বাড়ছে আয়ু থাকছে আস্থা

স্বাস্থ্যখাতে সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

স্বাস্থ্যখাতের সাফল্য

বাড়ছে আয়ু থাকছে আস্থা

দেবদুলাল মুন্না

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের সাফল্যকে বিশ্ববাসীর কাছে অবিরতভাবে তুলে ধরতে প্রয়াত স্বনামধন্য অধ্যাপক হ্যান্স রজোলিং ২০০৭ সালে ইউটিউবে ‘মিরাকল বাংলাদেশ ’ শীর্ষক ভিডিও প্রকাশ করেন যা আজও বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের কাছে প্রদর্শিত।

শেখ হাসিনা সরকার স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস, শিশু মৃত্যু হার হ্রাস পেয়েছে।

এখন আর চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়া একমাত্র আবশ্যক না। দেশের ভেতরেই গড়ে উঠেছে উন্নত চিকিৎসা সেবা। স্বাস্থ্যখাতের এই অর্জনের জন্য ৩টি জাতিসংঘ পুরস্কারসহ ১৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত। এর মধ্যে এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির প্রণয়ন এই শেখ হাসিনা সরকারের এক উল্লেখযোগ্য অর্জন। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের উন্নয়ন গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করা যায়। আজ নিজ দেশের চাহিদা মিটিয়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৪৫টি দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে।
কয়েকটি উল্লেখযোগ্য  পদক্ষেপ ও ঘটনা:

সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) কর্মসূচি :
২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের জন্য ‘ভ্যাকসিন হিরো’ সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে এ পুরস্কার দেয় গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাক্সিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই)।

স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। দেশের শূন্য থেকে ১৮ মাস বয়সী সব শিশু এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী সন্তানধারণে সক্ষম সব নারীকে টিকাদানের মাধ্যমে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস করা, সংক্রামক রোগ থেকে ও পঙ্গুত্ব রোধ করা এ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য।

দেশে যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, মা ও নবজাতকের ধনুষ্টঙ্কার, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি, নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া, পোলিও মাইলাইটিস, হাম ও রুবেলা—এই ১০ রোগের বিরুদ্ধে নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। ইপিআই কর্মসূচির মাধ্যমে সারাদেশে বিনামূল্যে এ টিকাগুলো দেয়া হয়। ১৯৮৫ সালে টিকাদানের হার মাত্র দুই শতাংশ হলেও বর্তমানে তা ৯৮ শতাংশেরও বেশি।

বর্তমানে টিকাদান কর্মসূচি দাঁড়িয়েছে ৯২ শতাংশে। বর্তমানে দেশের ৯২ শতাংশ ১২-১৩ বছর বয়সী শিশু যক্ষ্মা, হাম, পোলিও, টিটেনাস, হেপাটাইটিস রোগমুক্ত। ২০২২ সালের মধ্যে মাতৃ মৃত্যু প্রতি লাখে কমিয়ে ১২১ জনে আনার জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এছাড়া ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) তা কমিয়ে ৭০ জনে আনার লক্ষ্য কার্যক্রম চলছে।

২০২২ সালের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যু (প্রতি হাজার জীবিত শিশুর) কমিয়ে ৩৪ জনে আনার জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এছাড়া ২০৩০ সালের এসডিজিতে তা কমিয়ে ২৫ জনে আনার লক্ষ্য কার্যক্রম চলছে।

কোভিড :
করোনাভাইরাস মহামারী সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলার স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। তার সঙ্গে পুরস্কৃত হয়েছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন ও বার্বাডোজের প্রধানমন্ত্রী মিয়া আমোর মোতলিও। কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন অসাধারণ নেতৃত্ব প্রদর্শনের জন্য কমনওয়েলথের শীর্ষ তিনজন অনুপ্রেরণাদায়ী হিসেবে আজ সারা বিশ্বে আলোচিত।  

বিশ্ব মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ও মৃত্যুরোধে এখনো পর্যন্ত সফলতার পরিচয় দিয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের অনেক দেশ এখনো পর্যন্ত করোনার সংক্রমণরোধে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করতে না পারলেও বাংলাদেশে ইতোমধ্যে অর্ধকোটি মানুষের টিকাদান সম্পন্ন হয়েছে।

করোনায় দেশের হাসপাতালগুলোতে থাকা মাত্র ৫৭৮টি আইসিইউ বেড থেকে বর্তমানে ২০০০টি আইসিইউ বেডে উন্নীত করা হয়। মাত্র একটি সেন্ট্রাল লাইন অক্সিজেন প্লান্ট থেকে দেশে এখন ১২০টি সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন করা হয়। এতে করোনার দুর্যোগকালীন থেকে এখন পর্যন্ত কোনো হাসপাতালেই অক্সিজেন সংকট দেখা দেয়নি।  

কমিউনিটি ক্লিনিক :
সারাদেশে সরকার ১৩ হাজার ৭৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছে যার মাধ্যমে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ঘরের দোরগোড়ায় বসে প্রাথমিক বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রকাশিত স্বাস্থ্য বুলেটিনে দেখা যায়- প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৭৫ কোটি মানুষ ক্লিনিকগুলো থেকে সেবা নিয়েছে এবং তাদের ৮০ শতাংশই সেবায় সন্তুষ্ট।

মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় :
দেশে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাই আগে ছিল না। শেখ হাসিনা তার প্রথম মেয়াদে সরকার গঠন করে আইপিজিএমআরকে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার প্রস্তাব দেন। এর উদ্দেশ্য ছিল প্রতিষ্ঠানটিকে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা যেমন রোগীর চিকিৎসা, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান চিকিত্সকদের উচ্চতর ডিগ্রি, প্রশিক্ষণ এবং সর্বশেষ জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা।

তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে শেখ হাসিনা আরও তিনটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এগুলো হলো- চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। ইতোমধ্যে জাতীয় সংসদে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই আইন পাশ হয়েছে।  

এছাড়া দেশের প্রায় ৫০০টি উপজেলায় ২৫ বেড থেকে বর্তমানে ৫০ বেডের আধুনিক হাসপাতাল করা হয়েছে। প্রতিটি জেলা হাসপাতালকে ২৫০ বেডে উন্নীত করা হয়েছে। ২২টি ৫০০ বেডের আধুনিক মানের চিকিৎসা ইনস্টিটিউট, ১০০০ বেডের ৩৭টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং পাঁচটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে।

ওষুধ শিল্প :
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে চাহিদার শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি ওষুধ আমদানি করতে হতো। মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার অপচয়রোধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের অধীনে প্রয়োজনীয় ওষুধ আমদানির লক্ষ্যে একটি সেল গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু দেশে মানসম্মত ওষুধের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং এ শিল্পকে সহযোগিতা ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে ‘ওষুধ প্রশাসন পরিদফতর’ গঠন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে ওষুধ প্রশাসন পরিদফতরকে অধিদফতরে উন্নীত করেন। দেশীয় চাহিদার শতকরা প্রায় ৯৮ ভাগ ওষুধ বর্তমানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের ১৪৫টি দেশে ওষুধ রফতানি হচ্ছে। গত ছয় বছরে ওষুধ রফতানি বেড়েছে পাঁচ থেকে ৩১ বিলিয়নে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া রিপোর্টিং, নকল ওষুধ ও নির্ধারিত মূল্যের অধিক মূল্যে বিক্রয়ের বিষয়ে অনলাইনভিত্তিক অভিযোগ দাখিলের জন্য একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। আমদানিকৃত এবং দেশে উৎপাদিত ওষুধের ব্লক লিস্ট অনলাইনে অনুমোদনের জন্য একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করা হয়েছে। সরকারের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত ওষুধ কোম্পানি এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রসমূহে ওষুধের সরবরাহের জন্যে গোপালগঞ্জে একটি বিশাল ফ্যাক্টরি স্থাপন করেছে।

মডেল ফার্মেসি:
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক লেভেল-১ (মডেল ফার্মেসি) এবং লেভেল-২ (মডেল মেডিসিন শপ)-এর বৈশিষ্ট্য অনুমোদন পেয়েছে। মডেল ফার্মেসিগুলো গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট দিয়ে পরিচালিত হয়। ইতোমধ্যে ২২টি জেলায় ৪২১টি মডেল ফার্মেসি ও মডেল মেডিসিন শপ উদ্বোধন করা হয়েছে। ফার্মাকোভিজিল্যান্সের জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের এডিআরএম সেল ডব্লিউএইচও ওপসালা মনিটরিং সেন্টারের ১২০তম সদস্যপদ পেয়েছে।

অনলাইন সেবা:
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে ফিঙ্গার প্রিন্ট রিমোট ইলেক্ট্রনিক অফিস অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশকে ডিএএচআইএস২ সফটওয়্যারের বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ জন্য জার্মান সরকার ২০১৪ সালে বাংলাদেশকে বেস্ট প্র্যাকটিস অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে এবং এ কোয়াইট রিভুলিউশন ইন হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেম ইন বাংলাদেশ নামে একটি বিশেষ বই প্রকাশ করে।

অনলাইনে প্রতিটি কমিউনিটির প্রসূতি মা ও অনূর্ধ্ব পাঁচ শিশুদের নিবন্ধন ও ট্র্যাকিং করার পদ্ধতি চালু হয়েছে। জিও কো-অর্ডিনেটভিত্তিক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রি চালু হয়েছে। এমবিবিএস এবং ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার প্রতিটি স্তর ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিচ্ছিদ্র পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া প্রবর্তন করা হয়েছে। সর্বাধুনিক ডাটা সেন্টার এবং রিমোট ডিজাস্টার রিকভারি সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে এসিআর সংরক্ষণের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।

সরকারি সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল:
২০২৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের প্রথম বর্ষপূর্তি উদ্যাপিত হয়েছে। এই এক বছরে হাসপাতালটির ৫টি সেন্টারের ২০টি বিভাগে সর্বমোট ৪১ হাজার ৫৯৬ জন রোগী সেবা নিয়েছেন। এ ছাড়া এই সময়ে হাসপাতালটির ৫টি বিভাগে ল্যাবরেটরি সার্ভিসেসের আওতায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে ৯১ হাজার ৯৫২টি।

এছাড়া সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের আদলে আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিশ্বের কোথাও নিউরোর এত বড় স্পেশালাইজড হাসপাতাল নেই। এছাড়া দেশে নির্মিত হয়েছে শেখ হাসিনা ন্যাশনাল বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। বিশ্বমানের এই ইনস্টিটিউটটি বিশ্বের মধ্যে সর্ববৃহৎ। মহাখালীর শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউটটিও বিশ্বমানের বৃহতৎ একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল। চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ইএনটি ইনস্টিটিউটও আন্তর্জাতিক মানের।

বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবা :

স্বাস্থ্যসেবার প্রায় ৬৩% চিকিৎসা বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত প্রদান করছে। পাঁচ তারকাবিশিষ্ট বিলাসবহুল হাসপাতাল রয়েছে। যেমন এভারকেয়ার, ইউনাইটেড, স্কয়ার , ল্যাবএইড, গ্রীনডেল্টাসহ বেশ কিছু হাসপাতল ভাল চিকিৎসা দিচ্ছে। উন্নত বিশ্বের প্রায় সব আধুনিক চিকিৎসাসেবা বাংলাদেশে বিদ্যমান। হৃদ্রোগ চিকিৎসায় বাংলাদেশ এখন গর্ব করে। একসময় একটা এনজিওগ্রাম করার জন্য রোগীকে বিদেশে, কমপক্ষে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যেতে হতো। আজ বাংলাদেশে ৫০টির বেশি কার্ডিয়াক সেন্টার রয়েছে এবং প্রতিবছর লাখ লাখ রোগী হৃদ্রোগের উন্নত ও সর্বাধুনিক চিকিৎসা দেশেই নিচ্ছেন।

যথাসময়ে রোগী হাসপাতালে পৌঁছালে অকালমৃত্যু রোধ করা সম্ভব। তাই প্রয়োজন সচেতনতা, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন এবং গণমাধ্যমের ইতিবাচক সংবাদ প্রচার। আমাদের দেশের চিকিৎসকেরা এখন শুধু হৃদ্রোগের সফল চিকিৎসা করেই থেমে নেই। কিডনি প্রতিস্থাপন, বোন অ্যান্ড জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট (হাঁটু এবং কোমরের হাড়), বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যানটেশন (অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন), ক্রিটিক্যাল কেয়ার ম্যানেজমেন্টে সমান পারদর্শিতার ছাপ রেখেছেন এ দেশের মেধাবী চিকিৎসক ও চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ায় প্রতিবছর প্রায় চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে চলে যাচ্ছে। করোনা মহামারিতে এ দেশের চিকিৎসক, নার্স ও হাসপাতাল প্রমাণ করেছে, উন্নত চিকিৎসা প্রদান করতে বাংলাদেশ সক্ষম। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে এ দেশের চিকিৎসা খাতকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব বহু গুণে।

বিশ্বখ্যাত ওরা ছয়জন:

এশিয়ার সেরা ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের দুই নারী। সিঙ্গাপুরভিত্তিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সাময়িকী ‘এশিয়ান সায়েন্টিস্ট’ এ তালিকা তৈরি করেছে।

তালিকায় স্থান পাওয়া দুই বাংলাদেশি নারী বিজ্ঞানী হলেন-বাংলাদেশের চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) পরিচালক ও বিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গাওসিয়া ওয়াহিদুন্নেছা চৌধুরী

ডা. রফিকুল ইসলাম: বাংলাদেশি চিকিৎসক এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তিনি ডায়েরিয়া নিরাময়ের জন্য খাবার স্যালাইন (ওরাল স্যালাইন) আবিষ্কারের জন্য বিশ্বে এক নামে পরিচিত। তিনি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি) থাকাকালীন বেশ কিছু ওষুধ আবিষ্কার করেন। এর মধ্যে অন্যতম ওর স্যালাইন। বিখ্যাত ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেট’ এই আবিষ্কারকে ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার’ হিসেবে ঘোষণা করে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরগুলোতে কলেরা ছড়িয়ে পড়লে একমাত্র চিকিৎসা হিসেবে শিরায় স্যালাইন (ইন্ট্রাভেনাস) দেওয়া হতো। কিন্তু ইন্ট্রাভেনাসের স্বল্পতার কারণে ডা. রফিকুল ইসলামের আবিষ্কৃত খাবার স্যালাইন রোগীকে দেওয়া হতো। এতে দারুণ ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়।  

শুভ রায়: বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম কিডনি তৈরি করেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানী শুভ রায়৷ এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে অসামান্য কীর্তি। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সহযোগী অধ্যাপক শুভ রায় তার সহকর্মীদের নিয়ে কৃত্রিম কিডনি তৈরির কাজ শুরু করেন। চলতি দশকের গোড়ার দিকে দলটি ঘোষণা দেয়, তারা কৃত্রিম কিডনি তৈরি করে তা অন্য প্রাণীর দেহে প্রতিস্থাপন করে সফল হয়েছেন। বর্তমানে কৃত্রিম কিডনি মানবদেহে প্রতিস্থাপনের কাজ চলছে।

আলী আবু ইবনে সিনা: সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবু আলী ইবনে সিনার একটি উদ্ভাবন ক্যানসার পরীক্ষার ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য এনেছে। ২০১৮ সালে উদ্ভাবিত নতুন এই পদ্ধতিতে কেবল রক্ত ও টিস্যু পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। এই পরীক্ষাটি একটি বিশেষ ধরনের ডিএনএ পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে করা হয়। এর মাধ্যমে জীনগত বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। ফলে শরীরে কোন ধরনের ক্যানসার বাসা বেঁধেছে নির্ণয় করা যায়।  

ডা. মোহান্মদ যোবায়ের চিশতী: উন্নত বিশ্বে ফুসফুসের ছোট ছোট বায়ুপ্রকোষ্ঠগুলোকে খোলা রাখার জন্য এবং সেখানে প্রেসার (চাপ) দেওয়ার জন্য এক ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। যা ফুসফুসে বুদবুদ তৈরি করে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ফুসফুসকে সচল রাখে। কিন্তু এই চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। ডা. মোহাম্মদ যোবায়ের চিশতী একটি পানিভর্তি শ্যাম্পুর বোতল আর একটি প্লাস্টিকের সাহায্যে এমন এক চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, যা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর মৃত্যুহার কমিয়ে এনেছে বিস্ময়করভাবে। তার উদ্ভাবিত সেই চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

চিকিৎসা গবেষণায় বিশেষ প্রণোদনা :

চলতি বছরের ১৩ মার্চ  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসা বিজ্ঞানে আরও গবেষণা চালানোর ওপর জোর দিয়ে বলেছেন, তাঁর সরকার এ খাতে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ দেবে। বিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে গবেষণায় তিনি গুরুত্বারোপ করে বলেন, “যারা চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণায় জড়িত থাকবেন তাদের জন্য সরকার বিশেষ প্রনোদনা প্যাকেজ দেবে। ”

এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কার্যালয়ের (পিএমও) শাপলা হলে ‘বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ,’ ‘এনএসটি ফেলোশিপ’ ও ‘বিশেষ গবেষণা অনুদান’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।

তিনি বলেন, গবেষণা ছাড়া কোনো কিছুতেই উৎকর্ষ লাভ করা যায় না। বিজ্ঞানকে বঙ্গবন্ধুই বেশি গুরুত্ব দিতেন। ৭৫’র পর স্বৈরশাসকরা গবেষণায় গুরুত্ব দেয়নি। জাতির পিতা স্বাধীন দেশে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার সময়ই পরমাণু শক্তি কমিশন এবং বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত পরমাণু শক্তি কমিশন মানুষের স্বাস্থ্য পরিচর্যায় অত্যাধুনিক নিউক্লিয়ার মেডিসিনের প্রচলন করে। ২২টি নিউক্লিয়ার মেডিসিন সেন্টার থেকে ক্যান্সার ও থাইরয়েডজনিত রোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসা হচ্ছে।

news24bd.tv/ডিডি