বিএনপি আন্দোলনে ব্যর্থ কেন ?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

বিএনপি আন্দোলনে ব্যর্থ কেন ?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

বিএনপি আন্দোলন করতে পারে না। কেন পারে না? এই কথাটা অনেককে বলতে শোনা যায়। জনসমর্থন থাকলেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি আন্দেলনে সফল হয় না। এরকম একটা কথা মোটামুটি রাজনৈতিক পরিসরে পাকাপোক্ত হয়ে গেছে।

প্রায় সময় এ কথাটা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়েদুল কাদেরও বলে থাকেন। ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছেড়েছে বিএনপি। এরপর দীর্ঘ আন্দোলনে সরকারের পতন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন বা রাজনৈতিক পটপরিবর্তন কোনোদিকেই সফল হতে পারেনি। যদিও ২০২২ ও ২০২৩ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় সমাবেশসহ অনেকগুলো কর্মসূচি পালন করেছে তারা।
কথাটা কেন আসলো আমিই বা কেন বললাম? এর কারণ হলো, সম্প্রতি কারাগার থেকে মুক্ত হওয়া বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকের সঙ্গেই দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে বা অন্য পরিসরে। দেখা হলে তাদের প্রথম কথাই হলো, এরপর কী? অর্থাৎ দেশ যেভাবে চলছে এভাবেই চলবে নাকি অন্যভাবে? এগুলোই তারা জানতে চান। তাদের আন্দোলন সফল হলো না কেন? আসলে এর মূল্যায়ন তো তাদেরই করতে হবে যে, তারা কেন সফল হতে পারেননি। আমরা বরং দেখছি যে নির্বাচন হয়েছে, নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে, সরকার পরিচালিত হচ্ছে এবং সবকিছু ভালোভাবেই চলছে। আমরা বরং দেখতে পাই সরকারের কাছে এই মুহূর্তে বিএনপি কিংবা রাজনীতি কোনো ইস্যুই নয়। বরং এটাই বাস্তবতা যে সরকারের কাছে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অর্থনৈতিক পূর্ণতা।  
সরকার আর্ন্তজাতিকভাবেও বেশ শক্ত অবস্থানের দিকে এগোচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে আরো নিবিড়ভাবে কাজ করতে চায়। আমরা যেটা দেখছি যে আগে থেকেই ভারত, চীন, রাশিয়াতো আছেই এবং বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সংস্থাতেও বাংলাদেশের সক্রিয়তা আরো বেশি করে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমাদের দৃষ্টিতে বিএনপির ব্যর্থতার তিনটি কারণ আগেও বলেছি, আবারো একটু পুনঃউল্লেখ করতে চাই। একটি হলো অতিমাত্রায় বিদেশ নির্ভরতা। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র একটা কিছু করে দিবে ক্ষমতায় বসিয়ে দিবে বিএনপির প্রতিটি স্তরে এই ধারণা একদম পাকাপোক্ত ছিলো। সেটা হয়েছিলো গাজীপুর নির্বাচনের আগে মার্কিন ভিসানীতি কঠোর করায় এবং সেখানে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ থাকায়। এতে বিএনপি অতিমাত্রায় উদ্বেলিত হয়ে ভেবেছিলো সরকারের পতন অনিবার্য। যাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয় তারা একটি ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে চান, কিন্তু তারা স্বীকার করেন যে তারা নির্ভর ছিলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করেছে। তবে অনেকেই আবার মনে করেন যে আশা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সে জায়গায় নিতে পারেনি কারণ যুক্তরাষ্ট্র অতোটা আন্তারিক ছিলো না। দ্বিতীয় হলো, কিছু ইউটিউবার ও ফেসবুকার নিয়ম করে বলে গেছে ও ফেসবুকে পোস্ট করে গেছে শেখ হাসিনা সরকারের পতন অনির্বায সেটা আজ না হয় কাল। সেটা অনুসরণ করে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দরাও টকশোতে এসে বলেছেন, আজই সরকারের শেষ দিন, সরকার আর টিকবে না। তাদের পতন অনির্বায ইত্যাদি কথার্বাতা বলেছেন। ২৮ অক্টোবরের পর অবরোধ, হরতালকে ফেরত আনতে গিয়ে আগুন সন্ত্রাস যে ফেরত আসলো তাতে করে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা আমার ধারণা দলীয় কর্মীরাও ভয়ে আন্দোলনে একাত্ম হতে পারেনি। অবশ্যই সরকারের হাতে নেতৃত্ব ছিলোই।  
আরেকটি মতামত বিএনপি নেতাদের কাছ থেকে যেটা পেলাম তা হলো, তারা মনে করেন তারা আন্তর্জাতিকভাবে সফল ছিলেন কিন্তু ভারত এই নির্বাচনকে একচ্ছত্রভাবে বর্তমান সরকারকে সমর্থন করেছেন। কারণ ভারতের নিবার্চন এবং নরেন্দ্র মোদি তারই নিবার্চনের আগে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কোনো রকম পরিবর্তন চান না। সেটাই যদি একমাত্র কারণ হয়ে থাকে তাহলে রাজনীতি তো কূটনীতিরও নিয়ম। যুক্তরাষ্ট্রের উপর তাহলে এতো নির্ভরতা ছিলো কেন? যুক্তরাষ্ট্রও তো ভারতের উপর একটি ইন্দোস্পেসিফিক রাজনীতি করছে সেখানে তাদের অংকে কি এটা ছিলো না? তারা কি অংক কষতে পারেনি? উন্মুক্ত ভারত বিদ্বেষ আসলে দিন শেষে কী ফলাফল এনে দেয় বিএনপি কি সেটা বিশ্লেষণ করেছে? আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু বিএনপি নেতারা কোনো উত্তর দেয়নি। আমরা তাদের সঙ্গে যতোটুকু সম্ভব রাজনৈতিক আলোচনা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। সাংবাদিক হিসেবে আমাদের জানার আগ্রহ থেকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম। বিএনপি নেতাদের আরেকটা ভাষণ হলো, তাদের বের করার অন্যতম কারণ সরকার ও প্রশাসন নীপিড়নমূলক কাজ। গ্রেপ্তার, জেল-জুলুম, বিচার, শাস্তি ইত্যাদি। কিন্তু এটা তো স্বাভাবিক। সরকার তার পতন ঠেকাতে গেলে তার জায়গা ঠিক রাখতে গেলে বিরোধী দলের আন্দোলনের প্রতি হাত লেগে যাবে এটাই তো স্বাভাবিক। দলের নেতৃত্ব এবং সাংগঠনিক দুর্বলতা কিংবা আন্দোলনে বিদ্বেষ নির্ভরতার কথা তারা আলোচনাতে আনতেই চান না। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে আন্দোলনে যুক্ত করেও তারা সফল হয়নি সেটিও তারা মানতে চাননি।  
সোজা হিসেবে দেখলে একটা আন্দোলনকে যৌক্তিক পরিণতিতে নিতে গেলে যে দুরদর্শিতা, পরিকল্পনা বা প্রস্তুতির দরকার সেটা বিএনপির নেতৃত্ব তা দক্ষতার সঙ্গে করতে পারেনি। বিশেষ করে আন্দোলন ব্যর্থ করতে সরকার যেসব ব্যবস্থা-কৌশল নিয়েছিলো তা মোকাবেলা করার পাল্টা কৌশল বা প্রস্তুতি ছিলো না বিএনপির ভেতরে। নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলে তাদর সঙ্গে এই কথাগুলো উঠে। কিন্তু বিএনপি যে দমননীতির কথা বলছেন সেটা কি কোনো সরকার করেনি? সব সরকারই তো তার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হবে সেটাকে দমন করার চেষ্টা করবে। প্রশ্ন হলো এর বিকল্প ছিলো কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে প্রশাসন এবং রাষ্ট্রতন্ত্রকে নিরপেক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব ছিলো। কিন্তু বিএনপি তা করেনি বরং আমরা দেখেছি প্রসাশনকে, পুলিশকে হুমকি দেওয়া হয়েছে যে, ক্ষমতায় আসলে দেখা যাবে। এটিও একধরনের অরাজনৈতিক গোয়ার্তুমি বলতে পারি আমরা। বিএনপি এবং সমমনা জোটের একাধিক নেতা যাদের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয় তারা বলেন এবারের ¬¬আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন আট বছরের বেশি সময় ধরে ভারতে থাকা বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ। দলের প্রধান নেতা লন্ডনে, ¬¬আন্দোলনের নেতা ভারতে দু’জনই যদি দেশের বাইরে থেকে পালিত হয় তাহলে সফল হয় কী করে?
তারেক রহমান দলের হাল ধরে আছেন। কারণ তার মা অসুস্থ এবং একইসঙ্গে কারাবন্দীও হয়। এখনো পর্যন্ত তার একটা পরিষ্কার বার্তা পাওয়া গেলো না যে নির্বাচনে তারা কেন ব্যর্থ হয়েছেন, অথবা এই ব্যর্থতা থেকে তারা আগামী দিনগুলোতে কীভাবে দলকে পরিচালিত করবে। আমরা বিএনপি নেতাদের অনেকের সঙ্গেই কথা বলে বুঝতে পারি এখন পর্যন্ত তারা একটা বিশ্লেষণী ধারণার মধ্যে আছেন এবং একটা হ্যাঙ্গওভারের মধ্যেও আছে বলা যায়। আন্দোলন পুলিশি অ্যাকশন, জেল তারপর বেরিয়ে আসা, ব্যবসা-বাণিজ্য করা, নিজেদের ব্যবসা ঠিক রাখা ইত্যাদি। অতীতের অভিজ্ঞতায় আমরা যেটা দেখেছি যেকোনো বৃহত্তর আন্দোলনে ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবীদের মূখ্য ভূমিকা থাকে। বিএনপির এবারের কোনো আন্দোলনে এই তিন শ্রেণির উল্লেখযোগ্য কোনো অংশগ্রহণ ছিলো না। শুধু দলীয় নেতাকর্মীদের বড় উপস্থিতি দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে নিজের শক্ত অবস্থান জানান দেওয়া যায় না। আমরা যেটা আবারো বলছি, ছাত্র তো আছেই শ্রমিক আছে এবং পেশাজীবীদের যে একটা মুখ্য ভূমিকা থাকে আন্দোলনে অতীতেও দেখেছি যেটা শেখ হাসিনার ১৯৯৬ সালের আন্দোলনে দেখা গেছে। আমরা ২০০৬ সালের আন্দোলনেও দেখেছি। যা শেখ হাসিনা করতে পেরেছিলেন। দলীয়কর্মীরা শত আন্দোলন, সংগ্রাম করেছেন, পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে মাটি কামড়ে রাস্তায় পরে থাকতে দেখা যায়। সেই জায়গাগুলো বিশ্লেষণ করবেন কিনা বিএনপি নেতারা সেটাই জানার বিষয়। তবে এই যে একটা ধারণা বিএনপি আন্দোলন পারে না আন্দোলনে সফল হয় না এই ধারণা ভাঙ্গা সহজ নয় বলতে গেলে তা এখন স্ট্যাব্লিস হয়ে গেছে। লেখকের ভিডিও কনটেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন স্মিতা আহমেদ

news24bd.tv/ডিডি
 

সম্পর্কিত খবর