বৈশ্বিক বাণিজ্যের বিপজ্জনক শিপিং রুট

ভারত মহাসাগর থেকে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ’য় অবস্থানরত ৪ সোমালি জলদস্যুর ছবি প্রকাশ করেছে ভারতীয় নৌ-বাহিনী

বৈশ্বিক বাণিজ্যের বিপজ্জনক শিপিং রুট

অনলাইন ডেস্ক

আবারো আলোচনায় এসেছে সমুদ্রে পথের জলদস্যুরা।  গত মঙ্গলবার (১২ মার্চ) ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়েছে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। লোহিত সাগরে হুথিদের নিয়ে অন্যান্য দেশ ব্যস্ত থাকায় ভারত মহাসাগরের আশপাশে আবার মাথা চাড়া দিচ্ছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। এছাড়া বিশ্বের যেসব নৌপথ ঘেঁষে জলদস্যুদের বিচরণ রয়েছে তার অন্যতম সোমালিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল।

বিশ্ব জুড়ে বাণিজ্যের সিংহভাগ মালামাল পরিবহন হয়ে থাকে সমুদ্রপথে। বৈশ্বিক বাণিজ্যের ধমনিও বলা যায় শিপিং রুটগুলোকে। এসব পথের যে কোনো ধরনের বিপর্যয় কিংবা হুমকি বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। যে কারণে অনেক দেশ বৈশ্বিক শিপিং রুটগুলোতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা মোতায়েন করে।
এর গুরুত্ব এত বেশি যে, তেল পরিবহন হুমকির মুখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এসব রুটে বিশাল অস্ত্র মোতায়েন করে রেখেছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম মেট্রোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৭ অক্টোবর হামাস এবং ইসরাইলের মধ্যে নতুন করে সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ইয়েমেনভিত্তিক হুতি বিদ্রোহীরা লোহিতসাগরে চলাচলকারী জাহাজে হামলা ও ছিনতাই করছে। হুতিদের ক্রমবর্ধমান হামলার মুখে ঐ অঞ্চলে জাহাজ চলাচল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইউরোপের উত্তরে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের যুদ্ধ কৃষ্ণসাগরের কিছু অংশে জাহাজ চলাচলকে আরো বিপজ্জনক করে তুলছে। সামুদ্রিক গোয়েন্দা তথ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কোরি র্যান্সলেম বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শিপিং রুট নিয়ে কথা বলেছেন। তার মতে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক শিপিং রুটগুলো হলো :

লোহিতসাগর ও এডেন উপসাগর 
ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা ইয়েমেন উপকূলে চলাচলকারী জাহাজ লক্ষ্য করে প্রতিনিয়ত হামলা চালাচ্ছে। হুতিদের এই হামলা বিশ্ব বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলপথটিকে প্রায় পঙ্গু করে ফেলেছে। লোহিতসাগরের উত্তর প্রান্তে সুয়েজ খালের অবস্থান; এর দক্ষিণ প্রান্তে বাব এল-মান্দেব প্রণালি, যা এডেন উপসাগরে মিলেছে। এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে এবং তার বাইরে পণ্য পরিবহনের জন্য দিনরাত জাহাজের চলাচলের ব্যস্ত জলপথ এটি। কিন্তু অনেক বড় শিপিং কোম্পানি হুতিদের হামলার কারণে ঐ অঞ্চলে ট্রানজিট স্থগিত করেছে। তারা জাহাজগুলোকে দক্ষিণ আফ্রিকার আশপাশের জলপথ ব্যবহার করে পণ্য পরিবহনের নির্দেশ দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার আশপাশের জলপথ ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এতে সময়ও বেশি লাগে। গত বছরের ১৯ নভেম্বর হুতিদের প্রথম হামলার পর থেকে ২ হাজারেরও বেশি জাহাজ তাদের সমুদ্রযাত্রা অন্যপথে নিতে বাধ্য হয়েছে। যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায়ই হুতিদের বিরুদ্ধে পালটা হামলা করছে। এই হামলায় ইয়েমেনে হুতিদের কয়েক ডজন স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। যা ইতিমধ্যে গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে।

dhakapost
বৈশ্বিক বাণিজ্যের ধমনীও বলা যায় শিপিং রুটগুলোকে

মেক্সিকো উপসাগর
মধ্যপ্রাচ্য থেকে দূরে মেক্সিকো উপসাগরের ক্যাম্পেচে উপকূলে মেক্সিকোর অফশোর তেল স্থাপনাগুলো অবস্থিত। এই উপসাগরটি অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক অঞ্চল; যেখানে শেল, বিপি, শেভরন এবং এক্সন মবিলসহ বিশ্বে প্রভাবশালী বিভিন্ন জায়ান্ট কোম্পানির উপস্থিতি রয়েছে। চরম বৈরী আবহাওয়া ঐ অঞ্চলের তেল ও গ্যাস শিল্পের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ হুমকিগুলোর একটি। তবে ঐ অঞ্চলে সবচেয়ে ঝুঁকি হারিকেন। তবে মেক্সিকোর চোরাকারবারিরা উপসাগরে জ্বালানি পাচারের সঙ্গে জড়িত এবং গত বছরের মার্চে উপসাগরে অন্তত ছয়টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে।

মালাক্কা প্রণালি
মালাক্কা প্রণালি পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ততম জলপথ। মধ্যপ্রাচ্য, জাপানি বন্দর এবং পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অংশের বাণিজ্যিক জাহাজের পাশাপাশি তেল ট্যাংকারগুলোর জন্য ট্রানজিট পয়েন্ট মালাক্কা প্রণালি। ২০২১ সালে এশিয়ায় জলদস্যুতা আর ডাকাতির সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ঘটনা রেকর্ড করা হয় ঐ অঞ্চলে। তবে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং সিংগাপুরের সমন্বিত টহল ও জাহাজের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করায় জলদস্যুদের হানা কিছুটা কমেছে। কিন্তু গত বছরের অক্টোবরে একটি বাল্ক ক্যারিয়ারে জলদস্যুদের হামলায় এক জন ক্রু সদস্য আহত হন।

সিংগাপুর প্রণালি
পশ্চিমে মালাক্কা প্রণালি আর পূর্বে দক্ষিণ চীন সাগরের মাঝের ৭০ মাইল দীর্ঘ ও ১২ মাইল প্রশস্ত করিডর হলো সিংগাপুর প্রণালি। ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর (আইএমবি) তথ্য অনুযায়ী, এই প্রণালিটি উদ্বেগজনক অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। কারণ সেখানে প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটে। সিংগাপুর প্রণালিতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা কম ঘটলেও প্রায়ই কিছু অপরাধমূলক তত্পরতা দেখা যায়। ২০২২ সালে এই প্রণালিতে অন্তত ৩৮টি দুর্ঘটনার রেকর্ড করা হলেও পরের বছর তা কমে ৩৭ হয়েছে।

dhakapost
অনেক দেশ বৈশ্বিক শিপিং রুটগুলোতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা মোতায়েন করে

ভেনেজুয়েলা এবং গায়ানার মধ্যবর্তী সামুদ্রিক এলাকা
বিস্তীর্ণ তেল ও খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ এসেকুইবো অঞ্চলের সামুদ্রিক এলাকায় গত কয়েক মাসে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই সামুদ্রিক এলাকায় নজর রাখছেন বিশেষজ্ঞরা। ভেনেজুয়েলা দীর্ঘদিন ধরে যুক্তি দিয়ে বলছে, পশ্চিম সীমান্ত নির্ধারণের সময় তুলনামূলক কম জনবহুল ঐ অঞ্চলটিতে প্রতারণার শিকার হয়েছে তারা। যদিও উপকূলীয় ঐ অঞ্চলটি অনুন্নত ঘন জঙ্গল। গত কয়েক বছরে ঐ অঞ্চলের কাছাকাছি অপরিশোধিত তেল ও গ্যাসের বিশাল ভান্ডারের সন্ধান মিলেছে; যা গায়ানাকে বিশ্বের তেল উত্পাদনকারী দেশগুলোর মানচিত্রে স্থান দিয়েছে।

দক্ষিণ চীন সাগর 
চীন, ফিলিপাইন, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান এবং ভিয়েতনাম দক্ষিণ চীন সাগরে নিজেদের সার্বভৌমত্ব দাবি করছে। প্রতি বছর তিন ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য পরিবহন করা হয় এই সমুদ্রপথ দিয়ে। যে কারণে এসব দেশের সরকার বিতর্কিত এই জলসীমায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় মরিয়া।

ওমান উপসাগর
কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক স্তরে আবারও আলোচনায় আসে ওমান উপসাগর। ঐ সময় ইরানের নৌবাহিনী ১৯ জন ক্রু সদস্যসহ একটি তেল ট্যাংকার আটক করে। যুক্তরাজ্যের সমুদ্রবিষয়ক সংস্থা ইউকে মেরিটাইম ট্রেড অপারেশনস (ইউকেটিএমও) ঐ ঘটনাটি ওমানের উপকূল থেকে ৫০ মাইল দূরে ঘটেছে বলে জানিয়েছিল। এই অঞ্চলটি পারস্য উপসাগরের সরু মুখ হরমুজ প্রণালির ভেতরে এবং বাইরে চলাচল করা জাহাজের অন্যতম পথ; যেখান দিয়ে বিশ্বের মোট তেল বাণিজ্যের প্রায় এক-পঞ্চমাংশই পরিবহন করা হয়।
news24bd.tv/aa