মুজিবের মার্চ-মার্চের মুজিব

আবদুল মান্নান

মুজিবের মার্চ-মার্চের মুজিব

আবদুল মান্নান

ইংরেজিতে মার্চের আভিধানিক অর্থ এগিয়ে যাওয়া। এই মার্চ মাসটি বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে গেছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এই স্বাধীন বাংলাদেশের যিনি মূল কারিগর, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ফরিদপুর জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

স্কুল পড়া শেষ করে গিয়েছিলেন কলকাতায় উচ্চশিক্ষা নিতে। সেখানে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের রাজনীতিতে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা বাংলা আর পাঞ্জাবকে ভাগ করলে তরুণ মুজিব চলে এসেছিলেন পাকিস্তানের পূর্ব অংশে, তখন যার নাম ছিল পূর্ব বাংলা। পূর্ব বাংলায় ফিরে যোগ দিয়েছিলেন প্রথমে ছাত্ররাজনীতিতে।

পরে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায়।

১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের ২১ তারিখ পাকিস্তানের বড় লাট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এসেছিলেন ঢাকায়। রমনা রেসকোর্সের জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। সভায় ঢাকার তরুণসমাজ এর প্রতিবাদ করে জিন্নাহকে জানিয়ে দিয়েছিল, উর্দু নয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যদি হতে হয়, তা হবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলা।

একই দিন জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ সমাবর্তনে দেওয়া ভাষণে আবারও উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে ঘোষণা করলে জনসভার প্রতিবাদের পুনরাবৃত্তি হয়। সেই প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব। নব প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিতে প্রথম রাজনৈতিক প্রতিবাদ হয়েছিল এই মার্চ মাসে। এতে সম্পৃক্ত ছিলেন শেখ মুজিব।
https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/03.March/10-03-2024/2/kalerkantho-ed-1a.jpgপাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করল, পূর্ব বাংলার প্রথম প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৭ থেকে ১২ মার্চ।

তখন প্রাদেশিক পরিষদ মুসলিম লীগের দখলে। মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন। ১৯৪৯ সালে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। ক্ষমতাধর মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মওলানা ভাসানী, হোসেন  শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হলো যুক্তফ্রন্ট। তাঁরা ২১ দফার নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে সারা দেশ চষে ফেললেন। তাঁদের সঙ্গী হয়েছিলেন তরুণ রাজনৈতিক কর্মী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব। যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। বরাদ্দকৃত ২৩৭টি মুসলিম লীগের আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্টের ভাগে ২২৮টি। মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসনে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। আর এককভাবে আওয়ামী মুসলিম লীগের ভাগে ছিল ১৪৩টি। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচিত হয়ে এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে ১৫ মে গঠিত হয় পূর্ব বাংলার প্রথম নির্বাচিত মন্ত্রিসভা। সেই মন্ত্রিসভায় শেখ মুজিব সদস্য হিসেবে শপথ নেন। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এই নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় কখনো মেনে নিতে পারেনি। শুরু হয় বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। কেন্দ্রীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনায় শুরু হয় বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গা। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৫৪ সালের ৩১ মে এ কে ফজলুল হক মন্ত্রিসভাকে এই বলে বরখাস্ত করে যে তারা দাঙ্গা থামাতে ব্যর্থ হয়েছে।

১৯৫৭ সালের ২ মার্চ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। এই বিষয়ে দলের সভাপতি মওলানা ভাসানী দ্বিমত পোষণ করে ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ ছিল আওয়ামী লীগ ও বাঙালির ইতিহাসের একটি টার্নিং পয়েন্ট। এই দিন ঢাকায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা উত্থাপন করেন। এর বিরোধিতা করেন খোদ আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ। বিরোধিতা করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। দলের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সভায় ছয় দফা গৃহীত হয়। দলের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিব আর সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ শুধু আওয়ামী লীগের জন্য নয়, টার্নিং পয়েন্ট ছিল বাংলাদেশের রাজনীতি আর শেখ মুজিবের জন্য। একজন প্রাদেশিক রাজনৈতিক নেতা থেকে তিনি হয়ে উঠলেন পাকিস্তানের জাতীয় নেতা। শুরু হয় ছয় দফার মূলবাণী দেশের জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার পালা। শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক সতীর্থদের নিয়ে যখন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন, তখন প্রমাদ গুনলেন সেনা শাসক আইয়ুব খান। ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ আইয়ুব খান ঘোষণা করলেন, ‘মুজিবের ছয় দফাকে অস্ত্রের ভাষা দিয়ে মোকাবেলা করা হবে। ’ ৮ মে শেখ মুজিবসহ তাঁর প্রায় সব রাজনৈতিক সহকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হলো।

১৯৬৭ সালে গ্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে  গঠিত হলো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সারা দেশে শুরু হলো আইয়ুববিরোধী আন্দোলন। শেখ মুজিব কখনো তাঁর জন্মদিন পালন করতেন না। ১৯৬৮ সালের ১৭ মার্চ প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালন করে। যখন বঙ্গবন্ধু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, তখন তাঁর বিরুদ্ধে করা হয় তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র। শেখ মুজিবকে হত্যা করার প্রথম ষড়যন্ত্র। এটি ছিল রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ছাত্রদের নেতৃত্বে শুরু হলো তীব্র গণ-আন্দোলন। এই আন্দোলনের তোড়ে ভেসে গেল সব ষড়যন্ত্র। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লৌহমানব আইয়ুব খান এই মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। এদিন জেল থেকে মুক্ত হয়ে আসেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব। পরদিন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাঙালির এই নেতাকে ভূষিত করে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে।

তীব্র আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ দেশে ফের সামরিক শাসন জারি করে আরেক সেনা শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইয়াহিয়া ক্ষমতা নিরুঙ্কুশ করার পর বুঝতে পারেন যেখানে তাঁর পূর্ববর্তী শাসক আইয়ুব খান ক্ষমতায় থাকতে পারেননি, তাঁর পক্ষেও বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা সম্ভব নয়। ২৯ নভেম্বর ঘোষণা করেন পরের বছর দেশে সংখ্যা সাম্যের ভিত্তিতে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যার একমাত্র দায়িত্ব হবে পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা করা। তিনি এও ঘোষণা করেন, নির্বাচিত গণপরিষদ যে সংবিধান রচনা করবে, তা যদি তাঁর পছন্দ না হয়, তাহলে তিনি সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করবেন। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, তাঁর নির্বাচনী ইশতেহার রচিত হবে ছয় দফার ভিত্তিতে।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হলো সারা পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন। সংখ্যা সাম্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের ভাগে ৩০০ আসনের মধ্যে পড়েছিল ১৬৯টি আসন। সেই নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জয়ী হয় ১৬৭টি আসনে। পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাদের কাছে এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না যে বাঙালিরা পাকিস্তানের শাসক হবে। তারা মনে করত দেশ শাসন তাদের জন্মগত অধিকার। শুরু হলো পাকিস্তানের বহুল ব্যবহৃত প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। উদ্দেশ্য বাঙালিকে সরকার গঠন থেকে বিরত রাখা। এই ষড়যন্ত্রে যোগ দিলেন নির্বাচনে বিজয়ী দ্বিতীয় রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো।

সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে—এই দাবি নিয়ে আবার বাঙালি রাজপথে নামল। তীব্র দাবির মুখে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, ৩ মার্চ গণপরষিদের অধিবেশন বসবে ঢাকায়। প্রস্তুতি চলল সব দিকে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত অনেক নেতা ও সংসদ সদস্য ঢাকায় আসা শুরু করলেন। সব যখন প্রস্তুত শেষ, তখন ইয়াহিয়া খান অনেকটা ভুট্টোর প্ররোচনায় ১ মার্চ রেডিও ঘোষণার মাধ্যমে দেশের মানুষকে জানিয়ে দিলেন, ৩ মার্চে অনুষ্ঠেয় গণপরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হলো। এই ঘোষণায় সারা দেশের মানুষ তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ল। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হলো এক বিশাল ছাত্র-জনতার সমাবেশ। এতে যোগ দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সভায়  উত্তোলন করা হলো বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। গাওয়া হলো ‘আমার সোনার বাংলা...’। ছাত্ররা বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দিলেন ঠিক একজন সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানকে যেমন দেওয়া হয়। পড়া হলো স্বাধীনতার ইশতেহার। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে গণপরিষদের অধিবেশন পিছিয়ে দেওয়ার তীব্র সমালোচনা করে বললেন, তিনি পরবর্তী নির্দেশনা ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানের জনসভায়  ঘোষণা করবেন।

৭ মার্চ ১৯৭১। বাংলা ও বাঙালির জীবনে এক ঐতিহাসিক দিন। সেই দিনের পড়ন্ত বিকেলে ইতিহাসের মহামানব লাখো মানুষের সামনে দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তারপর তো সেই ২৫ মার্চের বিভীষিকার রাত। শুরু হলো ইয়াহিয়া খানের বাঙালি নিধনের কর্মসূচি ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের গণহত্যা বাস্তবায়নের পরিকল্পানা, যা চলল পরবর্তী ৯ মাস। সেই রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ঘোষণা করে গেলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

সার্বিক বিচারে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের এই মার্চ বাংলা, বাঙালি আর বঙ্গবন্ধুর জন্য সব সময় এক ঐতিহাসিক মাস। এই মাসে স্মরণ করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আর দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করা ৩০ লাখ শহীদকে।

 লেখক : বিশ্লেষক ও পবেষক

news24bd.tv/আইএএম