কিডনি কতটুকু ভালো আছে?

সংগৃহীত ছবি

কিডনি কতটুকু ভালো আছে?

অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশিদ

মানবদেহের মূল অঙ্গগুলোর একটি হলো কিডনি, যা সুস্থ দেহের জন্য তথা বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। কিডনি প্রধানত রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ, অতিরিক্ত পানি এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থ শোধন করে। এই টক্সিনগুলো প্রথমে মূত্রাশয়ে জমা হয়, যা পরে প্রস্রাব আকারে বের হয়।

এ ছাড়া রক্তের পটেনশিয়াল অব হাইড্রোজেন ব্যালান্স (পিএইচ) বজায় রাখে, যা সুস্থ থাকার জন্য খুব জরুরি।

এ ছাড়া কিডনির কাজ হলো লবণ ও পটাসিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ, হরমোন তৈরি করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, লাল রক্ত কোষের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ, ক্যালসিয়াম শোষণে সহায়তা করা ইত্যাদি।

কিডনির রোগ
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ওষুধজনিত, বংশগত, বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি কিছু অসুখের কারণে কিডনির ক্ষতি হতে পারে বা কিডনির রোগ হতে পারে। কিডনি রোগের কারণে দুর্বল হাড়, স্নায়ুর ক্ষতি এবং অপুষ্টিসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যাও তৈরি হতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রোগটি আরো খারাপ হলে কিডনি তার কাজ পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারে।


কিডনি পাথর, গ্লুমেরুলোনফ্রাইটিস (কিডনির ফিল্টার স্ফীত হয়ে দাগ পড়া), পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ (বংশগত), মূত্রনালির নিম্নাংশ আক্রান্ত হওয়া বা সিস্টাইটিস, মূত্রনালির ঊর্ধ্বাংশ আক্রান্ত হওয়া বা পায়লোনেফ্রাইটিস ইত্যাদি হলো কিডনির কিছু রোগ।

উপসর্গ নেই তেমন
কিডনি রোগ নীরব ঘাতক। কেননা জটিলতা তৈরি হওয়ার আগে এই রোগের প্রাথমিক তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। সাধারণত দুটি কিডনির সত্তর থেকে পঁচাত্তর শতাংশ কার্যকারিতা নষ্ট হওয়ার পরই কিছু উপসর্গ যেমন ক্ষুধামান্দ্য, খাবারে অরুচি, রাতে প্রস্রাব করার প্রবণতা, বমি বমি ভাব বা বমি, শরীর ক্রমান্বয়ে ফ্যাকাশে হওয়া, শারীরিক দুর্বলতা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। এ ছাড়া কোনো রকম চর্মরোগের উপসর্গ ছাড়াই শরীর চুলকায়, অতিরিক্ত হেঁচকি ওঠে এবং অনেক ক্ষেত্রে খিঁচুনি হতে পারে। শেষ পর্যায়ে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, ঝিমানো ভাব হয়, এমনকি রোগী জ্ঞানও হারিয়ে ফেলতে পারে।

পাঁচটি ধাপ বা স্টেজ
কিডনি রোগের পাঁচটি স্টেজ বা ধাপ রয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে উপযুক্ত চিকিৎসা নিলে কিডনি রোগ সম্পূর্ণ ভালো হয়। তবে পরবর্তী জীবনে জীবনধারা পরিবর্তন করে চলতে হয়, যেমন কম লবণযুক্ত খাবার, চিনি, ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলা, চিকিৎসকের পরামর্শে নির্দিষ্ট ওষুধ সেবন ইত্যাদি।

তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে পৌঁছে গেলে কিডনি রোগ পুরোপুরি ভালো করা যায় না। তবে সঠিক চিকিৎসায় পাঁচ থেকে সাত বছরের জন্য রক্তের ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বৃদ্ধি ঠেকানো যায়।
স্টেজ ৫ বা পঞ্চম ধাপ হলো, এন্ড স্টেজ রেনাল ফেইলিওর (ইএসআরডি) বা কিডনি বিকলের সর্বশেষ ধাপ। এই ধাপে পৌঁছে গেলে রোগটির বিস্তার আর রোধ করা যায় না। তখন প্রচলিত মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন অনুযায়ী নিকটাত্মীয় কিডনিদাতার কাছ থেকে কিডনি নিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায় (তবে টিস্যু টাইপিংয়ে মিল থাকতে হয়)। আর কিডনিদাতা না পেলে আমৃত্যু হেমোডায়ালিসিস অথবা সিএপিডি চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

পরীক্ষা
কারোর কিডনি রোগ হোক বা না হোক কিডনির কার্যকারিতা ঠিক আছে কি না তা জানা দরকার। এ জন্য বছরে অন্তত একবার নিচের পরীক্ষাগুলো করুন।

সিরাম ক্রিয়েটিনিন : কিডনি কতটুকু কাজ করছে এটা জানতে সিরাম ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একে বলা হয় কিডনি মার্কার। এই পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায় কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না অথবা কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রক্তের এই পরীক্ষাটির জন্য কোনো পূর্বপ্রস্তুতির দরকার হয় না। যেকোনো সময় করা যায়। ২০০ থেকে ৪০০ টাকায় এই পরীক্ষা করানো সম্ভব।

ইউরিন আর/ই : প্রস্রাবের সঙ্গে অ্যালবুমিন যেতে থাকলে বা নির্গত হলে তা কিডনির জন্য বেশ ক্ষতিকর। দীর্ঘদিন পর্যন্ত অ্যালবুমিন নির্গত হতে থাকলে একপর্যায়ে কিডনি বিকল হয়ে যায়। সমস্যা হলো, প্রস্রাব করার সময় এটা বোঝার উপায় নেই যে প্রস্রাবের সঙ্গে আদৌ কারোর অ্যালবুমিন নির্গত হচ্ছে কি না। এটা কোনো অনুভূতিরও সৃষ্টি করে না, এর কোনো রংও নেই। শুধু ল্যাবরেটরিতে ইউরিন বা মূত্র পরীক্ষার মাধ্যমে এটা জানা যায়। মূত্র পরীক্ষায় সমস্যা পাওয়া গেলে এবং শুরুতে চিকিৎসা নিলে ভালো থাকা যায়। ইউরিন যেকোনো সময় পরীক্ষা করা যায়, খরচও কম।

আল্ট্রাসনোগ্রাম : কিডনি ভালো বা সুস্থ রয়েছে কি না তা জানার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা কিডনির আল্ট্রাসনোগ্রাম করা। এর মাধ্যমে জানা যায়, কিডনিতে কোনো পাথর বা স্টোন রয়েছে কি না, কিডনিতে কোনো ধরনের সিস্ট রয়েছে কি না, কিডনির আকার কেমন বা এর কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না ইত্যাদি।
প্রস্তুতি হিসেবে সকালে খালি পেটে প্রসাবের চাপ নিয়ে এই পরীক্ষাটি করাতে পারলে ভালো।

আরো কিছু পরীক্ষা : এ ছাড়া কারোর ডায়াবেটিস আছে কি না তা জানতে অভুক্ত অবস্থায় ও খাওয়ার পর রক্ত পরীক্ষা করা উচিত। তিনি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন কি না তাও পরীক্ষা করতে হবে। কেননা ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে তেমন জটিলতা প্রকাশ পায় না। এগুলো নীরব ঘাতকের মতো কাজ করে।
এই পরীক্ষাগুলো খুবই সাধারণ পরীক্ষা এবং তা দেশের যেকোনো স্থান থেকেই করা সম্ভব। দরকার শুধু সচেতনতা। ইচ্ছা করলে পরিবারের সবাই বছরে অন্তত একবার উপরোক্ত পরীক্ষাগুলো করাতে পারেন।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, কিডনি ফাউন্ডেশন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট।

news24bd.tv/health

এই রকম আরও টপিক