সোমালিয়ার জলদস্যুদের জাহাজ আটক ও মুক্তিপণ আদায়ের কৌশল

সোমালিয়ার জলদস্যু

সোমালিয়ার জলদস্যুদের জাহাজ আটক ও মুক্তিপণ আদায়ের কৌশল

দেলোয়ার হোসেন লিটু

সম্প্রতি বার বার আলোচনায় আসছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। লোহিত সাগরে হুথিদের  নিয়ে অন্যান্য দেশ ব্যস্ত থাকায় ভারত মহাসাগরের আশপাশে আবার মাথা চাড়া দিচ্ছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। এছাড়া বিশ্বের যেসব নৌপথ ঘেঁষে জলদস্যুদের বিচরণ রয়েছে তার অন্যতম সোমালিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো।

 

বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যের সিংহভাগ মালামাল পরিবহন হয়ে থাকে সমুদ্রপথে। এসব পথের যেকোনও ধরনের বিপর্যয় কিংবা হুমকি বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। যে কারণে অনেক দেশ বৈশ্বিক শিপিং রুটগুলোতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা মোতায়েন করে। সোমালিয়ার উপকূল–সংলগ্ন সমুদ্রপথ বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুট।

অ্যাডেন উপসাগরের এক উপকূলে ইয়েমেন। অন্য উপকূলে সোমালিয়া, জিবুতি, ইরিত্রিয়া। বিশ্ববাণিজ্যের বড় একটা অংশ এই জলপথে হয়ে থাকে। তাই এ অঞ্চলে জলদস্যুদের উৎপাত ভাবিয়ে তোলে পুরো বিশ্বকে। ২০১০-১১ সালের দিকে মাত্রা ছাড়ায় জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য।  

জাতিসংঘের আওতাধীন আন্তর্জাতিক সমুদ্র সংস্থার (আইএমও) তথ্যমতে, আগের বছরের তুলনায় ২০১০ সালে জলদস্যুতা ২০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল।

জলদ্যুদের উত্থানের পিছনের গল্প: 

১৯৬০ সালে ইতালিয়ান ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে জন্ম হয় সোমালিয়ার। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসনের উৎখাতের পরে নৈরাজ্যের মধ্যে পড়ে দেশটি। পরের দুই দশকের বেশি সময় যুদ্ধবিগ্রহে বিধ্বস্ত সোমলিয়াতে কার্যকর কোন সরকার ছিল না। এই সময়ে আফ্রিকার মধ্যে দীর্ঘতম উপকূল সমৃদ্ধ দেশটির জলসীমার নিরাপত্তায় কোন কোস্টগার্ড বা বাহিনী ছিল না।

ফলে বিদেশিদের মাছ ধরার হার এ অঞ্চলে বাড়তে থাকে। এতে স্থানীয় জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। ফলে, তারা দস্যুবৃত্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে। ইন্ডিয়ান ওশান কমিশনের সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতেও ওই সময়ের দস্যুতার নেপথ্যে এই কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে। তাছাড়া, মৎস শিকারের চেয়ে দস্যুতায় আয়ের পরিমাণও অনেকগুণ বেশি। তবে, কয়েক বছর তাদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ওই রুটে তাদের সামরিক উপস্থিতি বাড়ায়।

জলদস্যুদের অস্ত্র: 

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্যানুসারে, জলদস্যুদের রয়েছে আলাদা অস্ত্রশস্ত্র। এর মধ্যে অন্যতম হলো একে৪৭, একেএম, টাইপ৫৬, টিটি৩৩, পিকে, আরপিজি৭ ইত্যাদি। এছাড়া জলদস্যুরা আরজিবি৫ ও এফ১ এর মতো শক্তিশালী হাতবোমারও ব্যবহার করে থাকে তারা।

জলদস্যুদের আক্রমণ ও মুক্তিপণ আদায়ের প্রক্রিয়া: 

২০০৫ সালের পর থেকে সোমালিয়ান জলদস্যুরা সংঘবদ্ধ হয়ে বৃহৎ পরিসরে আক্রমণ শুরু করে। সমুদ্র বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতার কারণে তারা কেবল ক্ষিপ্রগতিতেই নয় বরং আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হানা দেয়। যা তাদের দস্যুবৃত্তিতে অনেকটাই এগিয়ে নিয়েছে। আক্রমণের সময় হিসেবে তারা মূলত রাত কিংবা ভোরের দিকটাকেই বেছে নেয়। জলদস্যুরা বড় জাহাজগুলোর কাছে পৌঁছাতে ছোট ছোট মটর চালিত নৌকা ব্যবহার করত। যা দ্রুত গতির পাশাপাশি বড় জাহাজের রাডারে সহজে ধরা পড়ে না।

অতীতের আক্রমণগুলো বিশ্লেষণ করে জানা যায়, জলদস্যুরা সাধারণত জাহাজগুলোর পেছন দিক থেকে আক্রমণ চালায়। এক মাথায় হুক লাগানো লম্বা দড়িতে চেপে তারা দ্রুত জাহাজে উঠে যায়। যা মূলত জাহাজের পেছন দিকে লাগানো হুকের সঙ্গে আটকানো হয়।

বন্দিদের কাছ থেকে জলদস্যুরা মূলত ইউএস ডলারের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করে। এসব মুক্তিপণের অর্থ পরিশোধের জন্য মূলত তা বস্তায় ভরে হেলিকপ্টার থেকে ফেলে দেওয়া হয় বা ছোট নৌকায় করে ওয়াটার প্রুফ ব্যাগের মাধ্যমে পাঠানো হয়। এমনকি মাঝে মধ্যে প্যারাসুটের মাধ্যমেও এই মুক্তিপণের টাকা জলদস্যুদের কাছে পৌঁছানো হয়।

দস্যুদের উদ্দেশ্য কী? আয় কেমন?

২০০৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত সময়কালে হর্ন অফ আফ্রিকার দস্যুরা কী পরিমাণ অর্থ আদায় করেছে তার একটি আনুমানিক হিসাব করেছে বিশ্বব্যাংক। সেই হিসাব অনুযায়ী, জলদস্যুরা ক্রুদের জিম্মি করে সাড়ে ৩০০ থেকে সোয়া ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ আদায় করেছে।

এই পরিসংখ্যান তুলে ধরে নাইজেরিয়ার ফেডারেল ইউনিভার্সিটির লেকচারার স্যামুয়েল ওয়েওল বলেন, ছিনতাইয়ের পেছনে মূল লক্ষ্য মুক্তিপণ আদায় বলেই ধারণা করা যায়। অন্তত সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর নেপথ্য এটিই মূল কারণ।

২০১১ সালে একটি তেলের ট্যাংকার জব্দ করে দস্যুরা। ২০০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের জ্বালানি ছিলো নৌযানটিতে। আটক দুই ফিলিপিনো ক্রুকে হত্যা করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ওশেন বিয়ন্ড পাইরেসির প্রতিবেদন বলছে, সাগরে দস্যুতার কারণে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে সাত থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার।

দস্যুদের সঙ্গে পেরে ওঠা যায় না কেন:

জাহাজের মালিকদের দ্রুতগতিতে ভ্রমণের মতো পরামর্শ দিয়ে থাকে আইএমবি। যাতে জলদস্যুরা তাদের ধরতে না পারে। কিন্তু, জলদস্যুরাও ঝটিকা আক্রমণ চালায়। প্রায়শই রাতের অন্ধকারে হাজির হয় তারা। তাই, ক্রুরা ঘটনা বুঝে উঠতেই দেরি হয়ে যায়।

একবার জলদস্যুরা কোনো জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলে, সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়। কারণ, তাতে জিম্মিদের হতাহত হওয়ার আশংকা বাড়ে। গভীর সমুদ্রে আটক জলদস্যুদের বিচারের মুখোমুখি করতে জটিলতার কারণে কখনো কখনো ছেড়েও দেওয়া হতো।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি রেজুলেশন আছে যাতে নিরাপত্তায় নিয়োজিত দেশগুলোকে সোমালি জলসীমায় দস্যুদের ধরার অনুমতির কথা বলা আছে।

মোকাবেলায় প্রতিবন্ধকতা: 

ইইউন্যাভ ফর আটালান্টা বলছে তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের ভাষ্য, ওই এলাকায় নিয়োজিত অন্যান্য বাহিনীর সাথে যৌথ প্রচেষ্টায় দস্যুবৃত্তির পুনরায় ব্যাপকভাবে ফিরে আসা ঠেকাতে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাহিনীগুলোর সাফল্যও কম নয়। ইউরোপিয়ান নৌবাহিনীর পাশাপাশি ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর সামরিক উপস্থিতি অনেক দস্যুতার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে।

কিন্তু, আইওসি’র অভিযোগ ইইউন্যাভ "বর্তমানে স্প্যানিশ নৌবাহিনীর একটি মাত্র জাহাজ দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। "ভারতীয় নৌবাহিনী ছাড়া জলদস্যুতা প্রতিরোধে সক্রিয় থাকা অন্য নৌবাহিনীগুলোর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা হয়েছে। "

মি. ওয়েওল সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সোমালিয়ায় হামলা মোকাবেলার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দুটি ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে নজর দিতে হবে।

লুটের অর্থ বিনিয়োগে জলদস্যুদের স্টক এক্সচেঞ্জ:

সোমালিয়ার জলদস্যুরা দীর্ঘদিন ধরে জাহাজ লুট, নাবিকদের অপহরণের সঙ্গে জড়িত। মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায়, হত্যার পাশাপাশি দুর্ধর্ষ সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে তারা। আর এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তাদের আছে নিজস্ব স্টক এক্সচেঞ্জও। অর্থ বা অস্ত্র দিয়ে এই স্টক এক্সচেঞ্জে বিনিয়োগ করা যায়, অভিযান সফল হলে পাওয়া যায় লভ্যাংশ!

স্টক এক্সচেঞ্জে বিনিময়ের মূল নীতি হলো, প্রতিবার জলদস্যু অভিযান সফল হলে বিনিয়োগকারীরা লাভের একটি অংশ পান। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বিনিয়োগকারী এক মাসে ৭৫ হাজার ডলারও উপার্জন করেছেন, যা তার কাছে অকল্পনীয় বিষয় ছিল। এমন লাভবান হওয়ায় আরও বেশি মানুষ জলদস্যু স্টক এক্সচেঞ্জে বিনিয়োগে আগ্রহী হন।  
 
এরইমধ্যে এই চর্চা মূলধারার হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। কিছু ওয়েবসাইট দাবি করছে, সোমালিয়ার অনেক সরকারি কর্মকর্তাও দেশটির অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য মুক্তিপণ থেকে একটি অংশ পান।

সোমালিয়া পাইরেসি স্টক এক্সচেঞ্জ কীভাবে কাজ করে? জানা গেছে, লাভজনক বাণিজ্য রুট ঠিক করার জন্য সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে পরামর্শ করে জলদস্যুরা। লাভজনক মিশন থাকলে তারা জলদস্যু স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে যোগাযোগ করে। যে কেউ খাদ্য, অস্ত্র বা নগদ অর্থ দিয়ে মিশনে অংশগ্রহণ করতে পারে। রয়টার্স বলছে, শেয়ারগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত।

সাম্প্রতিক হামলা: 

সম্প্রতি জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী বা ইইউন্যাভ ফর আটালান্টার মতে গত বছরের নভেম্বরে থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে সোমালিয়া উপকূলে অন্তত ১৪ টি জাহাজ ছিনতাই হয়েছে।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে সোমালিয়ার এ দস্যুদল ইরানের পতাকাবাহী একটি জাহাজ অপহরণ করে। ওই সময়ে জাহাজটিতে ইরানের ১৭ নাগরিক ছিলেন। একই মাসে ইরানের পতাকাবাহী আরেকটি মাছ ধরার জাহাজ এফভি আল নাঈমিতে ১১ জন সশস্ত্র জলদস্যু আক্রমণ করে। এ সময় তারা ১৯ জন ক্রু সদস্যকে জিম্মি করে। পরবর্তীতে ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ আইএনএস সুমিত্র তাদের উদ্ধার করে।

ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরো- আইএমবি’র মতে, এটি ছিল ছয় বছরের মধ্যে সোমালিয়ায় প্রথম সফল জাহাজ ছিনতাই। বিবিসি’র রিয়েলিটি চেক টিমের প্রতিবেদন বলছে, শুধু ২০১৮ সালেই পূর্ব আফ্রিকান জলসীমায় ১১২ টি নৌ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে।

news24bd.tv/DHL