বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে লড়েছিলেন যে সাত পাকিস্তানি 

মালিক গোলাম জিলানী ছাড়া উপরের বাঁ থেকে বেগম নাসিম আখতার, বেগম তাহিরা মাজহার আলী, কবি ফয়েজ আহমেদ, একবাল আহমেদ, জাফর মালিক ও আহমেদ সালিম

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে লড়েছিলেন যে সাত পাকিস্তানি 

দেবদুলাল মুন্না

আজ ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবের দিন, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দিন। দীর্ঘ পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের এই দিনে বিশ্বের মাঝে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

দেশ স্বাধীন হয়। জন্ম হয় বাংলাদেশের। এই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে পাকিস্তানের কয়েকজন সেই দেশে থেকে বা অন্য কোনো দেশে থেকে লড়েছিলেন। তারা পাকিস্তানি হয়েও  বাংলাদেশের পক্ষে দাড়ানো ছিল বিস্ময়ের।
তাদের অনেককে কারাবরণ করতে হয়েছিল। হয়েছিলেন নির্যাতিত। সেরকম কিছু মানুষের কথা এখানে তুলে ধরা হলো:

বেগম নাসিম আখতার

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী যে বর্বর নিধনযজ্ঞ চালায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বেগম নাসিম আখতার এটি মেনে নিতে পারেননি।  মার্চের শেষ সপ্তাহে তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে দাঁড়িয়ে যান পাকিস্তানের লাহোরের মল রোডে। বাঙালির ওপর সংগঠিত গণহত্যার প্রতিবাদ করে গ্রেপ্তার হন। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে কথা বলায় তার পরিবারকেও বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। তার সেই ভূমিকা স্মরণ করেই তাকে দেয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা।

বেগম তাহিরা মাজহার আলী

লাহোরের মল রোডে সেই বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বেগম তাহিরা মাজহার আলী। তিনিও গ্রেপ্তার হন সেদিন। বিভিন্ন ফোরামে বাঙালির ওপর নির্মম গণহত্যা ও অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরেন এই মানবাধিকারকর্মী।

মালিক গোলাম জিলানী

২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পর তার মুক্তি দাবিতে জেনারেল ইয়াহিয়াকে খোলা চিঠি লেখেন পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মালিক গোলাম জিলানী। এজন্য তাকেও কারাগারে যেতে হয়েছিল। সেই চিঠিতে তিনি লেখেছিলেন, এরকম পৈশাচিক হামলা অমানবিক। মেয়েদের ওপর অত্যাচার করছেন কিন্তু ভুলে যাচ্ছেন আমাদেরও মা-বোন আছে। মালিক গোলাম জিলানীর পক্ষে তার মেয়ে আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী আসমা জাহাঙ্গীর যখন সম্মাননা নিতে মঞ্চে আসেন, তাকে বুকে টেনে নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কবি ফয়েজ আহমেদ

সাংবাদিক ও কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির পক্ষে কলম ধরেন। বাংলাদেশে গণহত্যা ও নিপীড়িত মানুষের দুঃখ-যাতনা নিয়ে কবিতা ও নিবন্ধ লেখেন পাকিস্তানের এই কবি ও সাংবাদিক। ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার ভয়াবহতা দেখে দৈনিক জং পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন অধ্যাপক ও সাংবাদিক ওয়ারিস মীর।

তার পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন তার ছেলে হামিদ মীর; যিনি বিশ্বাস করেন, পাকিস্তানেও একদিন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার হবে। হামিদ মীর পাকিস্তানের বিখ্যাত ‘ডন’ পত্রিকার সাংবাদিক। তিনি লাদেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন।  

একবাল আহমেদ

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন করেন পাকিস্তানি দার্শনিক একবাল আহমেদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য বার বার জেনারেল ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মীর গাউস বকস বিজেঞ্জো। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দলগতভাবে অবস্থান নেন তিনি।

জাফর মালিক

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষ নেয়ায় পাকিস্তানে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়, তাদের হয়ে আইনি লড়াই চালান জাফর মালিক। এজন্য পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বিড়ম্বনার মুখোমুখি হন তিনি।

তারা সবাই ২০১৩ সালে পান ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’। শেখ হাসিনা এই পুরস্কার তুলে দেন। ৬৯ বিদেশি বন্ধুকে সম্মাননা জানিয়েছে বাংলাদেশ।

আহমেদ সালিম

আহমেদ সালিম ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুদের একজন। ১৯৭১ সালে দেশের সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লিখেছেন। এ জন্য তাঁকে কারাবরণ ও নির্যাতন সইতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে অকুণ্ঠ সমর্থনের জন্য তিনি পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুর পদক। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের বন্দিজীবন’। এ বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মফিদুল হক। বইয়ে অনুবাদকের কথায় লেখা হয়েছে, আহমেদ সালিম ছিলেন সেই সব বিরল পাকিস্তানিদের একজন; উন্মত্ততায় অন্ধ সমাজ বেষ্টনীতে যারা বিবেকের নির্দেশ বিস্মৃত হননি এবং প্রবল বিরুদ্ধতার মধ্যেও সত্য প্রকাশে কুণ্ঠিত ছিলেন না। তাই বাংলাদেশে গণহত্যার খবর জেনে তিনি লাহোরে তাৎপর্যময় প্রতিবাদ সংগঠনে ব্রতী হয়েছিলেন।  

news24bd.tv/আইএএম

এই রকম আরও টপিক