সাদী মুহম্মদ আত্মঘাতী আবেগে গা ভাসালেন

সাদি মুহম্মদ

সাদী মুহম্মদ আত্মঘাতী আবেগে গা ভাসালেন

রফি হক

সাদী মুহম্মদ ভাই স্বেচ্ছায় চলে গেলেন ! অবিশ্বাস্য ।
কার ওপর অভিমান করলেন সাদী ভাই ? যে দেশে শিল্পীরা নানাভাবে অপমানিত হয়, ষড়যন্ত্রের শিকার হয়, শিল্পীরা অসম্মানিত হয় পদে পদে--সেইদেশে অভিমান করা সাজে সাদী ভাই ? অভিমান একটি আত্মঘাতী আবেগ, আপনি নিজেই সে আবেগে গা ভাসালেন ?
.চলার পথে মানুষের জীবনে-- নানা সময়ে এক একটি পর্ব আসে। আমার জীবনের একটি পর্ব ছিল সাদী মুহম্মদময় । আমার বলা ভুল হলো।

আমাদের কয়েকজনের জীবনে। ১৯৯০ -এর দশকের মধ্য সময়ে সাদী ভাই খুব আর্ট কলেজে আসতেন। তিনি আসতেন সন্ধ্যায় পরে পরে। আর্ট কলেজের বাইরে কয়েকটি চায়ের টং ছিল।
আর আর্ট কলেজের উল্টো দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুখে ছিল "মোল্লার চায়ের টং"। আমরা বলতাম "মোল্লার ক্যন্টিন"। মোল্লার ক্যান্টিন খুব বিখ্যাত ছিল। আর্টিস্টদের জীবনে মোল্লার ক্যান্টিনের নাম জাগরূক থাকবে। সাদী ভাই প্রতিদিন নিয়ম করে ওখানে আসতেন। আমরা ওখানেই আড্ডা দিতাম। সাতটা আটটা নয়টা পর্যন্ত।  
আমাদের কয়েকজনের সাদী ভাইয়ের দারুণ বন্ধুত্ব হলো। এখানে কারো নাম উল্লেখ করছি না। তারা আমার সহপাঠী ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমরা কলেজের ভেতরে ডিপার্টমেন্টে কাজ করতাম। সাদী ভাই কলেজের ভেতরেও এসেছেন। কখনও সামনের পন্ডের ধারে বসতেন, কখনও আমাদের ডিপার্টমেন্টের সামনে ডোয়ায় বসতেন। আমরা কয়েকজন গল্প করতাম।
.সাদী ভাই তাঁর বাবার কথা খুব বলতেন। কী করে একাত্তরে বালক সাদী মুহম্মদের সমুখে পাকিস্তান আর্মি গুলি ক্রে মেরেছিল, আর বিহারীরা তাঁদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল। তাঁর মা প্রাণ বাঁচাতে দোতলা থেকে নিচে ঝাঁপ দেন, প্রাণে বেঁচে গেলেও আজীবন ক্রাঁচে ভর করে ছুটেছেন। একদম শেষের কয়েক বছর হুইল চেয়েরে:+। তাঁর চোখ ছলছল করত। কণ্ঠে বাষ্প জমতো, তিনি থেমে যেতেন। ... 
আমি যখনকার কথা বলছি তখোন দেশে প্রবল আন্দোলন চলছে। জ্বালাও-পোড়াও-হারতালের সময়। চব্বিশ ঘন্টা, ছত্রিশ ঘন্টা, বাহাত্তর ঘন্টা লাগাতার হরতালের সময়। ... ফলে নগরী প্রায় প্রায় সুনসান নীরব হয়ে যেত। এমনটা হলে সাদী ভাই আমি সহ আমার দুজন বন্ধু ঢাকা থেকে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়তাম রাতে। কয়েক দিনের জন্য। কখনও কুমিল্লা গেছি, কখনও টাঙ্গাইল, কখনও ময়মনসিংহ। সে-সব মেলা মজার মজার অভিজ্ঞতা হতো আমাদের। আজ চোখের ওপর ভাসছে সেইসব দিনগুলো।  
তবে সাদী ভাইকে আমরা খুব ভালোবাসতাম। তিনি শিশুর মতো একজন মানুষ ছিলেন। একবার আমাকে বললেন, রফি আমার ক্যাসেটের কাভার করে দিতে হবে। আমি জীবনে খুব একটা ডিজাইন বা বুক কাভার বা লগো ডিজাইন--ইত্যাদি করিনি। ফলে আমি এসব অনুরোধ এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু সাদী ভাই তাঁর "মাকে মনে পড়ে"-র ক্যাসেটের ডিজাইন করিয়ে নিলেন। খুব খুশি হয়েছিলেন। ফটোগ্রাফী করেছিলেন আমার আরেক গুণী সহপাঠী । আমার চেয়ে আমার সহপাঠী বন্ধুর সঙ্গে সাদী ভাইয়ের ভাব বা বন্ধুত্ব বেশি ছিল।  

আরেকদিন সাদী ভাই বললেন : রফি, পাপ্পুদির গানের স্কুলের লগোটা করে দিতে হবে। পাপ্পুদি মানে শিল্পী পাপিয়া সরোয়ার। পাপ্পুদির বিখ্যাত গান : "নাই টেলিফোন, নাইরে পিওন নাইরে টেলিগ্রাম..."। আমাকে সঙ্গে করে পাপ্পুদির ধানমন্ডির বাড়িতে নিয়ে গেলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন। আরে, এরপর থেকে তিনি আমাদেরও পাপ্পুদি হয়ে গেলেন। আমি লগোটি করে দিয়েছিলাম। পাপিয়া সরোয়ার--ইনি আরেকজন অমায়িক শিল্পী মানুষ।
.এরপর আমরা আর্ট কলেজে এক পূর্ণ-চাঁদের রাতে লিচুতলায় সাদী ভাইয়ের নির্বাচিত গান নিয়ে তাঁর একক সঙ্গীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। অমন স্নিগ্ধ মিষ্টি গানের অনুষ্ঠান আমি আমার জীবনে আর দেখিনি, দেখবও না। জ্যোছনার আধো আধো আবছা আলোর মধ্যে সাদী মুহম্মদ গাইছেন, পঞ্চকবির গান, রবীন্দ্রনাথের গান--আর্ট কলেজের ওই কবিতাময় পরিবেশের মধ্যে। আর্ট কলেজের ছেলেমেয়েরা এল সেপের করিডোরে ডোয়ায় বসেছে, পন্ডে বসেছে । লিচুতলার সামনের ঘাসে বসেছে। প্রিন্টমেকিং ডিপার্টমেন্টের অর্ধ বৃত্তকার ছাদে বসেছে। আর সাদী ভাইয়ের জল চৌকির মতো মঞ্চটা হয়েছে ঠিক লিচু তলে পন্ডের দিকে মুখ করে। অপূর্ব... অপূর্ব । যারা সে প্রোগ্রামটি দেখেছে তারা কোনোদিন ভুলবে না।
.
সেই সাদী ভাই চলে গেলেন স্বেচ্ছায় ? শিল্পীদের অভিমান বড়ো সাংঘাতিক। জানা হলো না কিছুই । সাদী ভাইকে আর কোথাও দেখবো না? এ জীবনে আর দেখা হবে না !! হায়, অভিমান ।

( বানানরীতি লেখকের নিজস্ব)

লেখক পরিচিতি: একজন পেইন্টার ও সম্পাদক, আর্ট জার্নাল

news24bd.tv/ডিডি

সম্পর্কিত খবর