কোরআনে এতিম প্রতিপালন সম্পর্কে যা বলা হয়েছে

কোরআনে এতিম প্রতিপালন সম্পর্কে যা বলা হয়েছে

 মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ

এতিম মানে নিঃস্ব ও নিঃসঙ্গ। বাংলা ভাষায় মাতা-পিতাহীন বালক-বালিকাকে এতিম বলা হয়। ইসলামী পরিভাষায় যে শিশুর পিতা ইন্তেকাল করেছেন তাকে এতিম বলা হয়। পিতা উপস্থিত থাকাবস্থায় মাতাবিহীন শিশুকে ইসলামী পরিভাষায় ‘এতিম’ বলা হয় না।

পবিত্র কোরআনের ১২টি সুরার ২২ আয়াতে এতিম সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। ঈমান আনা যেমন পুণ্যের কাজ, নামাজ পড়া যেমন পুণ্যের কাজ, তেমনি এতিম ও অসহায়ের সহায় হওয়া পুণ্যের কাজ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘...কিন্তু পুণ্য আছে কেউ আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, কিতাব ও নবীদের ওপর ঈমান আনলে। আর (পুণ্য আছে) আল্লাহকে ভালোবেসে আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, পর্যটক, সাহায্যপ্রার্থী ও দাসমুক্তির জন্য দান করলে...।

’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৭৭)

এতিমের তত্ত্বাবধায়ক হওয়া নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যের ব্যাপার ও অত্যন্ত মর্যাদাকর বিষয়। যিনি এই মহান দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন তিনি অবশ্যই মহান মানুষ। নিজের সন্তানের মতো এতিমের সার্বিক বিষয় দেখভাল করবেন। কখনো আদর করে, মাথায় হাত বুলিয়ে সহানুভূতি প্রদর্শন করবেন, আবার অবাধ্যতায় কখনো শাসন করবেন।

দাউদ (আ.) বলতেন, ‘এতিমদের প্রতি দয়াবান পিতার মতো হয়ে যাও। ’ (আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ১৩৮)
এখানে এতিম প্রতিপালনের পথ ও পন্থা সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো—

লালন-পালন ও শিষ্টাচার শিক্ষাদান

সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠা শিশুর জন্মগত অধিকার। কিন্তু শৈশবে পিতৃবিয়োগের কারণে এটি অনেক সময় বিঘ্নিত হয়। তাই শৈশব থেকেই তাকে শিষ্টাচার শিক্ষা দিতে হবে। আলী (রা.) বলেন, ‘যার পিতা মারা গেছে সে প্রকৃত এতিম বা অনাথ নয়।

বরং জ্ঞান ও শিষ্টাচারে দৈন্য ব্যক্তিই প্রকৃত এতিম। ’ (জামিউ দাওয়াবিনিশ শিরিল আরাবি ১০/১৭০)
বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করা, দেখা হলে সালাম দেওয়া, গৃহে প্রবেশ ও বের হওয়ার আদব, খাওয়া-পরার আদব, ঘুমানো ও ঘুম থেকে ওঠার আদব, সালাতের নিয়ম ও প্রয়োজনীয় দোয়া-কালাম প্রভৃতি দৈনন্দিন জীবনে চলার নিয়ম-পদ্ধতি শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ এতিমের তত্ত্বাবধায়কের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে ত্রুটি করা যাবে না। কেননা প্রত্যেককেই কিয়ামতের দিন নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমরা প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। ’ (বুখারি, হাদিস : ২৫৫৪)

প্রয়োজনীয় শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা করা

ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব ব্যাপক। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে পবিত্র কোরআনের সর্বপ্রথম অবতীর্ণ পাঁচটি আয়াতের প্রথম শব্দটিই হচ্ছে ‘পড়ো’। আল্লাহ বলেন, ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপিণ্ড থেকে। পড়ো! আর তোমার পালনকর্তা বড়ই দয়ালু। যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দান করেছেন। ’ (সুরা : আলাক, আয়াত : ১-৫)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের ওপর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ। ’ (ইবনে মাজাহ : ২২৪) তাই যথাসাধ্য এতিমের দ্বিনি ও জাগতিক-ব্যাবহারিক উপকারী জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা করা জরুরি। একজন এতিমকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণের সর্বাত্মক চেষ্টা করা একজন ‘কাফিল’ বা তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব।

ঈমান ও আমল শেখানো ইসলাম মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রতিটি শিশুই ফিতরাত তথা ইসলাম গ্রহণের যোগ্যতাসহ জন্মগ্রহণ করে। তারপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদি, খ্রিস্টান বা অগ্নিপূজক বানায়। ’ (বুখারি, হাদিস : ১৩৮৫)

ঈমান, আমল ও সুন্দর চরিত্রে চরিত্রবান হওয়ার যোগ্যতা প্রতিটি শিশুর মধ্যেই বিদ্যমান আছে। যদি শিশুর পিতা-মাতা বা অভিভাবক এ ব্যাপারে যত্নবান হয় এবং পরিবেশ যদি অনুকূলে থাকে, তাহলে শিশুর মধ্যে অনুপম চরিত্রের বিকাশ ঘটে। পাশাপাশি শিরক ও বিদআতের ভয়াবহতা তুলে ধরা এবং এসব থেকে বেঁচে থাকতে বলা। যেমনটি লোকমান তাঁর সন্তানকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘স্মরণ করো, যখন লোকমান উপদেশ দিতে গিয়ে তার পুত্রকে বলেছিল, হে বৎস! আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না। নিশ্চয়ই শিরক মহা অন্যায়। ’ (সুরা ; লুকমান, আয়াত : ১৩)

হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আমি একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পেছনে বসা ছিলাম। এমন সময় তিনি আমাকে বলেন, ‘হে বৎস! আমি তোমাকে কিছু কথা শিক্ষা দেব। তুমি আল্লাহর হুকুমের হেফাজত করো, আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবেন, আল্লাহর বিধানের হেফাজত করো, আল্লাহকে তোমার সামনে পাবে। যখন কিছু চাইবে একমাত্র আল্লাহর কাছেই চাইবে, আর যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে কেবল আল্লাহর কাছেই করবে। জেনে রেখো, সমস্ত জাতি যদি তোমার উপকার করার জন্য একত্র হয়, তাহলে এতটুকু উপকারই করতে পারবে, যা আল্লাহ লিখে রেখেছেন। আর যদি তারা তোমার কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে একত্র হয়, তাহলেও ততটুকু ক্ষতিই করতে পারবে, যা আল্লাহ লিখে রেখেছেন। কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং কালি শুকিয়ে গেছে। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৫১৬)

সুতরাং ঈমান ও আমল শিক্ষাদানের উপযুক্ত বয়স হচ্ছে শিশু-কিশোর বয়স। তাই এতিমের দায়িত্বশীল ব্যক্তি এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তার অধীনস্থ এতিম সন্তানকে ঈমান ও আমল শিক্ষা দেবেন। শিরক ও বিদআতমুক্ত সুন্নাতপন্থী হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবেন। তবেই তিনি নিজেকে একজন সফল এতিম প্রতিপালনকারী হবেন।

উপযুক্ত বয়সে বিবাহের ব্যবস্থা করা

এতিমের দায়িত্বশীলের এটিও অন্যতম দায়িত্ব যে বিবাহের বয়স হলে তাদের বিবাহের ব্যবস্থা করা। বিবাহ মুসলিম জীবনের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। বিবাহের মাধ্যমে যেমন নিঃসঙ্গতা দূরীভূত হয়, চিন্তা প্রশমিত হয়, ঠিক তেমনি তাকওয়া বা পরহেজগারিতা বৃদ্ধি পায়। অশান্ত মনে প্রশান্তি ফিরে আসে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর মহান আল্লাহর নিদর্শনাবলির মধ্যে আছে যে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং তিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মধ্যে পরস্পরে ভালোবাসা ও দয়া। ’ (সুরা : রুম, আয়াত : ২১)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহ করতে সক্ষম তারা যেন বিবাহ করে। কারণ বিবাহ দৃষ্টি অবনত রাখতে ও গুপ্তাঙ্গের হেফাজতে বেশি কার্যকর। আর যে ব্যক্তি বিবাহ করতে অক্ষম সে যেন রোজা রাখে। কেননা রোজা যৌন চাহিদা অবদমিত রাখে। ’ (বুখারি, হাদিস : ৫০৬৫)