বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের কারণেই ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার সম্ভব হয়েছিলো। দিনটি উপলক্ষে সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন। সেমিনারে বক্তব্য দিয়েছেন আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মাসহ অনেকেই বক্তব্য দিয়েছেন। এসময় বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্ক নিয়ে অনেকেই চমৎকার ও সারগর্ভ আলোচনা করেছেন।
সেদিকে আমি যাচ্ছি না। কিন্তু একটা বিষয় ভাবতেই ভালো লাগছে যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শিতা ও ব্যক্তিত্ব অত্যন্ত উচ্চমার্গের ছিল। আর তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমাদের জাতির পিতার কী গভীর হৃদ্যতা ছিল। ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করেন।এটা তো পরিষ্কার যে, জাতির পিতার দূরদর্শী নেতৃত্ব ও অসাধারণ দক্ষতার কারণেই অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়। ভারতীয় ১ হাজার ৬৬৮ সেনা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন এ যুদ্ধে, এ মুক্তিযুদ্ধে। তাঁদের দেশের জন্য। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ এবং ১ কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের ফাঁসির আদেশের পর বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার জন্য তৎকালীন ভারত সরকার পৃথিবীর দেশে দেশে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছিলো। ভারতের এ অবদান বাংলাদেশের মানুষ কি কখনো ভুলতে পারবে? না, পারবে না। আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরার অনেকেই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। তখন আমিও একজন শিশু। আশ্রয় নিয়েছিলাম মেঘালয়ে। লাখ লাখ শিশু আশ্রয় নিয়েছিল ত্রিপুরাসহ এসব রাজ্যে। আমরা দুই দেশের মানুষ হলেও আমাদের ভাষা এক, সংস্কৃতিরও মিল রয়েছে। ত্রিপুরার মানুষ তাদের রাজ্য এবং মনের দুয়ার দুটিই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অবারিত করে দিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশ থেকে যাওয়া লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, যা তারা বোঝা মনে করেননি, তারা অতিথি হিসেবে আমাদের মেনে নিয়েছিলেন।
এটা বলতেই হবে যে, স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের অবদান চিরস্মরণীয়। জাতির পিতার অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ ও ভারত দুই বন্ধু প্রতিম দেশের মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার বিভিন্ন সময় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে এ চিরসত্যটি উচ্চারণ করেছেনও। দু-দেশের বন্ধুত্ব রক্তের অক্ষরে লেখা। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে শুধু পশ্চিমবঙ্গেই ৭২ লাখ বাংলাদেশি আশ্রয় নিয়েছিলেন। গোটা কলকাতা হয়ে উঠেছিল মিলনক্ষেত্র। বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্প-সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করে কলকাতা হয়ে পড়ে মিলনমেলা। সেসময় কলকাতার কবি-সাহিত্যিক, গীতিকার, বুদ্ধিজীবীসহ সকলেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন। চাইলেও আমরা কোনোদিনই ভুলতে পারবো না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে দুই দেশের সম্পর্ক এখন অনন্য উচ্চতায়। যোগাযোগ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বাণিজ্য, চিকিৎসাসহ নানাক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে আমাদের সম্পর্ক গভীর থেকে আরো গভীর হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী চিন্তা, আদর্শ ও দেশ্রপ্রেম ইন্দিরা গান্ধীকে মুগ্ধ করেছিল বলেই ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুসহ এ পরিবারের সবাইকে হত্যার পর আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকন্যা বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে আশ্রয় পেয়েছিলেন ভারতে।
বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সাল থেকে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশী বন্ধুদের অবদানকে স্মরণ করা এবং তাদের সম্মাননা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০১১ সালের জুলাইতে বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। তাঁর সুদক্ষতা, কূটনৈতিক কৌশল ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আমাদের জনগণের কাছে মধুরস্মৃতি হয়ে থাকবে। এই প্রক্রিয়াতেই ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানসিক শক্তি ও দৃঢ়চেতা মনোভাবের প্রশংসা এদেশের মানুষ সবসময় করবে।
সাবেক ভারতী প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীসহ ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ সম্মানে ভূষিত হন কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বাংলাদেশ এর আগে মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় উচ্চপদস্ত’ সেনা কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, কর্মী, সাংবাদিক, চিকিৎসক এবং কূটনীতিকসহ অন্যান্য সকল শ্রেণি-পেশার ভারতীয় নাগরিকদের সম্মাননা প্রদান করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বাঙালির জাতির পিতার প্রতি ভারতের জনগণের আগ্রহ ছিল সীমাহীন। জাতির পিতা ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তিনদিনের সফরে কলকাতায় যান এবং ঐতিহাসিক ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের জনসভায় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর উপস্থিতিতে লাখ লাখ স্বতঃস্ফুর্ত পশ্চিমবঙ্গবাসীর সম্মুখে ভাষণ দেন। সেদিন তিনি উত্তাল জনতার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চিরদিন অটুট থাকবে। ’
লেখক : কলামিস্ট।
news24bd.tv/ডিডি