ডায়াবেটিক রোগীদের রোজা রাখার পদ্ধতি

ডায়াবেটিস হলো শরীরের এমন একটি গুরুতর অবস্থা, যখন আমাদের শরীর নিজে থেকে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না।

ডায়াবেটিক রোগীদের রোজা রাখার পদ্ধতি

অনলাইন ডেস্ক

ডায়াবেটিস হলো শরীরের এমন একটি গুরুতর অবস্থা, যখন আমাদের শরীর নিজে থেকে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না বা তৈরি হওয়া ইনসুলিন দক্ষতার সঙ্গে (কার্যকরভাবে) ব্যবহার করতে পারে না। এর ফলে রক্তে শর্করা বা গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়। ইনসুলিন মানুষের শরীরের কোষগুলোতে শর্করা প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে। এ রোগে আক্রান্তদের সময় ক্ষণ ঠিক করে ওষুধ সেবন করতে হয়।

সেক্ষেত্রে মুসলিম ধর্মালম্বীরা রোজার সময় সমস্যায় থাকেন। কীভাবে ওষুধ নেবেন বা কী করবেন এ নিয়ে তাদের মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয়।

ডায়াবেটিস হলে রোজা রাখা যাবে না-অনেক মুসলিম এমনটি ভাবেন। বিষয়টি ঠিক নয়।

ডায়াবেটিস কন্ট্রোলে রেখে রোজার কার্যাদি সম্পাদন করা যায়। তবে এর জন্য অবশ্যই কিছু নিয়ম পালন করতে হবে। স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য উচ্চরক্তচাপ, কোলেস্টেরল, ওজন সবদিকেই লক্ষ রাখতে হবে। ম্যানেজ করতে হবে কিডনি হার্ট, নার্ভ ও রক্তনালির কোনো জটিলতাকেও। অনেকে পেটজ্বলে, ক্ষুধা লাগে, গা কাঁপে ইত্যাদি বলে রোজা রাখেন না। খালি পেটে থাকলে গ্যাস্ট্রিক আলসার হবে এমন কোনো কথা নেই।

* ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের রোজা রাখার ঝুঁকি

ঝুঁকি নির্ণয়ের স্কেল আছে যা দিয়ে স্কোর করে গ্রেড করা সম্ভব। ঝুঁকিগুলো মৃদু, মাঝারি, বেশি বা খুব বেশি গ্রেড করে বলা হয়। আমাদের দেশে মৃদু ঝুঁকি, বেশি ঝুঁকি এবং খুব বেশি ঝুঁকি এ তিন গ্রেড করা হয়। খুববেশি ঝুঁকি-টাইপ ১ ডায়াবেটিস, প্রেগনেন্সি ডায়াবেটিস। একইভাবে চলতে, বুঝতে পারে না এমন বয়োবৃদ্ধ, অস্থিতিশীল হার্টের অসুখ, স্ট্রোক, বা সাম্প্রতিককালে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক করলে তাদের ঝুঁকি বেশি। হাইপোগ্লাইসেমিয়া নিয়ে অসচেতন রোগী এবং সম্প্রতি গুরুতর হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়ে গেছে, এরা সবাই খুববেশি ঝুঁকির রোগী। গ্রেড-৪ বা তার চেয়ে খারাপ ক্রোনিক কিডনির অসুখ, ডায়লাইসিসের রোগী, ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছে এমন কিডনি রোগী, এদের ঝুঁকিও খুব বেশি। ইজিএফআর (EGFR) দিয়ে কিডনির অসুখের গ্রেড নির্ণয় হয়। ইজিএফআর ৬০ পর্যন্ত গ্রেড-২। ৩০ পর্যন্ত গ্রেড ৩। ত্রিশের নিচে হলে গ্রেড ৪। ১৫-র কমে হলে গ্রেড ৫ ক্রোনিক কিডনি ডিজিস। বাস্তবতা হলো এদের অনেকেই রোজা রাখেন এবং ভালোও থাকেন। তবে এদের জন্য রোজা রাখা নিরাপদ নয়। মৃদু ঝুঁকিও নাই এমন রোগী না বোঝার কারণেই হোক বা ইচ্ছা করেই হোক রোজা রাখেন না। ডাক্তারের দায়িত্ব ঝুঁকি এবং ঝুঁকির গভীরতা রোগীকে অবহিত করা।

* কার জন্য রোজা রাখা কঠিন

রোজায় ফজর থেকে মাগরিব পর্যন্ত দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকতে হয়। এমনিতে বছরের অন্য সময় রাত ৮-১০টায় ডিনার থেকে সকাল ৮-১০টায় নাস্তা খাওয়া মানে হচ্ছে প্রায় ১২ ঘণ্টা না খেয়ে থাকা। তাই রমজান বা অন্য সময় অভুক্ত থাকার সময়কাল প্রায় সমান। যে কাজগুলো দিনে করি রমজানে সেগুলো রাতে করলেই হলো। হার্টের অসুখ, কিডনির অসুখে অনেকেই রোজা রাখেন না। কেউ ভয় পায় কেউ সাহস করে না। আসলে না খেয়ে থাকার পার্থক্যটা হলো রাতের বদলে দিন আর দিনের বদলে রাত, এই যা! ঝুঁকির সঙ্গে রোজার খাদ্য, রোজায় ব্যায়াম, রক্ত পরীক্ষা (মনিটরিং), জটিলতা বিশেষ করে হাইপোগ্লাইসেমিয়া এবং তার চিকিৎসা রোজার আগেই শেখা উচিত।

* রক্ত পরীক্ষা

রোজা রেখে সুগারের জন্য রক্ত পরীক্ষা করলে রোজা নষ্ট হয় না। আঙুলের মাথা থেকে নিয়ে রক্ত (SMBG) পরীক্ষা করা সক্ষম সবাইকে শিখতে হবে। কমপক্ষে তিনবার পরীক্ষা করা লাগতে পারে। হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলো কিনা সতর্কতা হিসাবে দেখতে হবে বিকেল ৪ বা ৫টায়। ব্লাডগ্লুকোজ ৫ হলে সতর্ক হতে হবে। আবার পরীক্ষা করতে হবে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। ৪ এর কম হলে রোজা ভাঙতে হবে। যার যত ঝুঁকি তার ততো পরীক্ষার দরকার হয়। পরীক্ষার একটা চার্ট রাখতে পারলে ভালো। রোজা শুরুর আগে HbA1C ভালো থাকলে, কোন ওষুধ ছাড়া কন্ট্রোলে থাকলে পরীক্ষা না করলেও চলবে।

▶ একবার পরীক্ষা : খাওয়ার ওষুধ দিয়ে চিকিৎসারত থাকলে দিনের দ্বিতীয় ভাগে একবার করলেই হবে।

▶ দুইবার পরীক্ষা : ইনসুলিনের রোগী হলে, দুই ডোজ ওষুধ লাগলে রাতে এবং দিনে কমপক্ষে একবার করে পরীক্ষা করতে হবে।

▶ তিনবার পরীক্ষা : হাইপোগ্লাইসেমিয়া সন্দেহ করলে সঙ্গে সঙ্গে আরও একবার পরীক্ষা করবেন। নিয়ম করেও করা যেতে পারে। প্রথম তিনদিনে প্রতিদিন। তারপর তিনদিন পর পর। শেষ সপ্তাহে একদিন পর পর।

* ব্যায়াম

রোজা রেখে কায়িক শ্রম নিঃসন্দেহে কঠিন। পঞ্চাশোর্ধদের কাজের শিডিউল বদলে নিতে হবে। শেষবেলার কাজ রাতে করা যেতে পারে। তারাবির নামাজের আগে ব্যায়াম করতে হবে। ব্যায়ামের ক্ষেত্রে কার্ডিও অর্থাৎ হাঁটা, সাইক্লিং, ট্রেডমিল (যেগুলোতে হার্ট রেট বাড়ে) সবই করা যাবে, তবে পঁয়তাল্লিশ মিনিট না করে বিশ মিনিট করলে ভালো। মাসল শক্তিশালীকরণ বা বডিবিল্ডিং করলে সুবিধা, কারণ এতে ডিহাইড্রেশন কম হয়। স্ট্রেচিং বা যোগব্যায়াম চলতে পারে। ইফতারের আগেও ব্যায়াম করা যেতে পারে। কারণ ডিহাইড্রেশন হলে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ। একই অবস্থা তারাবির পর থেকে সেহরির আগ পর্যন্ত। রোজার একমাস ব্যায়াম বাদ রাখার প্ল্যান ঠিক নয়। আবার রোজার সময় পয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটার পরিকল্পনাও অনুমোদিত নয়। ব্যায়াম সপ্তাহে সাতদিনের জায়গায় পাঁচদিন বা রেস্ট পিরিয়ড আরও বাড়িয়ে করা যায়। রোজায় ব্যায়ামের উদ্দেশ্য হলো ফিটনেস ধরে রাখা, অভ্যাস ঠিক রাখা, শরীরের হরমোনগুলোর কার্যকারিতা ঠিক রাখা।

* রোজার জন্য ডায়াবেটিসের তীব্র জটিলতা

১। হাইপোগ্লাইসেমিয়া ২। হাইপারগ্লাইসেমিয়া। ৩। ডায়াবেটিস কিটোএসিডসিস ৪। ডিহাইড্রেশন ৫। থ্রম্বোসিস।

* হাইপোগ্লাইসেমিয়া

রক্তে গ্লুকোজ মাত্রাতিরিক্ত কমে গেলে তাকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলে। সব ডায়াবেটিস রোগী বিশেষ করে যাদের ওষুধ ব্যবহার করতে হয় তাদের অবশ্যই হাইপোগ্লাইসেমিয়ার সম্যক ধারণা থাকা উচিত। উপসর্গ হলো প্রথমে ক্ষুধা লাগবে। তারপর গা কাঁপবে, গা ঘামবে। এরপর অজ্ঞান হয়ে যাবে। এ রকম হলে ডাক্তার না খুঁজে মিষ্টি (গ্লুকোজ/চিনি বা এগুলো দিয়ে বানানো পানীয়/খাবার) খেতে হবে।
রোজায় হাইপোগ্লাইসেমিয়ার কারণ :

▶ ওষুধ ও কায়িক পরিশ্রম রোজার সঙ্গে যথাযথ মিল করতে না পারা।

▶ সেহরি ও ইফতারিতে পরিমাণমত না খাওয়া।

▶ বাছবিচার না করে মাত্রাতিরিক্ত কাজ করা।

▶ সেহরি আর ইফতারির ওয়াক্তের সঙ্গে মিলিয়ে ট্যাবলেট বা ইনজেকশন ডোজ ঠিক করতে না পারা।

▶ কিডনি /লিভার দূর্বল থাকা।

হাইপোগ্লাইসেমিয়ার চিকিৎসা ও প্রতিকার : গ্লুকোজ বা চিনি খেতে বা নিতে হবে। এটাই আমাদের দেশে একমাত্র চিকিৎসা। মৃদু বা মাঝারি হলে রোগী নিজেই চিকিৎসা করতে পারবে। গ্লুকোজ খাওয়ার ১৫ মিনিট পর আবার পরীক্ষা করতে হবে। উপসর্গ চলে গেলে ভাত, রুটি, ফল ইত্যাদি জটিল শর্করা খেতে হবে। দুধ বা প্রোটিন খাওয়া যাবে না। মারাত্মক হলে বা অজ্ঞান হয়ে গেলে গ্লুকোজ বা মিষ্টি খাওয়ানো না গেলে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যেতে হবে।

* হাইপারগ্লাইসেমিয়া

ডায়াবেটিস রোগীদের হাইপারগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে মাত্রাতিরিক্ত বা বিপদজনক মাত্রায় গ্লুকোজ বেড়ে যাওয়া (>১৬.৭ মিলিমোল বা ৩০০ মি. গ্রা. হওয়া) বড় ধরনের সমস্যা। ওষুধ বা ইনজেকশন বাদ দিলে বা ভুলে গেলে বা কম নেওয়ার জন্য এবং অতিরিক্ত খাবারের জন্য সুগার বেশি হয়। হাইপারগ্লাইসেমিয়ার দুটো সমস্যা।

১. ডায়াবেটিস কিটো এসিডসিস

২. হাইপার গ্লাইসেমিক হাইপার অসমোলার স্টেট(এইচ এইচ এস)
দুই অবস্থায়ই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণে চিকিৎসার প্রয়োজন।

* ডায়াবেটিস কিটোএসিডসিস

আরও পড়ুন: ভালো খেজুর চেনার উপায়

রমজানে এটা বেশি হয়। অভুক্ত অবস্থায় শরীরে ইনসুলিন কমে গ্লুকোজ বাড়ে। কিটোন বডি তৈরি হয় ও শেষাবধি কিটোএসিডসিস হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ভয়ে ইনসুলিন না নেওয়া বা বেশি করে কমানোর জন্য এটা হয়। রোজার আগে যাদের গ্লুকোজ বেশি থাকে (৮.৩ থেকে ১৬.৭ মিলিমোল), কিডনি দুর্বল থাকলে, ডায়াবেটিসের অন্য জটিলতা অগ্রবর্তী থাকলে (উচ্চ/খুব উচ্চঝুঁকির রোগী) কিটএসিডোসিস ও এইচএইচএস বেশি হয়।

* ডিহাইড্রেশন (পানিশূন্যতা) ও থ্রম্বোসিস

পানি কম পান করা আসল কারণ। অতিরিক্ত শ্রম, অতিরিক্ত গরম, স্যাঁতসেঁতে (আর্দ্র) আবহাওয়া, রক্তে অতিরিক্ত শর্করা সবকিছুই রোজায় পানিশূন্যতা তৈরি করতে পারে। অতিরিক্ত পানিশূন্যতায় রক্তে রক্তজমাট বাঁধার উপাদান বাড়ে এবং রক্ত তরল রাখার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হয়। ফলে রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধে। পানিশূন্যতায় রোজা ভাঙতে হবে। রোজায় পরিমিত পানি পান করা এবং ক্যাফিনযুক্ত পানীয় পরিহার করা উচিত।

* রোজার তীব্র জটিলতা প্রতিরোধের উপায়

▶ রোজা শুরুর এক থেকে তিনমাস আগে ডায়াবেটিস ও ডায়াবেটিসের জটিলতার ব্যাপারে ধারণা নিতে হবে। অবস্থা বুঝে প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

▶ আগে না থাকলে হাইপারগ্লাইসেমিয়া ও হাইপোগ্লাইসেমিয়ার সম্যক ধারণা নিতে হবে।

▶ নিজে নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা (SMBG) ও পর্যবেক্ষণের জ্ঞানার্জন করতে হবে। সেহরির দুই ঘণ্টা পর ও ইফতারির আগের দু’ঘণ্টার মধ্যে রাতে সুবিধামত একবার এবং হাইপোগ্লাইসমিয়ার উপসর্গ হলে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে।

▶ পানি পান করে ইফতারে তিনটা খেজুর খেলে সুগার বাড়বে। পরিমিত পানি মিষ্টি নয় এমন পানীয় পান করলে, বাঙ্গী, ডাব, শশা খেলে পানিশূন্যতা হবে না।

▶ সম্ভব হলে ইফতারে একক ডোজ গ্লিমিপ্রাইড/গ্লিক্লাজাইড, এনালগ বেসাল বা এনালগ বেসাল-বোলাস দিয়ে ব্লাড গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে হবে।

news24bd.tv/ab