লেনিনের মৃত্যু নয়, জীবনটাই সত্য

আজফার হোসেন

মৃত্যু শতবার্ষিকী

লেনিনের মৃত্যু নয়, জীবনটাই সত্য

আজফার হোসেন

বিপ্লবী ভি আই লেনিন (১৮৭০—১৯২৪)-এর মৃত্যুশতবর্ষ চলছে। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন লেনিন। তাঁর মৃত্যু শতবার্ষিকী উপলক্ষে এই বইটি বেরুলো কিছু দিন আগে। বোধ করি, লেনিনের ওপর ইংরেজি ভাষায় এটি এ পর্যন্ত সর্বশেষ প্রকাশিত বই।

 
৫০টিরও বেশি দেশ থেকে নেয়া লেনিনের ওপর ১০০টি বিভিন্ন ধরনের রচনার সংকলন হচ্ছে এই বইটি, যা সম্পাদনা করেছেন মার্কসবাদী জর্মন-বলিভিয়ান থিয়েটার-নির্মাতা ও ভিস্যুয়াল আর্টিস্ট হালমার হর্হে জফরে-এইখ্হর্ন এবং মার্কসবাদী লেখক-অ্যাকটিভিস্ট প্যাট্রিক অ্যান্ডারসন।  
বইটিতে আছে লেনিনকে নিয়ে তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক প্রবন্ধ ও নিবন্ধ, গীতি কবিতা, গদ্য কবিতা, কাল্পনিক কথোপকথন, স্বপ্নচারণ, চিঠি, প্রেমের চিঠি, ফিচার ইত্যাদি। বিভিন্ন ফর্মের এই সব রচনার ভেতর দিয়ে লেনিনকে স্মরণ করা হয়েছে, দেখা হয়েছে, এমনকি উদযাপনও করা হয়েছে, যেমন আবার বিভিন্ন পরিসরে ও প্রবহে, অবয়বে ও অনুষঙ্গে চিহ্নিত করা হয়েছে লেনিনের সমকালীনতা ও প্রাসঙ্গিকতাও।  
আফগানিস্তান, পেরু, থাইল্যান্ড, নাইজেরিয়া, ফিলিপাইন, মেক্সিকো, স্লোভেনিয়া, জিম্মাবুয়ে, রাশিয়া ও ইউক্রেইন, তানজানিয়া, কিউবা, কেনিয়াসহ আরও মেলা দেশের তরুণ ও প্রবীণ শিল্পী, কবি, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতকার, দার্শনিক, তাত্ত্বিক, নাট্যকার এবং অবশ্যই অ্যাকটিভিস্ট লিখেছেন লেনিনকে নিয়ে এবং তাঁরা সকলেই কোনো না কোনোভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছেন রুশ কবি মায়াকোভস্কি’র সেই বিখ্যাত লাইনটাঃ “লেনিন বেঁচেছিলেন, বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন” (কাছাকাছি আরেকটা লাইন পাওয়া যাবে লেনিনকে নিয়ে লেখা পাবলো নেরুদার এক অসাধারণ কবিতায়।
)
এবং স্বভাবতই এই বইটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার বিষয়বৈচিত্র্য। লেনিনকে নিয়ে যে কতোভাবে ভাবা যায়, তার সাক্ষাৎ নমুনা ও উজ্জ্বল ইশারা উভয়ই পাওয়া যাবে বইটাতে, যেখানে ফরাসি বিপ্লবী দার্শনিক আল্যান বাদিয়্যু--লেনিনের মাওবাদী পাঠ ও মাওয়ের লেনিনবাদী পাঠ হাজির করার ভেতর দিয়ে--বিপ্লব ও বিজয়ের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক তাৎপর্যকে সামনে আনার চেষ্টা করেছেন; অন্যদিকে আবার আইসল্যান্ড ও ডেনমার্কে লেনিনের তুমুল প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে লিখেছেন আইসল্যান্ডের ইতিহাসতাত্ত্বিক ও সংগীতকার আর্নি ড্যানিয়েল জুলিউসন্। আফ্রিকার মাটি-কাদা-জলে জড়িত ও জারিত হয়ে উদ্ভূত আফ্রিকী মার্কসবাদ নিয়েও রচনা আছে, যেমন কিউবায় লেনিনের বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে লিখেছেন কিউবান অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ নাতাশা গোমেজ ভেলাস্কাস্।  
বিষয়ের বিস্তার ও বৈভবের আরও কিছু দৃষ্টান্ত হিসেবে বইটিতে আছে এগুলো : লেনিনের সঙ্গে আফ্রিকার বিপ্লবী মার্কসবাদী তাত্ত্বিক-রাজনীতিক-মুক্তিযোদ্ধা আমিলকার কাব্রাল-এর সম্পর্ক, যা নিয়ে লিখেছেন তরুণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আবেল ডাসি আমাডো; লেনিনের কাজের আলোকেই ‘ট্র্যান্সজেন্ডার’-এর মুক্তি-ভাবনা, যা নিয়ে আলোকপাত করেছেন তরুণ দার্শনিক ও অ্যাকাডেমিক-অ্যাকটিভিস্ট অ্যালেক্স অ্যাডামসন।
এছাড়া বইটাতে কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্তির সংগ্রামে লেনিনের কাজের অবদান প্রসঙ্গে লিখেছেন ইতিহাসবেত্তা ক্রিস্টিয়ান হগসবারগ্, যেমন নারীমুক্তির লড়াইয়ে লেনিনের বিপ্লবী ভূমিকা ও তাৎপর্য নিয়ে লিখেছেন জেনেভার মার্কসবাদী ইতিহাসবেত্তা ডারিয়া ডিয়াকোনোভা (লেনিন যে প্রেম-এর সার্বিক মুক্তির ওপরও দারুণ জোর দিয়েছিলেন তার কথা আছে এই রচনায়) এবং বইটিতে অবশ্যই আছে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন বিউপনিবেশায়ন আন্দোলন ও জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের ওপর লেনিনের প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ প্রভাব নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা, যেখানে লেনিনকে বিভিন্নভাবেই সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের প্রধান তাত্ত্বিক হিসেবে জোরেশোরেই চিহ্নিত করা হয়েছে।  
এছাড়া 'ইকোলজিকাল লেনিনবাদ ও সচেতন শ্রমিক কর্তা-সত্তা' শিরোনামে প্রবন্ধ লিখেছেন লেনিনবাদী ভূগোলবিদ ম্যাথিউ হুবার, যিনি লেনিনের কাজকে সম্প্রসারিত ক'রে শ্রমিক শ্রেণির জাতীয় 'ইকোলজিকাল পলিটিক্স'-এর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ওদিকে আবার আফগানিস্তানের এক বিপ্লবী সংগঠনের মাওবাদী সদস্য নাহিদ লিখেছেন বর্তমান সময়ের বিপ্লবী রাজনীতির এলাকায় লেনিনের তুমুল প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে।  
বইটিতে আছে আরও বিষয়ঃ লেনিনের ‘ইলেকট্রিক কম্যুনিজম', লেনিন এবং ‘সাইকোঅ্যানালিসিস’ ও মুক্ত প্রেম, লেনিন ও হেগেল, লেনিন ও মার্কস, ইরানে লেনিনের প্রগতিশীল প্রয়োগ ও চর্চা, আন্তোনিও গ্রামসির তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক গুরু হিসেবে লেনিন, বিশ শতকের একজন প্রধান নির্মাতা হিসেবে লেনিন, তিউনিশিয়ায় লেনিনের এক শতাব্দী, লেনিন ও লেনিনবাদীরা, লাতিন আমেরিকার প্রধান মার্কসবাদী হোসে কার্লোস মারিয়াতেগি’র ওপর লেনিনের প্রভাব, লেনিনের ছয় লিঙ্ক, লেনিন ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতির আবিষ্কার, লেনিন ও ফিলিপাইনি আন্তর্জাতিকবাদী সংহতি, লেনিনের সময় ও আমাদের সময়, লেনিন ও শিল্প-সাহিত্য-সংগীত, লেনিন ও মার্কসবাদী গণিত, লেনিন ও মূর্ত ডায়ালেকটিক্স, এমনকি 'আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স' প্রসঙ্গে লেনিন।  
ওপরের ফর্দ আরও বাড়ানো যায়। তবে এখানেই থামি। কিন্তু এও বলে নেয়া দরকার, বইটিতে লেনিনের ওপর বা লেনিনকে ঘিরে লিখেছেন পশ্চিমা জগতের ও পশ্চিমে কর্মরত বেশ কিছু পরিচিত মার্কসবাদী ও বামপন্থী লেখক-তাত্ত্বিক-অ্যাকটিভিস্টও--স্ল্য়াভয় জিজেক, পল লা ব্ল্যাংক, পিটার হুডিস্, কনিষ্ক গুনেওয়ারদেনা, হিমানি ব্যানার্জি, গোরান থেরবর্ন, জোডি ডীন প্রমুখ।  
যাঁরা লেনিনকে বিভিন্ন পরিসরে বুঝতে চান, এবং যাঁরা লেনিনের কাজের তুলনামূলকভাবে অপরিচিত কাজের সন্ধান পেতে চান, এবং বর্তমান সময়ে যাঁরা নতুন বিপ্লবী রাজনীতির স্বার্থেই লেনিনের সৃষ্টিশীল নবায়নে আগ্রহী, এবং এমনকি যাঁরা লেনিনকে উঠতে এক লাথি বসতে আরেক লাথি মারতে থাকেন, তাঁদের সকলের জন্যই এই বইটি অবশ্যপাঠ্য বলে আমি মনে করি।  
আর হ্যাঁ, লেনিনের মৃত্যু নয়, জীবনটাই সত্য।

news24bd.tv/ডিডি
 

এই রকম আরও টপিক