একজন লেখক হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেন তিনি।

মোহাম্মাদ হেলাল
এবছর পদ্মাসেতু নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান লেখক মোহাম্মাদ হেলাল। অ্যামাজন থেকে সদ্য প্রকাশিত উপন্যাসটির নাম ‘ফর লাভ অফ দ্য ব্রিজ’। পদ্মাপাড়ের এক কিশোর মার্টিন, কৈশোরে যাদের বাড়ি গ্রাস করে নেয় পদ্মা নদী। সেই মার্টিন বড় হয়ে আমেরিকায় আসে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে পদ্মাসেতু নির্মাণের পর বাংলাদেশে যায় সেই পদ্মার নাড়ীর টানে। এই ঘটনা নিয়েই হেলালের আলোচ্য উপন্যাস। ব্রাহ্মনবাড়িয়ার সন্তান হেলাল টরন্টোতে থাকেন। পেশাগত জীবনে তিনি একজন ব্যাংকার।  

সাগুফতা শারমীন তানিয়া
২০২২ সালে  কমনওয়েলথ ছোট গল্প পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেখক সাগুফতা শারমীন তানিয়া। তার গল্প ‘হোয়াট মেন লিভ বাই’ কমনওয়েলথ লেখক সংস্থা কর্তৃপক্ষ মনোনীত করেছে। কমনওয়েলথভুক্ত দেশ থেকে ওই বছর ৬ হাজার ৭শত’র ও বেশি গল্প জমা পরেছিল। বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য এর আগে সাগুফতা বাংলা একাডেমি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কার (২০১৮) পেয়েছেন। বিবিসি শর্ট স্টোরি পুরষ্কার ২০২১- এর জন্য তার ছোট গল্প ‘সিন্সেরলি ইয়োরস’ দীর্ঘ তালিকাভুক্ত ছিল।   সাগুফতা শারমীন বুয়েট থেকে লেখাপড়া শেষ করে দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে বসবাস করছেন। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই তিনি দক্ষতার সাথে লেখালেখি করছেন। সাগুফতা, ইতোমধ্যে গল্প বলায় তাঁর নিজস্ব একটা ধরণ তৈরি করেছেন যা তাঁকে অন্যদের থেকে খুব সহজেই আলাদা করা যায়। এদিকে সাগুফতা শারমীনের লেখা- ওয়াসাফিরি, এশিয়া লিটারারি রিভিউ, সিটি প্রেস এবং স্পিকিং ভলিউম অ্যান্থোলজিতে প্রকাশিত হয়েছে।  

জিয়া হায়দার রহমান
লেখক হিসেবে জিয়া হায়দার রহমান যে সৌভাগ্যবান তাতে সন্দেহ নেই। কারণ প্রথম প্রকাশিত উপন্যাসেই জেমস উডের মতো খ্যাতিমান সাহিত্য সমালোচকের দৃষ্টি কেড়েছেন তিনি। ইংরেজিভাষী সাপ্তাহিক পত্রিকার জগতে সাহিত্যের সর্দার 'দ্য নিউইয়র্কার'-এ তার সদ্য প্রকাশিত বই সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন জেমস উড। শুধু তাই নয়, জিয়া হায়দার রহমানের সাহিত্যিক-প্রজ্ঞা, তার অভিজ্ঞতা ও উপন্যাসের বিষয়বস্তুর রীতিমতো প্রশংসা করেছেন উড। ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যচর্চা করা বাংলাদেশের বাঙালি লেখকের সংখ্যা এমনিতেই খুব বেশি নয়। সেদিক থেকে সেই মুষ্ঠিমেয়দের অন্যতম জিয়া হায়দার রহমান। পিকাডোর প্রকাশনী খেকে সদ্য প্রকাশিত তার উপন্যাসের নাম ইন দ্য লাইট অফ হোয়াট উই নো। জিয়ার জন্ম বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। এতই প্রত্যন্ত যে তিনি তার উপন্যাসে সেই গ্রামটির বর্ণনা দিয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে প্রান্তে( "a corner of that corner of the world,") অবস্থিত বলে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে খুব শৈশবেই তিনি বাবা মায়ের সঙ্গে পাড়ি জমান ব্রিটেনে। সেখানে তার বাবা বাস কনডাকটরের কাজ করেছেন। সংগতভাবেই তার শৈশব ও কৈশোর কঠোর জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কেটেছে। পরবর্তীতে তিনি অক্সফোর্ড এবং ইয়েলে পড়াশোনা করেছেন। নিউইয়র্কের ওয়ালস্ট্রিটে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন। উপন্যাসে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অনেক কিছুই উঠে এসেছে। উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ২০০৮ সাল। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ব্রিটেন ও আমেরিকার বিস্তৃত পটভূমিতে বিন্যস্ত হয়েছে কাহিনি। অভিবাসী জীবনের যন্ত্রণা, হতাশা, পাশ্চাত্যের সবজান্তা মানসিকতা, পাশ্চাত্য শিক্ষার অন্তঃসারশূন্যতা, জঙ্গিবাদ থেকে শুরু করে ওয়াল স্ট্রিটের জীবন-মরণ প্রতিযোগিতা সবকিছুই প্রতিফলিত হয়েছে উপন্যাসে। উপন্যাসে এসেছে সত্তর, আশি ও নব্বই দশকের বিভিন্ন ঘটনা। সেই সময়ে অনাবাসী বাংলাদেশীদের জীবনচিত্র। উপন্যাসের নায়কের নাম জাফর। তিনি তার এক বন্ধুর কাছে নিজের জীবনকাহিনি বর্ণনা করেন। জাফরের বন্ধুর জবানীতেই পাঠক জানতে পারে তার জীবনের গল্প। উপন্যাসের বর্ণনাকারী বন্ধু ধনীর সন্তান। এই বন্ধুর নাম কোথাও উল্লেখ করেননি লেখক। ফলে অবধারিতভাবে বন্ধু হয়ে দাঁড়ায় একটি শ্রেণির প্রতীক, যে শ্রেণি ধনী বলে বিশ্বের সব সুবিধা জন্ম থেকেই তাদের করতলগত হয় অতি সহজেই। জাফরের সঙ্গে তার ঘনিষ্টতা অক্সফোর্ডে পড়ার সময়। জাফরের সহপাঠী বন্ধু সে। বন্ধু হলেও দুজনের শ্রেণিগত বৈষম্য দুস্তর। যুক্তরাষ্ট্রে এক সাবেক পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের নাতি, অক্সফোর্ডের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকের সন্তান। সে নিজেও বিশাল ধনী। তার জন্ম ১৯৬৯ সালে প্রিন্সটনে। তার শৈশব কেটেছে ইটনের অভিজাত বোর্ডিংয়ে। পাঠক দেখতে পায় এই বন্ধু ২০০৮ সালে লন্ডনের সাউথ কেনসিংটনে এক বিলাসবহুল বাড়িতে থাকে। এখানেই একদিন হঠাৎ এসে হাজির হয় জাফর,তার পুরনো সহপাঠি, যে ছিল গণিতের মেধাবী ছাত্র। এই দুই বন্ধুর শ্রেণিবৈষম্যের মধ্য দিয়ে লেখক দুরকম অভিবাসীর পরিচয় তুলে ধরেছেন।
জাফর তার বাবা মায়ের নিজের সন্তান নয়। সে যুদ্ধ শিশু। তার মা এক বীরাঙ্গনা। মাকে সে কখনও দেখেনি বা অতি শৈশবে দেখলেও তার কিছু মনে নেই। সিলেটের এক প্রত্যন্ত গ্রামে মাটির ঘরে তার জন্ম। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত ওই গ্রামেই তার শৈশব কাটে। তার পর পালক বাবা মায়ের সঙ্গে সে চলে আসে লন্ডনে। জাফর তার শৈশবের স্মৃতি বর্ণনা প্রসঙ্গে বলে, দু কামরার এক ঘিঞ্জি বাসায় তার অভিবাসী জীবনের শুরুর দিনগুলো কাটে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। বাংলাদেশের ছেলে বলে শ্বেতাঙ্গদের নিগ্রহের শিকার হতে হয় তাকে প্রতি পদে। স্কুলে, পাড়ায় সর্বত্র লাঞ্ছনা। সহপাঠী, শিক্ষক সবার নিগ্রহের শিকার সে। তার ভেতরে জমা হতে থাকে প্রচণ্ড ক্ষোভ। একবার বাবা মায়ের সঙ্গে সে একটি স্থানে বেড়াতে যায়। সেখানে এক শ্বেতাঙ্গ বালকের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু জাফর নিজের নাম বলে জর্জ। পরে যখন তার আসল পরিচয় ফাঁস হয় তখন সে লজ্জায় ছেলেটির সঙ্গে আর কথা বলতে পারে না। অদম্য মেধার বলে সে অক্সফোর্ডে সুযোগ পায়। কিন্তু গণিতের এই শিক্ষার্থী নিজের জীবনের হিসাব মেলাতে পারে না। এক সময় জাফর বাংলাদেশেও ফেরে তার গর্ভধারিণীর সন্ধানে। সিলেটের গ্রামে জাফরের যাত্রা যেন নিজের শিকড়ের দিকে। কিন্তু কোথায় ফিরবে সে? সে যে শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে অতি শৈশবেই। চাইলেই কি আর ফেরা যায় নিজভূমিতে? এখানে একটা বিষয় খুব স্পষ্ট। দরিদ্র বলে জাফর সব জায়গাতেই পরবাসী। কোথাও তার আপন ঠিকানা নেই। আর তার বন্ধু ধনী বলে যেন বিশ্ব নাগরিক। সে লন্ডন, নিউইয়র্ক সর্বত্রই পরম সমাদরে গৃহীত। উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে এক প্রেমকাহিনি। নিউইয়র্কে জাফর বিভিন্ন রকম কাজে জড়িত হয়ে পড়ে। সেখানে তার সঙ্গে ঘনিষ্টতা হয় এমিলি নামে এক সুন্দরী ব্রিটিশ নারীর। এই এমিলির ভাই ইটনে জাফরের বন্ধুর সহপাঠী ছিল। আবার অক্সফোর্ডে সেই সূত্রে এমিলির সঙ্গে জাফরের পরিচয় হয়েছিল। পরবর্তীতে জাফরের প্রেমিকা হয় এমিলি। জাফর তাকে ভালোবাসে সর্বান্তকরণে। কিন্তু এমিলির মধ্যে রয়ে যায় কুণ্ঠা। সে তার বন্ধু-স্বজনদের কাছে জাফরকে প্রেমিক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে কুণ্ঠিত। তাকে বিয়ে করতে তো কোনোভাবেই রাজি নয়। যা হোক আন্তর্জাতিক একটি সাহায্য সংস্থার কর্মী হয়ে আফগানিস্তানে যায় এমিলি। তার সঙ্গে যায় জাফর। জাফর দেখে ইয়োরোপিয়ান ও আমেরিকানদের রয়েছে একটা উন্নাসিকতা। তারা মনে করে যেহেতু তারা পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এবং শ্বেতাঙ্গ সুতারং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো সম্পর্কে তারা যা ভাবে বা যা করে তা অভ্রান্ত। তারা এসব দেশের 'সকল রোগের প্রেসক্রিপশন' দিতে পারদর্শী। পাশ্চাত্য শিক্ষার অন্তঃসারশূন্যতা ধরা পড়ে জাফরের চোখে। এমিলির একটি বৈশিষ্ট্য হলো সে কখনও 'সরি' বা দুঃখিত কথাটি বলে না। সে জাফরকে যতই আঘাত করুক তার জন্য সে অনুতপ্ত হয় না কখনও। জাফর একটি উপমার সাহায্যে এমিলির এই স্বভাবকে ব্যাখ্যা করে। জাফর বলে যুক্তরাজ্যের ইমিগ্রেশন অফিসার কখনও বলে না 'ব্রিটেনে স্বাগতম'। যদি কখনও কোনো ইমিগ্রেশন অফিসার হিথরোতে জাফরকে স্বাগতম জানাতো তাহলে জাফর ব্রিটেনের জন্য নিজের জান কোরবান করতেও কুণ্ঠিত হতো না। ব্রিটেনকে সে যে কখনও সত্যিকারভাবে নিজের দেশ ভাবতে পারেনি তার কারণ ব্রিটেন তাকে কখনও আপন করে নিতে পারেনি। এখানেই অনাবাসী হিসেবে তার ভিতরের ক্ষোভ, যন্ত্রণা আর হতাশার প্রকাশ ঘটে। গণিতের ছাত্র জাফর এখানেই হিসাব মেলাতে ব্যর্থ। জাফরের জীবনের কোনো হিসাবই মেলেনি। না দেশ, রাষ্ট্র ও সমাজের, না ভালোবাসার। লেখক জিয়া হায়দার রহমান জাফরের মধ্য দিয়ে পরবাসীর এই বিচ্ছিন্নতা বোধই তুলে ধরেছেন। হয়তো এই বোধ অনেকটাই আত্মজৈবনিক। এখানে তার সঙ্গে ভি.এস নাইপলের তুলনা দেওয়া যায়। নাইপল যেমন কোথাও নিজের আপন জায়গা খুঁজে পান না, রহমানও তেমনি এই বিশ্বে নিজের আপন ও একান্ত স্থানটির সন্ধানে নিরত।
অনাবাসী বাংলাদেশী জাফর যেমন সিলেটের গ্রামে নিজেকে 'পর' বলে অনুভব করেছে, তেমনি লন্ডনের জনজীবনের সঙ্গেও সে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেনি কোনোদিন। সে শৈশবের গ্রামের স্মৃতি ধরে রেখেছিল আপন অন্তরে। কিন্তু যখন সে সেখানে বাস্তবে পৌঁছায় তখন স্মৃতির সঙ্গে কিছুই মেলাতে পারে না। তার মনে সন্দেহ দেখা দেয় শৈশবের স্মৃতি কতটা বাস্তব আর কতটা তার আপন সৃষ্টি বা কল্পনা। তেমনি আপন জননীর কাছেও সে নিতান্ত পর। তার প্রেমিকাও তার নিজস্ব নয়। সেও তাকে স্বীকার করতে কুণ্ঠিত। বস্তুত এই বিশ্বের কোনোকিছুই তার নিজস্ব নয়। কোথাও তার 'আপন ঠিকানা' নেই। লেখক এই গল্পটি বলে যান ৫০০ পৃষ্ঠা ধরে অত্যন্ত শান্ত ও নিস্পৃহ ভঙ্গীতে। এই কথনের ফাঁকে ফাঁকে তিনি উল্লেখ করেন এডোয়ার্ড সাইদ, ফ্রয়েড, ভি,এস নাইপল, সিসেরো, দান্তে, জন ডান, জর্জ এলিয়ট এবং অন্যদের উক্তি।

তাহমিমা আনাম
তাহমিমা আনাম ১৯১৮ সাল থেকে ছোটগল্পের জন্য ও’ হেনরি সাহিত্য পুরস্কার দেয়া হয়। তাহমিমা আনাম ৯৯ তম পুরস্কার পেলেন। তিনি ‘গার্মেন্টস’ গল্পের জন্য এই পুরস্কার পেয়েছেন। তাহমিমা আনাম লন্ডনে বসবাস করেন এবং ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি করেন। ২০০৮ সালে তিনি কমনওয়েলথ লেখক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার প্রথম উপন্যাস আ গোল্ডেন এজ বা স্বর্ণযুগ রচনার কাজ শুরু করেন ২০০৪ সালে। তখন তিনি একইসাথে লেখালেখির কোর্সেও পড়ছেন। বাংলাদেশে না থাকার কারণে বাংলার উপর ভালো দখল তার ছিলোনা। এজন্যই মূলত ইংরেজিতে হাত দিয়েছেন। তবে ইংরেজির মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলার সুযোগ তাকে অনুপ্রাণিত করেছে। লেখালেখির পাশাপাশি কোর্স চালিয়ে যাবার কারণে একসময় একটি সংকলনে তার লেখার একটি অংশ ছাপা হয়। সংকলনটির নাম ছিলো বেডফোর্ড স্কয়ার। এটি ছিলো কোর্সটিতে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের রচনার সংকলন। অ্যান্ড্রু মোশন কর্তৃক সংকলিত এই সংকলনটির প্রকাশক ছিলেন জন মারে। তার লেখা অংশটুকু পড়ে ভালো লেগে যায় ম্যারের। তাই তিনি তাহমিমার বইটি প্রকাশের কথা বলে একটি চুক্তি করেন। এই চুক্তি অনুসারে ম্যারের কোম্পানি তাহমিমার দুইটি বই প্রকাশ করেছে। তার দ্বিতীয় বইয়ের বিষয়বস্তু ১৯২০-এর কলকাতা। তার লেখায় বাংলাদেশের জন্ম , ভারতভাগ এসব প্রসঙ্গ এসেছে।  তাহমিমার আরেকটি বিখ্যাত বই হচ্ছে আ গোল্ডেন এজ। এর বিষয়বস্তু হল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। তার জন্মের ৪ বছর আগেই মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিলো। তবুও তিনি তার পূর্ব-পুরুষদের প্রেরণাকে পুঁজি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তার উপন্যাসে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন। মূলত বাংলার মানুষের দৃষ্টিতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফুটিয়ে তুলেছেন। এজন্য তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এছাড়া তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ পরিচালিত মাটির ময়না চলচ্চিত্রের নির্মাণ সেটেও তিনি কাজ করেছেন। এসময় মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে তিনি নিগূঢ় জ্ঞান লাভ করেন। উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র রেহানা রেহানার মধ্যে তাহমিমা তার দাদীমার ছায়া ফেলেছেন।

ফাহমিদা আজিম
সাংবাদিকতা ও প্রকাশনায় সবচেয়ে সম্মানজনক পুলিৎজার পুরস্কার জিতেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান চিত্রশিল্পী এবং লেখক ফাহমিদা আজিম। ফাহমিদাই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রথম আমেরিকান যিনি পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন। মুলত সাংবাদিকতায় সাহিত্যের ভাষা ব্যবহার করার জন্য তাকে বলা হয়েছে ‘ সাংবাদিকতার কথাসাহিত্যিক’।   ‘ইলাস্ট্রেটেড রিপোর্টিং অ্যান্ড কমেন্টারি’র জন্য ২০২২ পুলিৎজার বিজয়ী দলের সদস্য হিসেবে ফাহমিদার নাম ঘোষণা করেছে আমেরিকান অনলাইন মিডিয়া কোম্পানি ইনসাইডার।
২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর ইনসাইডার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘হাউ আই এস্কেপড অ্যা চাইনিজ ইন্টার্নমেন্ট ক্যাম্প’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনের জন্য তাকে এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ফাহমিদা ছাড়াও বিজয়ী দলে অ্যান্থনি ডেল কোল, জোশ অ্যাডামস ও ওয়াল্ট হিকি রয়েছেন। পুলিৎজারের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে এবারের পুরস্কারের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, উইঘুরদের ওপর চীনের নিপীড়নের একটি শক্তিশালী কাহিনী বলার জন্য গ্রাফিক রিপোর্টেজ এবং কমিকস মাধ্যম ব্যবহার করার জন্য দলটি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। ফাহমিদাই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রথম আমেরিকান, যিনি সাংবাদিকতায় সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার পুলিৎজার জিতেছেন। ফাহমদিা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, এনপিআর, গ্ল্যামার, সায়েন্টিফিক আমেরিকান, দ্য ইন্টারসেপ্ট ও ভাইসসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজ করেছেন। তিনি তার নিজের মুসলিম উইমেন আর এভরিথিং (হার্পারডিজাইন, ২০২০) সহ বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। পেশাগত কাজ ছাড়াও ফাহমিদা অসাধারণ জীবনযাপনকারী বাস্তব মানুষের আঁকা, কাল্পনিক মানুষদের সুন্দরভাবে সাধারণ জীবনযাপন এবং খাবার আঁকতে পছন্দ করেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফাহমিদা এখন ওয়াশিংটনের সিয়াটলে বসবাস করেন।

আদিবা জায়গিরদার
২০২২ সালে ওয়াইএ পুরস্কার পেলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেখক আদিবা জায়গিরদার। 'হানি অ্যান্ড ইশু’স গাইড টু ফেক ডেটিং’ বইয়ের জন্য ওয়াইএ পুরস্কার ২০২২ জিতেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেখক আদিবা জায়গিরদার। পুরস্কার হিসেবে তিনি বাংলাদেশি টাকায় প্রায় দুই লাখ ২৪ হাজার ৩৮৮ টাকা পেয়েছেন। ২০২১ সালের মে মাসে প্রকাশিত বইটি আদিবার দ্বিতীয় বই। তার লেখা বই সম্পর্কে অভিজ্ঞতা শেয়ার করে আদিবা বনেন, ‘ছোট বেলায় মিডিয়াতে দেখেছি, এলজিবিটি সম্পর্কগুলোর পরণতি সবসময় কষ্টের দেখানো হয়। এতে আসলে একটি চরিত্রের মৃত্যু হয়। আমি এসব দেখে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি মনে করি এটি অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য খুব ক্ষতিকারক। তারা এ ধরনের সম্পর্কে শুধু দুঃখজনক সমাপ্তিই দেখে। তাই আমি বইটি লেখা শুরু করি। আমি দুই সমকামী বাঙালি মেয়ের জীবন কাহিনি তুলে ধরেছি , তাদের মনস্তাত্তিক সমস্যাও। ’ ওয়াইএ এর বিচারক দলের একজন সারাহ ওয়েব বলেন, আদিবা জায়গিরদারের লেখাটি অসামান্য প্রশংসার দাবি রাখে। ওয়াইএ পুরস্কার ২০২২ এর জন্য বইটি একটি যোগ্য বিজয়ী। উপন্যাসটিতে চরিত্রগুলোকে এতটাই বাস্তবভাবে ফুটিয়ে তুলেছে যা অসামান্য প্রতিভার দাবিদার।

ড. জামাল নজরুল ইসলাম

কেমব্রিজ বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম মহাবিশ্বের পরিণতি কী হতে পারে বা কী হবে, এই জটিল বিষয়টা নিয়ে লেখা ড. জামাল নজরুল ইসলাম এর লিখা 'দ্য আল্টিমেট ফেট অব দি ইউনিভার্স' (মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি) বইটি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে ১৯৮৩ সালে প্রকাশ হওয়ার পর বিজ্ঞানী মহলে বেশ হই চই পড়ে যায়। বইটি পরে জাপানি, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান, পর্তুগিজ ও যুগোস্লাভ ভাষায় প্রকাশিত হয়। ১৯৮৪ সালে সম্পাদনা করেছেন 'ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি' এবং ১৯৮৫ সালে 'রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি'। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস তাঁর তিনটি বই প্রকাশ করেছে।
তিনটি বইই কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড, প্রিন্সটন, হার্ভার্ডসহ নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। তিনি স্টিফেন হকিং কিংবা প্রফেসর আব্দুস সালামের মতো খ্যাতিমান বিজ্ঞানীদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন আবদুস সালাম, জোসেফসন, অমর্ত্য সেন এবং স্টিফেন হকিং। দেশপ্রেমী এই বিজ্ঞানীর কেমব্রিজে অধ্যাপক হিসেবে ১৯৮৪ সালেই এক লক্ষ আটাশ হাজার টাকা বেতন পেতেন । দেশ মাতৃকার টানে উচ্চবেতন ও সন্মান জনক এই চাকুরী ছেড়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন । যোগ দেন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে , বেতন একত্রিশ শত পঞ্চাশ টাকা। জামাল নজরুল ইসলাম কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বি.এসসি. অনার্স শেষ করে কেমব্রিজে পড়তে যান , কেমব্রিজ থেকেই ১৯৬৪ সালে প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা বিষয়ের ওপর পিএইচডি করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে অর্জন করেনএসসি.ডি. (ডক্টর অব সায়েন্স) ডিগ্রি। তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল এস্ট্রোনমির স্টাফ মেম্বার ছিলেন। তিনি লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে আরম্ভ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইন্সটিটিউট ফর অ্যাডভান্সড সহ অনেক খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রভাষক, ভিজিটিং অ্যাসোসিয়েট বা মেম্বার হিসেবে কাজ করেছেন। ড. জামাল নজরুল ইসলামের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, ঝিনাইদহ জেলায়। মৃত্যু ১৬ই মার্চ, ২০১৩ সাল।

news24bd.tv/ডিডি
 

এই রকম আরও টপিক