প্রযুক্তির আলোয় ঝলমলে কৃষি

রিপারের সাহায্যে ধান কাটা হচ্ছে

কৃষিতে সাফল্য

প্রযুক্তির আলোয় ঝলমলে কৃষি

মো. ইস্রাফিল আলম

আজির মণ্ডলের গল্প
চল্লিশ বিঘা জমির মালিক আজির মণ্ডল। ছয় পুত্র ও ছয় কন্যার জনক আজির মণ্ডল পুত্র সন্তানদের নিয়ে করেন কঠোর পরিশ্রম। হাল চাষ, জৈব সার আর ফসলে পানির জন্য প্রকৃতির ওপর ভরসা করতে হয় তাকে। ৭০-এর দশকের এমন অবস্থায় যশোরের আজির মণ্ডলকে থাকতে হতো মাটি আর ছন দিয়ে তৈরি ঘরে।

পরিবারের জন্য খাবারের সংস্থান করাই যেন কঠিন হতো তার জন্য। সেই আজির মণ্ডল এখন আর নেই। কিন্তু তার ৬ ছেলে একই জমি চাষ করে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কৃষিতে অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছেন। নিজেদের সম্পদ বাড়ানোর পাশাপাশি, পাকা দালান তৈরি ও নিজেদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিতি করেছেন।
বদলে গেছে আজির মণ্ডলের সন্তানদের পরিবারের দৃশ্যপট।

1
বলদ দিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে হাল চাষ 

মুসা আহমেদ অপুর গল্প
২০২০ সাল, বিশ্বে করোনা মহামারি তুঙ্গে। সবকিছু যেন স্থবির। ৭ সদস্যের পরিবার নিয়ে দিশেহারা মুসা আহমেদ অপু। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার এক্তারপুরের অপু সিলেটের ভোলাগঞ্জে পাথরের ব্যবসা করে কোনোমতে পরিবার নিয়ে দিনাতিপাত করছিলেন। করোনার থাবায় তাও বন্ধ হয়ে যায়। কী করবেন ভেবে কিনারা পাচ্ছিলেন না। এমন সময় তার দেখা হয় কৃষি বিভাগের একজন মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে। তাঁর পরামর্শে কৃষি বিভাগ থেকে ভর্তুকির আওতায় একটি কম্বাইন হারভেস্টর ক্রয় করেন তিনি। কম্বাইন হারভেস্টরের মাধ্যমে এলাকার অনেক কৃষকের ধান কাটতে শুরু করেন। করোনাকালীন তখন শ্রমিক পাওয়াও কষ্টকর ছিল। সবাই মেশিনের সহায্যে ধান কাটতে শুরু করেন। বদলে যায় অপুর পরিবারের চিত্র।

৭০-এর দশকের কেউ যদি আজকের বাংলাদেশে এসে উপস্থিত হন, দেশকে চিনে উঠতে কষ্ট হবে তার। সেই বাংলাদেশই কোভিড পরিস্থিতির আগে প্রায় ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়। অর্থনীতির এই পট পরিবর্তনে যেসব খাত অবদন রেখে চলেছে, তার মধ্যে কৃষি অতি গুরুত্বপূর্ণ খাত। বর্তমানে দেশে জিডিপির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ অর্জিত হয় কৃষি খাত থেকে। অধিকন্তু কৃষি এ দেশের জনমানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা প্রদানের প্রধানতম এবং অন্যতম উৎস। এখনো দেশের বিপুল জনসংখ্যার কর্মসংস্থানও হয়ে থাকে কৃষিকে অবলম্বন করেই।

তিল থেকে তাল
১৯৭০-এর দশকে চাল উৎপাদন ছিল মোটামুটি ১২ মিলিয়ন টন। পরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬ মিলিয়ন টন হয়েছে। এখানে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে কয়েকটি বিষয়। তার মধ্যে প্রথম দিকে অন্যতম ছিল গভীর নলকূপ ও ভূ-উপরস্থ সেচ ব্যবস্থার প্রবর্তনের মাধ্যমে শুকনো মৌসুমে বোরো ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি। তবে বড় ধরনের বাঁকবদল ঘটে আশির দশকে, যখন নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যক্তি খাতে অগভীর নলকূপ স্থাপনকে উৎসাহিত করা হয়। একইভাবে ভর্তুকিযুক্ত রাসায়নিক সারের যুগপৎ নীতি উচ্চফলনশীল জাত চাষে আরও গতি যোগ করেছিল। ফলে সত্তরের দশকে যেখানে দুই মিলিয়ন টনের বেশি বোরো উৎপাদন হতো না, ২০০০ সালের দিকে তা চার গুণ বেড়ে আট মিলিয়ন টনে দাঁড়ায় এবং আমনকে ছাড়িয়ে যায়। গত ২০ থেকে ২৫ বছর সময়কালে বেশ বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। এখন বোরো উৎপাদনের পরিমাণ ২০ মিলিয়ন টনে এসে দাঁড়িয়েছে, যদিও আমন উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে ৭-৮ থেকে ১৩-১৪ মিলিয়ন টনে। আউশ উৎপাদনের পরিমাণ মাত্র ৩ মিলিয়ন টন হওয়ার কারণে এটি সম্পূর্ণ প্রান্তিক ফসলে পরিণত হয়েছে। বোরোর প্রাধান্যের কারণে বাংলাদেশের পক্ষে খাদ্যশস্যে কম-বেশি স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব হয়েছে (ড. এম আসাদুজ্জামান, নভেম্বর ২১, ২০২০)

1
যন্ত্রের সাহায্যে ধান রোপণ

বাংলাদেশে মানুষের মাথাপিছু আয়সহ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে যে ঊর্ধ্বগতি এসেছে- একমাত্র কৃষি খাতের ঈর্ষণীয় সাফল্যের সুবাতাসের কারণই সেটা হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান। কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, স্বাধীনতার পর দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল, বর্তমানে এ হার ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ। ১৯৭২-৭৩ সালে জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল ৫৮ দশমিক ০৪ শতাংশ, ২০১৯-২০ সালে জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান কমলেও মোট অবদান বেড়েছে প্রায় ৬ গুণ।

স্বাধীনতার পর ৫০ বছরে নির্দিষ্ট হারে আবাদি জমি কমে যাওয়া, একইসঙ্গে জনসংখ্যা আড়াই গুণ বৃদ্ধি পেলেও ফসল উৎপাদন বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। বর্তমানে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন সাড়ে তিন গুণ, সবজি পাঁচ গুণ, ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে আঠারো গুণ আর আলুর উৎপাদন বেড়েছে ১২ গুণ। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমান দেশে বছরে গড়ে দুটি ফসলের উৎপাদন হচ্ছে। আয়তনে ছোট ও ঘন-বসতিপূর্ণ হলেও স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরে সীমিত সাধ্য নিয়েই কৃষি খাতে অন্তত দশটির অধিক ক্ষেত্রে বিশ্বে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। কৃষিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পাট রপ্তানিতে প্রথম, পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, ধান ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আম ও আলু উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম এবং সামগ্রিক ফল উৎপাদনে বিশ্বে ২৮তম স্থানে। এরই মধ্যে দেশি ও তোষা পাট, পাটসহ পাঁচ শতাধিক ফসলের ক্ষতিকর একটি ছত্রাক ও ধৈঞ্চার জীবনরহস্য উন্মোচিত হয়েছে। ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম, দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল ও কালিজিরা চাল।

নতুন নতুন উদ্ভাবন
২০১৩ সালে বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনের দিক থেকেও বাংলাদেশ শীর্ষ স্থানে রয়েছে। ধানের লবণাক্তসহিষ্ণু ১৩টি জাত, খরা সহনশীল ১০টি জাত, জলমগ্নতাসহিষ্ণু ৬টি জাত, উপকূলীয় জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের উপযোগী ৩টি, হাওর অঞ্চলের উপযোগী ১১টি জাত, জিঙ্কসমৃদ্ধ ৭টি, কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) সমৃদ্ধ ৩টি এবং সুগন্ধি ৯টি জাতের উদ্ভাবন করে বিশ্বে অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশে ধান বিজ্ঞানীরা। ২০১৩ সালে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিটি বেগুনের ৪টি জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এছাড়া বিটি তুলা উদ্ভাবনের কাজ ও আলুর নাবি ধ্বসা রোগের প্রতিরোধী জিন প্রতিস্থাপনের কাজ এগিয়ে চলছে।

1
পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম

পাটের উন্নয়নে এক যুগান্তকারী সফলতা এনেছেন বাংলাদেশি জিনতত্ত্ববিদ ড. মাকসুদুল আলম। তার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডাটাসফটের একদল উদ্যমী গবেষকের যৌথ প্রচেষ্টায় ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সফলভাবে উন্মোচিত হয় পাটের জিন নকশা। ২০১০ সালের ১৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কারের ঘোষণা দেন।

আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার 
আজকের এই বদলে যাওয়া কৃষি সম্ভব হয়েছে মূলত আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে। অতীতে যখন লাঙল- জোয়াল আর ‘হালের বলদ’ ছিল কৃষকের চাষাবাদের মূল উপকরণ সে জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে পাওয়ার টিলার। চারা রোপণে ব্যবহার হচ্ছে ইনক্লাইন্ড প্লেট সিডার। ফসলের জমির সারিতে এ যন্ত্রটির সাহায্যে বীজ বুননে বীজ সহজে লাগছে এবং সহজে আগাছা পরিষ্কার করা যাচ্ছে। যন্ত্রটি ব্যবহারে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে প্রায় ১০-৪০ শতাংশ বীজ কম লাগে এবং ফলন ১০-১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ধান ও গম কাটার যন্ত্র ‘রিপার’ ফসল কাটার মৌসুমে ব্যবহার হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অফিস বলছে, এ যন্ত্র ব্যবহারে সাশ্রয় হচ্ছে ৯২ ভাগ খরচ, শ্রম ও সময় ব্যয় কমে প্রায় ৯০ ভাগ। বেড-নালা তৈরি করে আবাদ করতে বেড প্লান্টার ব্যবহার হচ্ছে। আলু, ভুট্টা, মরিচ, সবজিসহ বিভিন্ন প্রকার ফসল বীজ-ফারো বা বেড-নালা তৈরি করে আবাদ করা হয়। অনেকটা ট্রাক্টরের মতো দেখতে কম্বাইন্ড হারভেস্টার দিয়ে একই সাথে ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তায় ভরা যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ ৬০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ কমছে। যন্ত্রটি ব্যবহারে সময় বাঁচায় ৭০-৮২ শতাংশ এবং ৭৫ শতাংশ কম শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে এক একর জমির ধান বা গম কাটতে খরচ হয় প্রায় ছয় হাজার টাকা। সেখানে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ব্যবহারে লাগে মাত্র ৪০০ টাকা।

1
ট্রাকটর দিয়ে জমি চাষ

ই-তথ্য সেবা বলছে, স্বাধীনতার পরবর্তীকালে কৃষিতে সেচযন্ত্রের ব্যবহার ছিল প্রায় ১ লাখ, বর্তমানে প্রায় ১৬ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১৫ লাখ ৮৫ হাজার অধিক সেচযন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। ৭৬ দশমিক ১৬ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়াহচ্ছে, যা কিনা মোট আবাদি জমির শতকরা ৮৬ দশমিক ৫৭ ভাগ। স্বাধীনতা উত্তরকালে যান্ত্রিক চাষাবাদ ছিল না বললেই চলে। হালের গরু দিয়েই চাষাবাদ হতো। কয়েক দশকে আগেও শারীরিক শ্রম দিয়েই জমি চাষ ও মাড়াই হতো। বর্তমানে সিংহভাগ জমিই কৃষিযন্ত্রের মাধ্যমে চাষ হচ্ছে। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কৃষি যান্ত্রিকীকরণ কর্মসূচির ও ৫০-৭০ শতাংশ ভর্তুকির ফলে দেশে কৃষি জমি চাষে প্রায় ৯০ শতাংশ, সেচকাজে ৯৫ শতাংশ, আগাছা দমনে ৬৫ শতাংশ, কীটনাশক প্রয়োগে ৮০ শতাংশ এবং ফসল মাড়াইয়ের কাজে ৭০ শতাংশ যান্ত্রিকীকরণ সম্ভব হয়েছে। টেকসই যান্ত্রিকীকরণে সৌরশক্তির ব্যবহারও বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে।

3
ফসলের মাঠে ল্যাপটপ ব্যবহার করছেন কৃষক

ই-তথ্য সেবা

কৃষকদের যেন সেবা নিতে সরসারি সরকারি অফিসে যেতে না হয়, তারা যেন বাসা থেকে সেবা দিতে পারেন এ জন্য সবার নানা ই-তথ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে, বাংলা ওয়েব সাইট কৃষি তথ্য সার্ভিস (https://www.ais.gov.bd/)। এই সেবার আওতায় রয়েছে কৃষি কল সেন্টার, এআইসিসি, মাল্টিমিডিয়া ই-বুক, টাচ স্ক্রিন কিয়স্ক, আইসিটি ল্যাব, কমিউনিটি রেডিও ইত্যাদি।

কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি কল সেন্টারের (১৬১২৩) মাধ্যমে কৃষকেরা সরাসরি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করছে। কৃষকদের কৃষি আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনে সহজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছে। ইন্টারেকটিভ কৃষি বিষয়ক ওয়েবসাইটগুলো বিপুল তথ্য ভাণ্ডারের উৎস হিসেবে কাজ করছে। ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে অনলাইন সার সুপারিশসহ অন্যান্য পরামর্শ গ্রহণ অনেক সহজ হয়েছে। গ্রামপর্যায়ে কৃষিবিষয়ক পরামর্শ সেবা দেওয়ার জন্য ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ই-পুর্জির মাধ্যমে আখ চাষিদের আখের মূল্য পরিশোধ করা হচ্ছে। কৃষকের একাউন্টে সরাসরি ভর্তুকির টাকা প্রেরণ, ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা, মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সরকারি গুদামে ধান-চাল ক্রয়, এছাড়াও কৃষিভিত্তিক অনেক ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ও সফটওয়ার ব্যবহার হচ্ছে। এক যুগ আগেও অনেকের কাছে এসব কথা স্বপ্নের মতো মনে হতো, কিন্তু বাস্তব স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে গেছে। জাতীয় ও আঞ্চলিক রেডিও স্টেশন হতে কৃষি বিষয়ক কার্যক্রম প্রচারের পাশাপাশি ১৮টি কমিউনিটি রেডিও হতে কৃষি বিষয়ক তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। বিটিভির পাশাপাশি বেসরকারি চ্যানেলগুলোতে কৃষি বিষয়ক সংবাদ ও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান নিয়মিত সম্প্রচার হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন- ফেসবুক, ইউটিউব, বিভিন্ন পেইজে অথবা গ্রুপেও আধুনিক কৃষি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বিটিআরসি তথ্য মতে ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটির কিছু বেশি, এর মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। ক্যাটালিস্টের এক পরিসংখানে দেখা যায়, ৮৪ শতাংশ গ্রামীণ কৃষক মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। করোনা অতিমারির সময় সরাসরি কৃষকের উৎপাদিত পণ্য কেনাবেচার জন্য বাংলাদেশে সর্বপ্রথম উন্মুক্ত কৃষি মার্কেটপ্লেস ‘ফুড ফর ন্যাশন’ চালু করা হয়।  

বর্তমান সরকারের বড় সাফল্য হলো কৃষি গবেষণাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। এর ফলে প্রতিটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষণার মাধ্যমে নতুন ফসলের জাত উদ্ভাবনের ফলে কৃষি উৎপাদনে বিশ্বে প্রাথমিক কৃষি পণ্য (শুধুমাত্র ফসল) উৎপাদনে ১৪ তম স্থান অর্জন করেছে। দেশে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল কৃষি তথা ই-কৃষি’র প্রবর্তন করা হয়েছে। মোট ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র, কৃষি কল সেন্টার-১৬১২৩, কৃষি কমিউনিটি রেডিও, কৃষি তথ্য বাতায়ন তৈরি করা হয়েছে। ফলে দেশের প্রান্তিক কৃষকসমাজ সহজেই কৃষিখাতের আধুনিকায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারছেন।  

1
করোনার মধ্যে কৃষকদের ধান কেটে ঘরে তুলে দেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা

সরকারি সহায়তা
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির মধ্যেও কৃষকের পাশে ছিল শেখ হাসিনার সরকার। করোনায় শ্রমিক সংকটে থাকা কৃষকদের জমির পাকা ধান যেন ঘরে তুলতে সমস্যা না হয়, সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সারাদেশে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা স্বেচ্ছাশ্রমে কৃষকদের ধান কাটতে সহায়তা দেন। কৃষকদের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ তহবিল থেকে সহজ শর্তে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পেরেছিলেন কৃষক। করোনার সময়ে সারের ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার কোটি টাকা, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য ১০০ কোটি টাকা, বীজের জন্য ১৫০ কোটি টাকা এবং কৃষকদের জন্য আরও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।

টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে রূপকল্প ২০৪১, চলমান অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০, বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ এবং অন্যান্য পরিকল্পনা দলিলের আলোকে সরকার কৃষির উন্নয়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কৃষি খাতের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে। আধুনিক ও বিরূপতা সহনশীল জাতের উদ্ভাবন, ফসলের নতুন ধরনের উদ্ভাবন, পানি সাশ্রয়ী সেচ প্রযুক্তি আবিষ্কার, ভূ-উপরস্থ পানি ব্যবহারের মাধ্যমে সেচ এলাকার সম্প্রসারণ,  ন্যায্যমূল্যে কৃষি উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা, কৃষি উপকরণের ভর্তুকি বৃদ্ধি, কৃষিপণ্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যশস্যের পর্যাপ্ত সংরক্ষণ সুবিধাদি নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি।

news24bd.tv/আইএএম