ইফতারের গুরুত্ব

প্রতীকী ছবি

ইফতারের গুরুত্ব

 আতাউর রহমান খসরু

সারা দিন রোজা রাখার পর মুসলিমরা সূর্যাস্তের সময় যে হালকা খাবার ও পানীয় গ্রহণ করে তাকেই ইফতার বলা হয়। ইফতারের মাধ্যমে রোজাদার সারা দিনের সিয়াম সাধনার সমাপ্তি টানে। সিয়াম সাধনার অংশ হিসেবে ইফতার একদিকে যেমন ইবাদতের অংশ, তেমনি তা মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতির অংশ। কেননা ইফতার সামাজিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধির সুযোগ এনে দেয়।

ইফতারের ধর্মীয় গুরুত্ব

ধর্মীয় দৃষ্টিতে ইফতার গ্রহণের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যেমন—

১. ইফতার করা সুন্নত : রোজাদারের জন্য সূর্যাস্তের পর দ্রুত ইফতার করা সুন্নত। ইফতার না করা বা তা করতে বিলম্ব করা সুন্নতপরিপন্থী। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মানুষ যত দিন দ্রুত ইফতার করবে, তত দিন তারা কল্যাণের ওপর থাকবে।

(সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯৫৭)

২. ইফতার করানো ইবাদত : রমজান মাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো অন্যকে ইফতার করানো। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ বিষয়ে উৎসাহ দিয়ে বলেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে সে ওই রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। আর রোজাদারের সওয়াবও কমানো হবে না। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৮০৭)

৩. ইফতারের সময় দোয়া কবুল হয় : ইফতারের সময় আল্লাহ রোজাদারের দোয়া কবুল করেন। মহানবী (সা.) বলেন, তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না : ন্যায়পরায়ণ শাসক, রোজাদার যখন সে ইফতার করে এবং অত্যাচারিত ব্যক্তির দোয়া। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৭৫২)

ইফতারের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

ইসলাম মুসলিম সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ এবং তা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ইসলামী সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। নিম্নে ইফতারের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তুলে ধরা হলো—

১. ইসলামের প্রতীক : ইফতার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে। সুতরাং তা ইসলামের প্রতীকও বটে। ড. মুহাম্মদ বিন আলী কাতাবি বলেন, ‘রমজান মাসে হাদিসে বর্ণিত গুণাবলির পাশাপাশি ইফতার ও তারাবি ইসলামের প্রতীক হিসেবে গণ্য হতে পারে।

কেননা ইফতার ও তারাবি, বিশেষত সম্মিলিত ইফতার ও তারাবি মুসলিম সমাজের ভ্রাতৃত্ব ও সৌন্দর্য তুলে ধরে। ’ (প্রবন্ধ : ইজহারু শাআয়িরিল ইসলাম ফি রমাদান, আলুকা ডটকম)

২. বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ : গত বছর (২০২৩) ডিসেম্বরের শুরুতে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ইফতারকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে। কারণ হিসেবে সংস্থাটি বলে, ইফতারের সময় প্রার্থনা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আয়োজন থাকে। এর মাধ্যমে পারিবারিক, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুসংহত হয়। এ ছাড়া সেবা, সংহতি ও সামাজিক বিনিময়ের সুযোগ তৈরি হয়। পরিবারের অভিভাবকরা এ সময় শিশু ও যুবাদের ধর্মীয় জ্ঞান ও সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে উপদেশ দেন। (ইউনেসকো ডটঅর্গ)

৩. বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ইফতার : বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও ইফতার মুসলিম সংস্কৃতির অংশ হিসেবে স্বীকৃত। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের অংশ হিসেবে তা উপস্থাপন করা হয়। যেমন—মুসলিম রাষ্ট্রদূতদের সম্মানে অমুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের ইফতার আয়োজন, ইউরোপের বিভিন্ন ফুটবল ক্লাবের উদ্যোগে ইফতার আয়োজন ইত্যাদি। অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রমজান উপলক্ষে মুসলিম শিক্ষার্থীদের শুভেচ্ছা জানানো, তাদের জন্য ইফতার, সাহরি ও নামাজের ব্যবস্থা করা ইফতারের বৈশ্বিক স্বীকৃতিরই অংশ।

৪. সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন : ইফতার আয়োজনে মুসলিমরা ঐতিহ্যবাহী ও স্থানীয় খাবারের আয়োজন করে। যেখানে ইসলামের ঐতিহ্যবাহী খাবারের সঙ্গে স্থানীয় উপাদেয় খাবারের সংমিশ্রণ ঘটে। ফলে মিশ্র খাদ্যসংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। বিশেষত ইউরোপের দেশগুলোতে, যেখানে অভিবাসী মুসলমানের সংখ্যাই বেশি, সেখানে বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা নিজ নিজ দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার নিয়ে ইফতার আয়োজনে অংশ নেয়, যা সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সুযোগ হয়।

৫. সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা : সম্মিলিত ইফতার আয়োজনে ধনী, দরিদ্র্য, অভিজাত ও সাধারণ—সব ধরনের মুসলিমরা একসঙ্গে বসে একই ইফতার গ্রহণ করে। এ ছাড়া প্রতিবেশী, আপনজন ও আত্মীয়-স্বজনের ভেতর ইফতার বিনিময় মুসলিম সমাজের একটি সাধারণ রীতি, যা সামাজিক সাম্যের শিক্ষা ও বার্তা দেয়।

৬. ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা : ইফতার ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার অন্যতম মাধ্যম। রাষ্ট্রীয়ভাবে ও রাজনৈতিক উদ্যোগে আয়োজিত ইফতার মাহফিলগুলোতে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। সমাজের ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের মুসলিমরা তাদের ইফতার আয়োজনে অমুসলিমদের আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে। যেন অমুসলিম ইসলাম ও মুসলিম সমাজ সম্পর্কে জানার সুযোগ লাভ করে। যেমন আরব আমিরাতের ইসলামী সংস্থা আল ফাহিদি অমুসলিমদের মধ্যে নিয়মিত ইফতার বিতরণ করে। আবার একই দেশের একটি গুরুদুয়ারায় মুসলমানদের জন্য ইফতার বিতরণ করা হয়। (বাংলানিউজ, ২৬ জুন ২০১৫)

৭. রাজনৈতিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধি : ইফতার পার্টি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির মর্যাদা লাভ করেছে। প্রতিবছর দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ইফতার পার্টির আয়োজন করে। দেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে রাজনৈতিক নেতা ও কূটনীতিকদের সম্মানে ইফতার আয়োজন করার রীতি আছে। যেখানে ভিন্নমতের রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়। আর তাঁরা সেখানে মতবিনিময় ও সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ লাভ করে। ইফতার পার্টি বাংলাদেশের বিবাদময় রাজনৈতিক অঙ্গনে সৌহার্দ্যের ব্যতিক্রম দৃষ্টান্তও বটে।

আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।

এই রকম আরও টপিক