'সবাই ছেড়েছে, নাই যার কেহ
তুমি আছো তার আছে তব স্নেহ'

অলংকরণ:কামরুল

কিস্তি-১৫

'সবাই ছেড়েছে, নাই যার কেহ তুমি আছো তার আছে তব স্নেহ'

অনলাইন ডেস্ক

মাঝে মাঝে মনে হয় আমার যদি হুদহুদের মতো একটি গায়েবি গোয়েন্দা পাখি থাকতো! আমি তাকে গায়েবি জগত থেকে এই তথ্য আনতে পাঠাতাম-- আমার আব্বু আর ভাইটা কেমন আছে, কী করছে? আমার কথা ওদের মনে আছে কিনা!
আমার বন্ধু রূপা যখন গলায় ওড়না পেঁচিয়ে সেহরির সময় ফ্যানের সাহায্যে উড়াল দিয়ে দিলো তখন ওর কেমন লাগছিল?
সারাদিন রোজা রাখার পর কেন তার এমন উড়াল দিতে মন চাইছিলো?
ভাইটা যখন উত্তাল এই মার্চের তিরিশ তারিখে চিরকালের জন্য চলে গেল তখন তার কেমন লাগছিলো? লিভারটা কি বেলুনের মতো ফাঁপা আর ফুলে গিয়েছিলো?
আব্বুরও কি তাই হয়েছিলো?
আহা লিভারটা! 
আমাদের লিভার সিরোসিসের হিস্ট্রি আছে পরিবারে। খুব অল্প বয়সেই সবাই পরলোকগমন করে থাকেন।
হুদহুদকে পেলে জিজ্ঞেস করতাম, এমন কোন খবরটা সে জানে যেটা আমরা মৃতদের সম্পর্কে জানি না? 

রূপার মৃত্যু রোজায় বলে রোজা এলে, ভাইয়ার মৃত্যু এই মার্চ মাসে বলে মার্চ মাস এলে আর আব্বুর মৃত্যু কুরবানি ইদের আগেরদিন বলে কুরবানি এলে আমি আমার নিজেকে হারিয়ে ফেলি। এই পৃথিবীর কোথাও আমাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।

না ইয়েমেনের স্বচ্ছ হ্রদে, না ইয়ামানের স্বচ্ছ চোখের পলকে।

রোজা এলে রূপা আমাকে অনেক কাবু করে দেয়। রূপার সঙ্গে আমার সখ্য ক্ষুদে বয়স থেকে। সে বিষয়ে দ্বিতীয় পর্বে লিখেছিলাম।

রূপার সঙ্গে গাঢ় যোগাযোগ হয় আমার অনার্সে পড়ার সময়। এর আগে স্কুল ও কলেজে থাকতে দীর্ঘ দীর্ঘ চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ হতো। হুমায়ূন আহমেদ, জীবন বোধ, নারী জন্ম নিয়ে প্রচুর কথা হতো আমাদের। ওর সঙ্গে আমার সখ্য ছিলো অনেকটা হান্নাহ আর আনা ফ্রাংকের মতো। ছোটবেলা কীসের আকর্ষণে যে ওদের বাসায় পড়ে থাকতাম জানি না। এর জন্য বাসা থেকে মাইরও খেতাম প্রচুর। পরে স্কুলে থাকতে পুনঃযোগাযোগের পরে মনেই হয়নি মাঝে এতোদিনের গ্যাপ ছিলো আমাদের মধ্যে।
হায়রে রূপা! তুই বড্ডো সাহসী, আমার চেয়ে অনেক বেশি!

আরও পড়ুন: নকিয়া-১১১০

ও প্রথমে ইউল্যাব থেকে এবং পরে নর্থসাউথ থেকে বায়ো-ক্যামিস্ট্রিতে(ভুল করে না থাকি যদি) ডাবল এমএ করা মেয়ে। প্রচুর বই পড়তো। ফোনে কথা হতো আমাদের। মাঝখানে হলে ওঠার পরে ওর পড়াশোনার চাপ আর বিদেশে যাবার চেষ্টার কারণে যোগাযোগে বেশ ভাটা পড়ে যায়। তবে আমাদের বিয়ের পরে, বিশেষত শ্বশুরবাড়ি যাবার পরে যে কমন নির্যাতন আমরা সহ্য করতাম তা নিরাময়ের একমাত্র কেন্দ্র ছিলাম দু'জন। রূপা আজীবন ক্যারিয়ারিস্ট ছিলো। টিপিক্যাল মেয়েদের মতো অতো সাজগোজ না করলেও খুব স্মার্ট ছিলো। ওর প্রথম বিয়েটা হয় এক সাংবাদিকের সাথে। প্রেমের বিয়ে। বিয়ের পরপরই ওর সঙ্গে আমার আরেক প্রস্থ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তখন ও ইউল্যাব শেষ করে নর্থ-সাউথে পড়ে। প্রেম করে বিয়ে করে ঠিকই কিন্তু বিয়ের পরে তার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে নেয় তার শাশুড়ি। বিসিএসের প্রস্তুতিকে পোটলা-বন্দি করে কোমর বেধে নেমে পড়তে হয় রান্না ঘরে। মোবাইল ছিলো তখন ওর শাশুড়ি আর স্বামীর দ্বারা রেস্ট্রিকটেড, আর রূপার মন ছিলো দুনিয়ার স্বাধীন। যদি কখনো ফোন দিতাম জাস্ট কেমন আছে বলেই রেখে দিতো ফোন। আমি ভীষণ মাইন্ড করতাম তখন। ভাবতাম ওর দেমাগ হয়েছে। পরে আর যোগাযোগ করিনি। এর এক বছরের মাথায় শুনি রূপা ছেলেটাকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে। ও, বলে রাখি রূপার গায়ের রঙ একটু চাপা হলেও ও দেখতে ছিলো ভীষণ মিষ্টি। প্রেম করে বিয়ে করায় তার পরিবারে বিশেষ করে তার ভাই আর ভাবি খুব বেশি কথা শোনাতো। ওর জন্য বিয়ের প্রস্তাব এলে মেয়ে মাস্টার্সে পড়ে তবু বিয়ে হয়নি কেন, কোনো হিডেন সমস্যা আছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি জিজ্ঞেস করে অপমান করা হতো ছেলে পক্ষ থেকে। এই জিদেই রূপা একটি প্রেমের প্রস্তাব গ্রহণ করে তাকেই বিয়ে করে নিয়েছিলো। ডিভোর্সের পরে বাইরে যাবার জন্য খুব চেষ্টা করছিলো। বিসিএসও দিচ্ছিলো সাথে। কিন্তু পার্মানেন্টলি ডিপ্রেশন ওকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিলো। রূপা আমাদের ইন্টারন্যাশনাল হলে অনেক আসা-যাওয়া করতো তখন। আমার পড়াশোনার ব্যাপারে আমার বরের আগ্রহ দেখে আমাকে এটা বোঝাতো যে আর সব দিক ইগনোর করে যেন তাঁর এই বৈশিষ্ট্যকে আঁকড়ে ধরে থাকি। ডিভোর্সি রূপার মধ্যে আমি কখনো কখনো ঈর্ষাও দেখেছি। সেটা আমি ইগনোর করতাম। আমাদের আড্ডা হতো পড়াশোনা, গান আর নারীজীবন নিয়ে। রূপা তখন খুব ফ্রাস্টেটেড ছিলো। ফলে তার সঙ্গে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধুর প্রেম ঘটানোর খুব চেষ্টাও করেছিলাম। হয়নি। ভেবেছিলাম শিক্ষিত, সংস্কৃতমনা, কবি আমার সেই বন্ধুটি রূপাকে বুঝবে। বোঝেনি। রূপার মতে,'দোস্ত, একটা কঠিন সত্য কি জানিস, পৃথিবীর সমস্ত ছেলের মনোবাসনা হলো পৃথিবীর সমস্ত মেয়ে কেবল তার সঙ্গে শোয়ার জন্যই পৃথিবীতে এসেছে। এর বাইরে মেয়েদের মন, মস্তিষ্ক,গুণ বলে কিচ্ছু নাই। ' আশ্চর্য এতো কঠিন সত্য ও মাত্র ২৬/২৭ বছর বয়সে কীভাবে উচ্চারণ করে ফেলতে পারলো আমি জানি না। ও যখন বাসায় আসতো, হুটহাট করে আমার বর তাঁর একজন বহুবিবাহিত বন্ধুকেও সঙ্গে আনতেন। আমার বর যেমন একজন বুদ্ধিমান মানুষ তেমনি একজন ধুরন্ধর চালাক মানুষও। কী কারণে ওঁরা আসতো, কথা বলার ভঙ্গি সবকিছু আমরা দুজনেই বুঝতাম। কিন্তু কখনো উচ্চারণ করিনি। ডিভোর্সি মেয়েমানুষকে সমাজের সকল পুরুষ ভাঙা কাঁঠাল মনে করে থাকে। পরে ও আর বাসায় আসতো না, ক্যাম্পাসে দেখা করতাম আমরা। দেখা হলেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজেদের জীবনে নানা অলক্ষ্যের নির্যাতন রিভাইস করতাম। রূপা আমাকে খুব বুঝতো। কখনো আমার এইসব আলাপের দুর্বলতার সুযোগ নেয়নি। যেটা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু নারী নিয়েছে। একই আসরে একইরকম কথা সবাই বলেছে। আমি অন্যদেরগুলো গোপন করেছি সারা জীবন, কিন্তু আমার দুর্বলতাকে ক্যাশ করে অনেকেই অনেক বড়ো বড়ো জর্জ ব্যারিস্টার হয়ে গেছে(আসলে কচু হয়েছে, ফালতু)। এইসব হীনচরিত্রের সঙ্গে আমি একদম মিশি না এখন।  

আরও পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয় ও একজন মোহাম্মদ আজম

রূপাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে দেবার জন্য বাসা থেকে খুব চাপাচাপি করা শুরু হলো। বিদেশে যাবার চেষ্টা আর বিসিএসের মুখে বালি দিয়ে একেবারে ঘরকন্যা করতে শুরু করে দিলো। দ্বিতীয় বরটা ভালোই ছিলো। কিন্তু শাশুড়ির নির্যাতিন ছিলো অদৃশ্য। 'শত যে মারিত ঠোঁটে' আর নানা কৌশলে। ছেলের সামনে শাশুড়ি বৌকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। অথচ, ছেলে না থাকলে শুধু কথা দিয়ে না, নানা রকম মানসিক নির্যাতন করতো আমার বন্ধু রূপাকে।
ও ফোনে সব বলতো। বাপের বাড়ি স্বামীসহ এসে দিনের পর দিন থাকতো৷ রূপার আমার একটাই কথা, 'সেঁজুতি আমি মনে হয় ভালো নারে, না হয় আমার কপালে এমন হবে কেন? আমি তো আর সহ্য করতে পারতেছি নারে। ' অনেক পজেটিভ কথা বলতাম। চাকরির জন্য সার্কুলার দিলেই ওকে জানাতাম। বেচারির পড়াশোনার মন নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। স্বামীর সঙ্গে কেবল সামাজিকতা রক্ষার জন্য থাকতো। প্রেম বলে কিছু ছিলো না মনে। এদিকে প্রতিবেশী, আত্মীয় পরিজনদের নানারকম যন্ত্রণামুখর দিনযাপন তো ছিলই। কারণ, প্রথমত: প্রেমের বিয়ে, দ্বিতীয়ত: ডিভোর্সি, তৃতীয়ত: দ্বিতীয় বর ঘরজামাই,  উল্লেখ করার মতো কিছু করে না, চতুর্থত: বেসরকারিতে ডাবল এমএসসি করেও বেকার। আহা আমার বন্ধু রূপার ডাবল মাস্টার্স থাকলেও সামাজিক শিক্ষায় একেবারে ডাব্বা-কারিগর। সামাজিক ডিগ্রিতে যে সব ছল চাতুরি, কূট-কৌশল জানতে হয় সেসবে সে একেবারেই 'হৈমন্তী'। কিন্তু কিছুতেই 'কল্যাণী' হতে পারলো না মেয়েটা! আমার সঙ্গে ফোনে শুধু নিজেকে নিয়ে আফসোস করতো আর আমাকে জীবনের সমস্ত বিঘ্ন সত্ত্বেও শুধু লেগে থাকতে বলতো। আবার মুখে বলতোও, 'দোস্ত, তোরে কিন্তু আমি হিংসা করি, আবার ভালো যদি কাউকে বাসি সেটা তুইই!' 

মৃত্যুর আগের দিন আমাকে অনেকবার ফোন করেছিলো। রোজার দিন বলে মোবাইল সাইলেন্ট করে আমি তখন ঘুমিয়ে পড়ি। পরের দিন ঢাকায় আসলে, সেদিনই সেহরিতে ওর মিন্টু কাকু ফোন করে এমন আহামরি খবরটি আমাকে দেন। রূপা ছিলো অত্যন্ত গোছানো আর লক্ষ্মী স্বাভাবের মেয়ে,ছোটবেলা থেকে। আবার তুখোড় পড়ুয়াও। এমন একটি মেয়ের এমন আত্মহননের দায় যদি আমাদের এই সমাজের একজনেরও না থাকে, তো এই সমাজে বেঁচে থেকে এমন কী উপকার হয় আসলে? ফলে, সমাজ গোল্লায় যাক, আগে নিজের ভালো লাগাকে গুরুত্ব দিতে হবে। যা ওউন করা না যা সেই সম্পর্ক ও সামাজিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে নিজের ক্ষতি করার পক্ষপাতি আমি নই।  
 মানুষের বেঁচে থাকার জন্য নিজের চেষ্টায় আত্মবিশ্বাসের যোগান নিজেকেই দিতে হয়। ধরেন, মরবো যে কার জন্য মরবো? এই গান্ধা সমাজের ইতর মানুষের ভয়ে মরবো? কক্ষনো না। দিনশেষে কেউ কারো না। রাতে হয়তো কেউ কেউ,তাও সময়ের প্রয়োজনে! কে জানে!  

আরও পড়ুন: আমার দস্তইয়েভস্কি

রূপার বাবা-মা এখনও বেঁচে আছেন। অনেকদিন কথা হয় না আংকেল আন্টির সঙ্গে ফোন চেঞ্জ হবার কারণে। চোখের সামনে সন্তানের চলে যাবার দৃশ্য পৃথিবীর সব থেকে করুণ দৃশ্য। এ কষ্টের কোনো তুলনা হয় না। আমার মায়ের অবস্থাও রূপার মায়ের মতোই। বহুকাল পানি না পাওয়া বৃক্ষদের মতো পৃথিবীতে কেবল হায়াত নিয়ে বেঁচে থাকেন এইসব বাবা-মা।  
পৃথিবীতে কেউ কারো না হলেও একমাত্র নিজের বাবা-মাই আপন হয়। তাঁদের এই করুণ শুকনো মুখের দিকে তাকিয়েও অন্তত সন্তানদের আত্মহত্যা করার কথা দুইবার ভাবা উচিত।  

যাই হোক,রূপার ফোনটা ধরতে পারলে হয়তো এমন একটা খবর আমাকে শুনতে হতো না। আজ হুদহুদ পাখিটাকে ভীষণভাবে অনুভব করছি।

লেখক পরিচিতি : কবি, লেখক ও শিক্ষক। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।   বর্তমানে সরকারি বিজ্ঞান কলেজে কর্মরত।

news24bd.tv/ডিডি

এই রকম আরও টপিক