বদলে যাচ্ছে গ্রাম

আগের আর এখনকার গ্রামের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন

হারিকেন আলো থেকে বিদ্যুৎ, চিঠি থেকে ম্যাসেঞ্জার

বদলে যাচ্ছে গ্রাম

মো. ইস্রাফিল আলম

স্পট: ইউনিয়ন ধূলিয়ানী

২৫ বছর আগের কথা, এক বর্ষার সকালে পায়ে হেঁটে বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরের স্কুলে যাচ্ছিলেন আশিক (ছদ্মনাম)। ভোরে এক পশলা বৃষ্টি, রাস্তায় জমে গেছে কাঁদা; তাই বাইসাইকেল বাড়িতে রেখেই তাকে যেতে হচ্ছে স্কুলে। স্কুলের পথে কপোতাক্ষ নদ। খেয়া পার হতে হবে।

আশিকের মতো অন্য শিক্ষার্থীরাও একইভাবে স্কুলে যাচ্ছিলেন। খেয়া পার হওয়ার সময় ঘটল বিপর্যয়। শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়দের নিয়ে ডুবে গেল নৌকাটি। স্কুলে যেতে পারলেন না শিক্ষার্থীরা।
কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হলো তাদের। এটা ১৯৯৯ সালে যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার ধূলিয়ানী ইউনিয়নের একটি ঘটনা। শিক্ষার্থীরা সম্মিলনী হাইস্কুল, ধূলিয়ানী যেতে গিয়ে প্রয়াই এ ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতেন।   

ওই সময় ইউনিয়নটিতে কোনো পাকা রাস্তা ছিল না। নদীতে সেতু ছিল না। হারিকেনের আলোয় পড়তে হতো শিক্ষার্থীদের। ২০২৪ সালে এসে সেই দৃশ্যপট একেবারেই বদলে গেছে। ইউনিয়নের প্রধান প্রধান সব রাস্তা আজ পাকা। নদীর ওপর বিশাল সেতু হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির মধ্যে অনায়াসে তাদের বাইসাইকেল নিয়ে স্কুলে যেতে পারে। শুধু রাস্তাঘাট নয়; ইউনিয়নের বেশিরভাগ বাড়িই এখন পাকা। বিদ্যুৎ সংযোগ, বাড়িতে বাড়িতে টেলিশিভন, রয়েছে ডিশ লাইন, আছে ইন্টারনেট সংযোগ, মানুষের হাতে হাতে মোবাইল ফোন। প্রযুক্তিগত প্রয়োজন মেটাতে আগে যেখানে উপজেলা বা জেলাতে যেতে হতো, সেখানে ইউনিয়নেই এসব সুবিধা পাচ্ছেন বাসিন্দারা। যেন বদলে যাওয়া এক ইউনিয়ন ধূলিয়ানী।  

বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যার স্বপ্ন

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর আরও শোচনীয় ছিল গ্রামের অবস্থা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে গ্রামের রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ছিল বিধ্বস্ত। বিদ্যুৎসহ আধুনিক সুবিধা ছিল না বললেই চলে। সেই ভঙ্গুর অবস্থা থেকে গ্রামগুলো আজকের অবস্থায় এমনি আসেনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়েই আজকের এই পরিবর্তন। জাতির পিতা সব সময়ই গ্রাম এবং গরিব-দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা বলতেন। পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর চিন্তাও পিতার মতো। তাঁর চিন্তা, কীভাবে গ্রামের জন্য শহরের সকল সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায়। তাঁর ভাবনা, উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা হিসেবে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে তৈরি করা হবে দেশের গ্রামগুলো। পর্যায়ক্রমে তা বাড়িয়ে ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত বাংলাদেশের সকল গ্রামকেই এর অন্তর্ভুক্ত করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর সেই চিন্তা আজ বাস্তবের পথে। তাঁর নেতৃত্বে উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে গ্রামের অবয়ব।

২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেই ছিল ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ অঙ্গীকার। সেই আঙ্গীকারের আলোকে প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ ও বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার বিভাগ কর্মপরিকল্পনায় এগিয়েছে গ্রাম।

‘আমার গ্রাম-আমার শহর’

‘আমার গ্রাম আমার শহর’ এই অঙ্গীকারের  লক্ষ্য দেশের প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধার সম্প্রসারণ। অঙ্গীকারের সবচেয়ে ইতিবাচক হলো, উন্নয়ন চিন্তার মধ্যে গ্রামকে স্থান দেওয়া। নাগরিক আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা এবং নাগরিক অধিকার গ্রামেও নিশ্চিত করা। গ্রামের স্বকীয়তা বজায় রেখে শহরের সব সুযোগ-সুবিধা গ্রামেই যাতে পাওয়া যায়, তার ব্যবস্থা করা। নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-ডোবা অক্ষত রাখা; তেমনি গাছপালা, বন-বাদাড়, তরুণ, লতাগুল্ম, দিগন্তবিস্মৃত মাঠ, খেতখামার, বনবীথিসব রেখেই পরিবেশবান্ধব আধুনিক বাংলাদেশ গড়া। শহরের সম্ভাব্য সব ধরনের সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেওয়া। প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া। পাকা সড়কের মাধ্যমে সকল গ্রামকে জেলা-উপজেলা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করা। ছেলেমেয়েদের উন্নত পরিবেশে লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি করা। সুপেয় পানি এবং উন্নতমানের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সুস্থ বিনোদন এবং খেলাধুলার জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলা । কর্মসংস্থানের জন্য জেলা-উপজেলায় কলকারখানা গড়ে তোলা । ইন্টারনেট, তথ্যপ্রযুক্তি সুবিধা প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া।

সরকার গঠনের পর এসব বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ঘোষণা দিয়ে গ্রামে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছেন। সরকারের ২০টি মন্ত্রণালয়ের ২৬টি সংস্থা ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ সকল মন্ত্রণালয় ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২৪৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ২০২০ সালে স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়, যাতে আটটি বিষয় ছিল। বিষয়সমূহ হলো- গ্রামীণ যোগাযোগ, গ্রামীণ গ্রোথ সেন্টার ও হাটবাজার, গ্রামীণ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কম্যুনিটি স্পেস ও বিনোদন ব্যবস্থা, উপজেলা মাস্টার প্ল্যান, গ্রামীণ গৃহায়ন এবং উপজেলা পরিষদ ইউনিয়ন পরিষদের সক্ষমতা বৃদ্ধি। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদিত এ কর্মপরিকল্পনায় উল্লিখিত আটটি বিষয়ে দেশব্যাপী পরিকল্পিতভাবে ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ৩০টি গাইডলাইন/নীতিমালা তৈরি এবং ৩৬টি সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। পাশাপাশি রূপকল্প ২০৪১ সামনে রেখে দেশের গ্রামগুলোকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার জন্য ১৫টি পাইলট গ্রাম উন্নয়নের একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়। সূত্র: স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তি ও এলজিইডি  (https://file.portal.gov.bd/uploads/ac77d78c-ffda-452f-b95f-3a82afe17074//62f/951/453/62f951453dd1f999870214.pdf)।

যেভাবে উন্নয়নে রোল মডেল 

গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা শুরু হয় ১৯৬৩-১৯৬৪ সালে পল্লিপূর্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় পরিকল্পনার আওতায় এই কার্যক্রম শুরু হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা ও নেতৃত্বে প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-১৯৭৮) এর অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে। এ-পরিকল্পনায় গ্রামীণ এলাকায় অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ হাট-বাজার উন্নয়ন এবং রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কারের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ৮০-এর দশকের শুরুতে পল্লি উন্নয়নের মূল প্রভাবক হিসেবে পল্লি সড়ক উন্নয়নকে গুরুত্বের সঙ্গে উন্নয়ন পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একইসঙ্গে যে সকল গ্রামীণ হাট বাজারের ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নকেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন ১৪০৮টি গ্রামীণ হাট বাজারকে গ্রোথসেন্টার হিসেবে চিহ্নিত করে গেজেট প্রকাশিত হয়। এসব গ্রোথসেন্টার ও অন্যান্য হাটবাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্থাপিত সংযোগের ভিত্তিতে গ্রামীণ সড়কগুলোকে ৪টি ভাগে বিভক্ত করা হয়। এগুলো হচ্ছে- ফিডার সড়ক, আর-১ সড়ক, আর-২ সড়ক ও আর-৩ সড়ক।

১৯৮৮ সালে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ফরিদপুর জেলায় সাউথওয়েস্ট রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় দুইটি সড়কের সড়কবাঁধ (এমবেঙ্কমেন্ট) এলজিইবি এর মাধ্যমে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় পাইলট হিসেবে নির্মাণে সম্মত হয়। পাইলট কাজের সাফল্যের ভিত্তিতে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ‘স্পেশাল ফুড ফর ওয়ার্কস’-এর আওতায় ‘গ্রোথসেন্টার কানেক্টিং রোড (জিসিসিআর) কর্মসূচি নিয়ে আসে। এ কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল মাটির কাজের মাধ্যমে গ্রোথসেন্টার সংযোগকারী সড়কের উন্নয়ন। এই কর্মসূচি গ্রহণের আগ পর্যন্ত জেলা পরিষদের মালিকানাধীন কিছু সংখ্যক সড়ক ব্যতীত গ্রামীণ সড়কগুলো ছিল অপ্রশস্ত, কিছু ক্ষেত্রে খুবই সরু এবং কিছু ক্ষেত্রে শুধু মাটির আইল। কোনো রকমের জমি অধিগ্রহণ ছাড়া কেবল জনগণকে সামাজিকভাবে উদ্বুদ্ধ করে মাটির কাজ দ্বারা এসব সড়ক উন্নয়নের মাধ্যমে দেশব্যাপী সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা ছিল সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ। জিসিসিআর কর্মসূচির মাধ্যমে সড়কের উপরিভাগ ২৪ ফুট চওড়া করে মাটির সড়ক নির্মাণ করা হয়।

২০০৩ সাল পর্যন্ত চলমান এই কার্যক্রমে প্রায় ৩০ হাজার কিলোমিটার সড়ক এবং ১২ হাজার মিটার সেতু-কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে ‘গ্রোথসেন্টার কানেক্টিং রোড’ কর্মসূচিই প্রথম কর্মসূচি, যার মাধ্যমে পরিকল্পিত উপায়ে দেশের সকল গ্রোথসেন্টারকে ২৪ ফুট প্রস্থের এমবেঙ্কমেন্ট দ্বারা জাতীয় মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। এদিকে ১৯৯৫ সালে কেয়ার বাংলাদেশ পিএল-৪৮০, টাইটেল-২ এর আওতায় ইউএসএআইডি কর্তৃক বরাদ্দকৃত খাদ্য সহায়তায় “ইন্টিগ্রেটেড ফুড ফর ডেভেলপমেন্ট' প্রকল্পের কাজ শুরু করে। এর মাধ্যমে ১৯৯৫-২০০০ সময়কালে দেশের সকল ইউনিয়ন পরিষদকে ১৮ ফুট প্রস্থের সড়ক দ্বারা সংযুক্ত করা হয়। এ কর্মসূচির আওতায় প্রায় ৬০ হাজার কিলোমিটার মাটির সড়ক নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে এলজিইডির আওতাধীন সড়কের দৈর্ঘ্য (পাকা ও কাঁচা মাটির সড়ক মিলে) সাড়ে তিন লাখ কিলোমিটারের ওপরে। এ বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে কোনো ধরনের জমি অধিগ্রহণ ছাড়াই জনগণের দানে। বিশ্বব্যাপী জনঅংশগ্রহণে এতো বড় সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠার নজির বোধ হয় আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। মূলত এ দুটি কর্মসূচিই দেশের গ্রামীণ সড়ক নেটওয়ার্ক-এর পরিকল্পিত ‘ব্যাক বোন’ তৈরি করেছে।

পরে ২০০৩ সালে সড়কসমূহ ছয়টি শ্রেণিতে পুনর্বিন্যাস করে এর উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পুনর্নির্ধারণ করা হয়। এলজিইডি উপজেলা সড়ক, ইউনিয়ন সড়ক এবং গ্রাম সড়ক (গ্রাম সড়ক-এ ও ২ কি.মি. পর্যন্ত গ্রাম সড়ক-বি) এর উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং এসব সড়কের ওপর ১৫০০ মিটার পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের সেতু নির্মাণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে প্রণীত বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জাতির পিতা গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের যে রূপরেখা দিয়েছিলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছরে তা অনেকাংশে অর্জিত হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ পল্লি অবকাঠামো উন্নয়নে উন্নয়নশীল বিশ্বের রোল মডেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আগ্রহে পল্লি অবকাঠামোয় বিনিয়োগ অনেক বেড়েছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-এসডিজি'র টার্গেট ৯.১-এর একটি সূচক হলো ‘সব মৌসুমে চলাচলের উপযোগী সড়কের দুই কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী গ্রামীণ জনসংখ্যার অনুপাত’। দেশের কিছু হাওড়, দ্বীপাঞ্চল এবং দুর্গম পাহাড়ি জনপদ ছাড়া প্রায় সব উপজেলায় এ সূচকের মান শতভাগ।

বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখা গেছে, দেশব্যাপী এ সূচকের গড় মান প্রায় ৮৮ শতাংশ, যা উন্নয়নশীল অধিকাংশ দেশের চেয়ে বেশি। আশা করা যায়, এ সূচকে বাংলাদেশ সহজেই এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করবে। গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের ফলে প্রান্তিক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এসব সড়ক উন্নয়নের ফলে শিক্ষার হার বৃদ্ধিসহ ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার কমেছে। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের প্রবেশগম্যতা বেড়েছে। গ্রোথসেন্টার উন্নয়নের ফলে কৃষি ও অকৃষি পণ্যের বাজারজাত করা সহজতর হয়েছে এবং পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে, বেড়েছে গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক কার্যক্রম। এসব কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও মাথাপিছু আয় বেড়েছে, ফলে জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে।

এলজিইডি স্থানীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের কৃষি ও অকৃষি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র হ্রাসসহ পল্লি ও নগর উন্নয়নের শক্তিশালী ভিত নির্মাণ করছে, যা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত সোনার বাংলা বিনির্মাণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছে। স্থানীয় পর্যায়ে অবকাঠামো উন্নয়নে এলজিইডির ভূমিকা আজ বিশ্ব স্বীকৃত।

জাতীয় তথ্য বাতায়নের ৭ নভেম্বর, ২০২১ এ সর্বশেষ হাল-নাগাদ তথ্য বলছে, সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় গত ১০ বছরে গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- ১. স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার উন্নয়ন। জনগণের সুবিধা প্রাপ্তির ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন। ২. যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে ১০ বছরে ১,৯২,৭৩৯.৬৭ কোটি টাকা ব্যায়ে ৩১১টি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।   যার মধ্যে ২৪,৬০৯.২৫ কোটি টাকা ব্যায়ে জানুয়ারি, ২০০৯ এ ৪৪টি ক্যারিড ওভার  প্রকল্প। ৩. ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫৫,২১২ কিলোমিটার সড়ক পাকা ও নির্মাণ করা হয়। ৪. সারাদেশে ৩,৩৪,৩৪১  মিটার ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে ১০০ মিটারের বড় ব্রিজ ৪১,৫৫২ মিটার। ৫. ১৭৭ টি উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করা হয়। ৬. ১,৫৩১টি ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করা হয়। ৭. ২,১৩৪টি গ্রোথসেন্টার ও হাটবাজার উন্নয়ন করা হয়। ৮. ৭৮৫ টি সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করা হয়। ৯. ১০৫০.৫০ কিলোমিটার বাঁধ পুনর্নির্মাণ ও উন্নয়ন এবং ১,২৫৩টি পানিসম্পদ অবকাঠামো ও রেগুলেটর নির্মাণ করা হয়। ১০. শহরাঞ্চলে ৫,৭৬৪ কি.মি. সড়ক ও ফুটপাথ নির্মাণ, ৩,৭৬৮ কি.মি. সড়ক মেরামত, ২৯৫৮ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ  এবং ৭,৩৩৭ মিটার ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। ১১. পৌর অঞ্চলে ২৯টি বাস ও ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়। ১২. গ্রামীণ ও পৌর জনপদে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন নিশ্চিতে ১০ বছরে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে ১২,২৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৭টি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। ১৩. ১০ বছরে স্যানিটেশনের জাতীয় কভারেজ ৯৯ শতাংশ-এ উন্নীত হয়। ১৪. সারাদেশে ৩.০৩ লাখ পানির উৎস নির্মাণ করা হয়। ১৫. ১,১৭০টি উৎপাদক নলকূপ স্থাপন করা হয়। ১৬. ১৪৩টি পুকুর খনন ও পুনর্খনন করা হয়। ১৭. ১৪৭ টি পানি শোধনাগার করা হয়। ১৮.  ১৩,৪৯৩ কি. মি. নতুন পাইপ লাইন স্থাপন ও প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ১৯. ৫৩টি উচ্চ জলাধার স্থাপনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ২০. স্বাস্থসম্মত স্যানিটেশন নিশ্চিতে ৭.২৪ লক্ষ স্বল্প মূল্যের স্যানিটারি ল্যাট্রিন ও ৪৫৪৪টি পাবলিক ও কমিউনিটি টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে। ২১. ২২৬টি গ্রাম রুরাল পাইপড ওয়াটার এর কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ২২. ৩৯,৩০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিরাপদ পানির উৎস নির্মাণ করা হয়েছে। ২৩. ২৮,৫০০ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওয়াশ ব্লক নির্মাণ করা হয়েছে। ২৪ পল্লি অবকাঠামো উন্নয়নে ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদসমূহের অনুকূলে ৩৬১৭.০৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

ঝলমলে গ্রাম

বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমূল পরিবর্তন ঘটেছে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিতে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের’ ঘোষণা বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলোয় যেমন দূরীভূত হয়েছে অন্ধকার, পাশাপাশি ইন্টারনেট প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গতি এনেছে জীবন ব্যবস্থায়।   মোবাইল আসার সঙ্গে সঙ্গে চিঠির যুগ শেষ হয়ে গেছে। এখন এসএমএস, ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করছে গ্রামের মানুষ। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে চলে গেছে ডিশ লাইন। প্রতিটি বাড়িতে এখন টিভি। সরাসরি সবকিছু দেখতে পাচ্ছেন টিভির পর্দায়। মোবাইল ফোনে অনলাইন পত্রিকাগুলো পড়ছেন গ্রামের মানুষ। কোনটা সঠিক সংবাদ, কোন টিভি টকশোতে ভুল তথ্য দেওয়া হচ্ছে। টকশোতে কথায় কে হেরে যাচ্ছে এটা এখন গ্রামের মানুষ বোঝে। তার কাছে কোনো তথ্য গোপন থাকছে না। ইউনিয়ন পরিষদের ই-সেবা থেকে গ্রামের মানুষ বহু সেবা গ্রহণ করতে পারছে। ঘুচিয়ে যাচ্ছে শহর গ্রামের দূরত্ব।

গ্রাম থেকেই এখন সব সেবা মিলছে অনলাইনে। এখন আর শুধু বেসরকারি সেবা নয়, সরকারি সব সেবাও মিলছে অনলাইনে। কেনাকাটা থেকে শুরু করে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হতো যে কাজে সেই জমির পর্চাও মিলছে অনলাইনে। জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ই-নামজারি, পাসপোর্টের আবেদন থেকে শুরু করে সবকিছুই মিলছে ডিজিটাল সেন্টারগুলোতে। ঢাকার বাইরে তিন হাজার ৮০০ ইউনিয়নে ফাইবার অপটিক্যাল কেবল দিয়ে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হয়েছে। সেখানে তৈরি করা হয়েছে ডিজিটাল সেন্টার। সেখানে ২৭০টিও বেশি সেবা পাওয়া যাচ্ছে।

দেশে এখন ১০ কোটি মানুষ মোবাইল ফোনে আর্থিক লেনদেন করছে। বর্তমানে মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) একাউন্ট প্রায় ১২ কোটি। এরমধ্যে সক্রিয় একাউন্টের সংখ্যা ৫ কোটির বেশি। দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে মানুষ এখন মোবাইল ব্যাংকিং নির্ভর হয়ে উঠেছে।

বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ডেটা সেন্টার এখন দেশে। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হাইটেক সিটিতে ৭ একর জমির ওপর তৈরি করা হয়েছে জাতীয় তথ্যভাণ্ডার বা জাতীয় ডেটা সেন্টার। এটি ইতোমধ্যে বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তর ডেটা সেন্টারের স্বীকৃতি পেয়েছে। শুধু দেশীয় তথ্যের সুরক্ষা নয়, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন এই তথ্যভাণ্ডার ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছে। শুধু তথ্যের সুরক্ষাই নয়, বছরে সাশ্রয় হচ্ছে ৩৫৩ কোটি টাকা। এটাকেই বলা হচ্ছে, ‘হার্ট অব ডিজিটাল বাংলাদেশ’।

ফাইভ-জি যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। গ্রামে বসেই আজ মানুষ ফাইভ-জি প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রাহক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংগস), রোবটিক্স, বিগডাটা, ব্লকচেইন, হিউম্যান টু মেশিন, মেশিন টু মেশিন ইত্যাদি প্রযুক্তি ও ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে ক্রিটিক্যাল মিশন সার্ভিস, স্মার্ট গ্রিড, স্মার্ট সিটি, স্মার্ট হোম, স্মার্ট ফ্যাক্টরি সুবিধা গ্রহণ করতে পারছেন।

ই-কমার্স কিংবা এফ-কর্মাসের মাধ্যমে অনলাইনে কেনাকাটা করছেন গ্রামের মানুষও। মাত্র কয়েক বছর আগেও ঈদ শপিং মানেই ছোটবড় বিভিন্ন শপিংমল, বিপণি বিতান ও ফ্যাশন হাউসে ঘুরে ঘুরে পণ্য কেনার ব্যাপার ছিল। কিন্তু এখন গ্রাম থেকেই অনলাইনে অডার দিয়ে পণ্য ক্রয় করছেন ক্রেতারা।

শেষ কথা

‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে গ্রামীণ অবকাঠামোর আজকের এই উত্তরণ। এর পেছনে রয়েছে এক বন্ধুর পথ। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতি সংক্রান্ত কমিটি (সিডিপি) এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। যেটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে। যেখানে গ্রামীণ সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ; যে অগ্রযাত্রায় গ্রামীণ সামাজের অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত উত্তরণের অনিবার্যতাকে স্পষ্ট করে।
news24bd.tv/ডিডি

এই রকম আরও টপিক