বিশ্ববাজার এখন চলেই না ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ছাড়া!

একটি পোশাক তৈরির প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক।

বিশ্ববাজার এখন চলেই না ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ছাড়া!

মো. ইস্রাফিল আলম

যেভাবে শুরু:
নাজমা চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রথম নারী কোয়ালিটি কন্ট্রোলার, ডিজাইনার ও লাইন চিফ। ১৯৭৯ সালের কোনো এক সকাল। নাজমা সবে ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক পাশ করেছেন। স্বপ্ন ছিল শিল্পী হবেন।

কিন্তু সেই সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর নাস্তা শেষে একটি দৈনিক পত্রিকা হাতে নিয়ে কয়েক পৃষ্ঠা উল্টাতেই দেখেন, একটি বিজ্ঞাপন। মনে মনে চাকরি খুঁজছিলেন। সেই বিজ্ঞাপনে দেখেন, বিদেশে প্রশিক্ষণ করানো শেষে চাকরি দেওয়ার প্রস্তাব। আগ্রহীদের যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
 বাংলাদেশের পোশাক খাত তথা ম্যানুফেকচারিং ইন্ডাস্ট্রির পাইওনিয়ার তখন দেশ গার্মেন্টস। ১৯৭৯ সালে দেশ গার্মেন্টস আধুনিক মেশিনে প্রশিক্ষণ নিতে দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে অবস্থিত বিশ্বখ্যাত দাইয়ু কোম্পানির পোশাক কারখানায় যেই ১৩৩ জন শ্রমিক ও মিড লেভেল ম্যানেজারকে পাঠিয়েছিল, তাদেরই একজন  এই নাজমা চৌধুরী।

নাজমা চৌধুরী ৬ মাসের প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরেন। অন্য আরো ১৪ নারী ছিলেন তার দলে, যাদের মধ্যে তিনি ছাড়া বাকী নারীরা ছিলেন শ্রমিক।  
প্রশিক্ষণ শেষে দেশ গার্মেন্টসে যোগ দেওয়ার পর ১৯৮০ বা ৮১ সালের দিকে তিনি মিড লেভেল ম্যানেজার হিসেবে বেতন পেতেন ৬ হাজার টাকা, যা ওই সময়ের একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার বেতনের চেয়ে ছিল কয়েকগুণ বেশি। তিনি বলেন, "ওই সময়ে আমার ভগ্নিপতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সরকারি ডাক্তার হিসেবে মাসে পেতেন ৭০০ টাকা বেতন, আর আমি পেতাম ৬ হাজার টাকা। " একই সময়ে দেশ গার্মেন্টস নতুন শ্রমিকদের নিয়োগ দিতো কমপক্ষে ৫১০ টাকায়, যখন অন্য খাতের শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকের মজুরি ছিল ১৫০ থেকে ২০০ টাকা।

এখন নাজমার সন্তান যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করে সেটেলড। ৮৩ সালে বিয়ে-সংসার করে এখন তিনি এক সুখী মানুষ। তিনি বলেন, আজ যখন দেখি বিশ্বের প্রায় বেশির ভাগ দেশে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেখা পোশাক। তখন বুক ভরে যায়। (সফল মুখগুলি: মিসবাহ রতন, পোশাক  শিল্পের শুরুর গল্প) 

এখন কোথায় :
বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে এখন চীনের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ ভাগই আসে এ খাত থেকে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে বাংলাদেশ ৪২ হাজর ৬১৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে। ২০২২-২৩ এ খাতে রপ্তানি আয় দাঁড়ায় ৩৮ হাজার ৫৭৭.৫১ ডলার। গত বছরের ৪ ডিসেম্বর জাতীয় বস্ত্র দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ ভাগ বস্ত্র খাত থেকে আসে। জিডিপিতে এ খাতের অবদান প্রায় ১৩ শতাংশ। তৈরি পোশাক খাতে প্রায় ৪৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, যার ৫৩ শতাংশ নারী। পরোক্ষভাবে ৪ কোটিরও বেশি মানুষ এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতি যে কয়েকটি খাতের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক খাত অগ্রগণ্য।  

শিকড়ের কথা :
সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতো এই রপ্তানি খাতের হুট করে বিকাশ ঘটেনি। এর পেছনে রয়েছে একটা লম্বা ইতিহাস। ষাটের দশকের শুরু পর্যন্ত ব্যক্তি উদ্যোগে ক্রেতাদের সরবরাহকৃত এবং তাদেরই নির্দেশিত নকশা অনুযায়ী স্থানীয় দর্জিরা পোশাক তৈরি করতো। শুধু শিশুদের জামাকাপড় ও পুরুষদের পরিধানযোগ্য গেঞ্জি ছাড়া প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশক পর্যন্ত তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজার ছিল না বললেই চলে।  

১৯৭৪ সালে উন্নয়নশীল দেশ হতে উন্নত দেশগুলোতে আরএমজি পণ্যের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করতে মাল্টি ফাইবার এগ্রিমেন্ট (এমএফএ) নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে বলা হয়, উন্নয়নশীল দেশ হতে উন্নত দেশে রপ্তানি ৬ শতাংশ হারে প্রতিবছর বৃদ্ধি পাবে। আশির দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশ আরএমজি খাতে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া শুরু করে। এই সময়টাতে কিছু বাংলাদেশি একটি কোরিয়ান কোম্পানি হতে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ লাভ করে। প্রশিক্ষণ শেষে এই কর্মীরা দেশে ফিরে অন্যের কারখানাতে বা নিজের উদ্যোগেই কাজ শুরু করেন। আশির দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক নিয়মিতভাবে ইউরোপ ও আমেরিকায় রপ্তানি শুরু হয়। মূলত একটি রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজারও দ্রুত সম্প্রসারিত হয় এবং এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার আয় বৃদ্ধি পায় ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসে। খাতটি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং তা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।

১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্য মোট রপ্তানিতে ৫০ শতাংশ অবদান রেখে রপ্তানি আয়ে শীর্ষস্থান দখল করেছিল। আশির দশকের শেষার্ধে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের আয়কে অতিক্রম করে পোশাক শিল্প রফতানি আয়ে প্রথম স্থানে চলে আসে। ১৯৯৯ সালে এই শিল্প খাতে সরাসরি কর্মসংস্থান হয় ১.৪ মিলিয়নেরও বেশি লোকের, যার মধ্যে শতকরা প্রায় ৮০ জন নারী। তৈরি পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণের সাথে সাথে বস্ত্র, সুতা, আনুষঙ্গিক উপকরণ, প্যাকেটজাতকরণ উপকরণ ইত্যাদি শিল্পেরও সম্প্রসারণ হতে থাকে। এছাড়া পরিবহন, ব্যাংকিং, শিপিং এবং ইন্সুরেন্স সেবার চাহিদাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর সবটাই অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে। এ ধরনের নতুন পরোক্ষ-কর্মসংস্থান মূলত তৈরি পোশাক শিল্পের কারণে তৈরি হয় যেটির সুবিধাভোগী মোট ২ লাখ শ্রমজীবী।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে নিট উপখাত ওভেন উপখাতকে অতিক্রম করে সমগ্র রপ্তানিতে ৪১.৩৮ শতাংশ (৬৪২৯ মিলিয়ন ডলার) অবদান রাখে তৈরি পোশাক খাত। বিপরীতে ওভেন পোশাক ৩৮.০২ শতাংশ (৫৯১৮.৫১ মিলিয়ন ডলার) নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে নেমে আসে। ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে নিট ও ওভেন একত্রে আমদানিকৃত কাঁচামালের মূল্যসহ সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলারে উপনীত হয় এবং সাড়ে ২২ লাখ নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। এবাবে ক্রমান্বয়ে পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে।  

চ্যালেঞ্জ:

বাংলাদেশ প্রায় ৩০টি দেশে পোশাক রপ্তানি করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ)-বাজার কেন্দ্রীভূত। মোট পোশাকের ৯০ শতাংশ রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ এর বাজারে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে মোট রপ্তানির ৪০ শতাংশ এবং ইইউতে ৫০ শতাংশ। এটা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য বড় দুর্বলতা। এই দুই বাজারে বাংলাদেশকে চীন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, তুরস্ক, মেক্সিকো, পূর্ব ইউরোপের দেশ, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। মেক্সিকো, বেশ কিছু ল্যাটিন আমেরিকার দেশ, আফ্রিকা এবং পূর্ব ইউরোপের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুযোগ পেলেও বাংলাদেশ পায়নি। এই বৈষম্যের কারণে বাংলাদেশকে তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এই বৈষম্যের কারণে দাম পার্থক্য বাংলাদেশের প্রতিকূলে থাকায় কঠিন প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। যদি কোনো কারণে একটি বাজার হাতছাড়া হয়ে যায়, তা হলে তৈরি পোশাক শিল্প বড় ধরনের হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।

এই প্রতিযোগিতামূলক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা পণ্য এবং বাজার বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে। বেশ কিছু রপ্তানিকারক উচ্চ মূল্যের পণ্য রপ্তানির আদেশ পেয়েছে। অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নিজস্ব বায়িং হাউজ খুলেছে। তারা আর বিদেশি ক্রেতার ওপর নির্ভরশীল নয়। কেউ কেউ নিজস্ব ব্র্যান্ডের পণ্য রপ্তানি করছে। বাজার বহুমুখীকরণের পদক্ষেপ হিসেবে ইতোমধ্যেই স্বল্প পরিসরে হলেও ভারত, রাশিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান, চীন ও অন্যান্য দেশে পণ্য রপ্তানি শুরু হয়েছে।  

এ ছাড়া পোশাক শ্রমিকদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা অনেক সময় এ খাতে অস্থিরতা তৈরি করছে। শ্রমিকদের দক্ষতা নিয়ে মালিক পক্ষের প্রশ্ন, শ্রমিকদের সময়মতো বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানে বিলম্ব, কারখানাগুলোয় শ্রমিকদের নিরাপত্তা ঝুঁকি, ভবন ও অগ্নি দুর্ঘটনার প্রকোপ, নকল ও নিম্ন মানের পোশাক রফতানি, নারী শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, কাঁচামাল আমদানি জটিলতা, অনাকাঙ্ক্ষিত শ্রমিক ছাঁটাই ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ সমস্যাও এ খাতে অস্থিরতা তৈরির জন্য দায়ী। তবে এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বেশ উন্নতি সাধন করেছে। সংকট সমাধানে দেশের দুই শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য সংস্থা বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিং ও এক্সপোর্টিং অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এবং বাংলাদেশ নিটওয়ার ম্যানুফ্যাকচারিং এবং এক্সপোর্টিং অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) সরকারকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নীতিমালা তৈরিতে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।  

নতুন সম্ভাবনা:

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নতুন এক প্রতিবেদেন বলা হয়েছে, তৈরি পোশাক খাতে পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতিতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। ‘পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি প্রতিরোধ এবং মোকাবিলা’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে আইএলও আরও জানায়, বাংলাদেশে পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য (ওএসএইচ) ব্যবস্থা প্রাথমিকভাবে শ্রম আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও মর্যাদা উন্নীত করতে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যনীতি-২০১৩ এবং গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি-২০১৫ গঠন করেছে। শ্রম আইনের ১০৯ ধারা কর্মক্ষেত্রে নারীদের সুরক্ষা প্রদান করে। প্রতিবেদনটিতে শ্রম আইনে পরিবর্তনের ফলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও নির্মূলে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরে প্রশংসা করা হয়েছে। এছাড়া পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যকাঠামো কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা এবং হয়রানি প্রতিরোধে কার্যকর উপায় হিসেবে প্রমাণ হচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

রপ্তানিকারকরা ২০২৪ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকের শুরু থেকে পোশাকের ক্রয়াদেশ বাড়বে বলে জানিয়েছেন। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের মূল্যস্ফীতি কমা, বৈশ্বিক খুচরা পর্যায়ের দোকানগুলো বিভিন্ন উৎসবে তাদের শীতকালীন পোশাকের মজুদ বিক্রি করে ফেলায় সামনে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ বাড়তে পারে বলে তারা আশা করছেন।

পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ী-নেতা এবং বৈশ্বিক ক্রেতাদের প্রতিনিধিরা জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো রপ্তানি গন্তব্যের প্রধান দেশগুলোর খুচরা পর্যায়ের দোকানগুলো ব্ল্যাক ফ্রাইডে, সাইবার মানডে, ক্রিসমাস ডে ও বক্সিং ডের মতো বিভিন্ন উৎসবের কল্যাণে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে প্রচুর পণ্য বিক্রি করতে পেরেছে। ইউএস সেন্সাস ব্যুরোর উপাত্তও বলছে, গত এক বছরে তৈরি পোশাকের দোকানগুলোয় বিক্রি ধারাবাহিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এ বিক্রি ২০২৩ সালের জানুয়ারির মাসিক ১৩.৭ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে নভেম্বরে ২১.৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

গত বছরের ডিসেম্বরে মার্কিন দোকানগুলোয় মাসিক বিক্রি হয়েছিল প্রায় ২৯ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি। ভারতীয় মার্কেট গবেষণা ফার্ম ওয়াজির অ্যাডভাইজরের মতে, ইয়ার-টু-ডেট হিসেবে ২০২৩ সালে পোশাক বিক্রয়ের পরিমাণ ২০২২ সালের তুলনায় ৬ শতাংশ বেশি ছিল। বৈশ্বিক থিঙ্কট্যাঙ্ক দ্য কনফারেন্স বোর্ড মার্কিন ভোক্তাদের মনোভাব, ব্যয়ের অভিপ্রায় এবং মুদ্রাস্ফীতি, স্টকের দাম ও সুদহার নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির মাসিক মূল্যায়ন পরিচালনা করে। এটির সর্বশেষ সমীক্ষা অনুসারে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আগের মাসের ১০২.০ থেকে বেড়ে মার্কিন ভোক্তা আস্থা সূচক ১১০.৭ হয়েছে। আর এ সূচক ২০২২ সালের ডিসেম্বরের সূচকের চেয়েও কিছুটা বেশি। এদিকে যুক্তরাজ্যের বাজারেও খুচরা পর্যায়ে তৈরি পোশাকের বিক্রি বাড়ার কথা জানা গেছে।

ইউকে স্ট্যাটিস্টিক্স অথোরিটির কার্যনির্বাহী দপ্তর অফিস অভ ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্সের তথ্যানুসারে, যুক্তরাজ্যের বাজারে ২০২৩ সালজুড়েই খুচরা পর্যায়ে মাসিক পোশাক বিক্রি ঊর্ধ্বমুখী ছিল। যদিও সর্বশেষ প্রান্তিকে সামান্য মন্দারও সম্মুখীন হয়েছে বাজারটি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সারা বছরের ১২ মাস মিলিয়ে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ মাসিক পোশাক রপ্তানি মূল্য ৪.৫৬ বিলিয়ন ডলার অর্জন করে। তবে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুসারে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের তুলনায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রপ্তানি ২.৪ শতাংশ কম ছিল। ২০২৩ সালে রপ্তানির সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি হয় সামান্যই- ৩.৬৭ শতাংশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৭.৩৯ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২২ সালে রপ্তানি করা হয়েছিল ৪৫.৭১ বিলিয়ন ডলারের।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান সংবাদ মাধ্যমকে জানান, আমাদের রপ্তানিকারকরা চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক থেকে বৈশ্বিক ক্রেতাদের কাছ থেকে পোশাকের অর্ডার বাড়বে বলে আশা করা যায়। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বগত এক বছরে ব্র্যান্ডগুলো সফলভাবে তাদের মজুদ বিক্রি শেষ করায় বাংলাদেশ থেকে তাদের পোশাকের সোর্সিং বাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিছু ক্রেতা এরই মধ্যে আমাদের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে অর্ডার বাড়াতে আলোচনা শুরু করছে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ২০২৪ সালে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) অন্তর্গত দেশগুলোর প্রত্যাশিত ১.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ মূল্যস্ফীতি ৩.২ শতাংশে হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। আমরা ২০২৪ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে দেশের পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির পূর্বাভাস দেখতে পাচ্ছি। মুদ্রাস্ফীতি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তাদের পোশাক ক্রয়ে আরও বেশি ব্যয় করার সম্ভাবনা রয়েছে।

নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, মিলেনিয়াম ডেভলপমেন্ট গোল অর্জন এবং বর্তমান টেকসই প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তৈরি পোশাক শিল্প নীরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তৈরি পোশাক শিল্প গুরুত্বের বিচারে এখন এমন স্তরে উপনীত হয়েছে যে, দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অনেকাংশেই আজ এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। পোশাক খাত আজ আমাদের জাতীয় শিল্প। এ শিল্পের গৌরব ও সুফলের ভাগীদার পুরো দেশবাসী।  

news24bd.tv/ডিডি/আইএএম