মুক্তিযুদ্ধের তারুণ্য ও বর্তমান প্রজন্ম

ড. আতিউর রহমান

মুক্তিযুদ্ধের তারুণ্য ও বর্তমান প্রজন্ম

ড. আতিউর রহমান

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলদেশ মূলত তারুণ্যের সৃষ্টি। যে মুক্তিযোদ্ধারা জীবনবাজি রেখে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন তাদের গড়-পড়তা বয়স ছিল একুশ বাইশ বছর। বিরাট সংখ্যক স্কুলগামী শিক্ষার্থীও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। তাদের অনেকেরই বয়স ছিল ১৪-১৫ বছর।

তরুণদের সাথে বরাবরই বাংলাদেশের আরেক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্ক ছিল সুগভীর। তারাই তাঁকে শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধুতে রূপান্তর করেছিল। কেননা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের ধরন ও অঙ্গীকারের ওপর আস্থা ছিল তরুণদের। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং পরবর্তি সময়ে তার বিকাশের ধারাকে বুঝতে হলে আজকের তরুণদের মনের খোঁজ করার প্রয়োজন রয়েছে।
তারাই সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের রক্ষাকবচ। অধিকাংশ জনগোষ্ঠীই (বাঙালি) শুরু থেকেই পাকিস্তান নামক একটি ঢিলেঢালাভাবে ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় দেশের ‘মিথ্যা ভ্রম’ উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তাদের গভীর উদার, গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক আকাক্সক্ষাকে সংহত করতে ব্যর্থ হয়েছিল ওই রাষ্ট্র। কেননা সেটি ছিল ভঙ্গুর তথাকথিত ‘মুসলিম জাতিসত্তা’র ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া এক অবাস্তব রাষ্ট্র। তাদের মাতৃভাষা বাংলার পবিত্রতার ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সম্মুখ আক্রমণ বাঙালিদের কাছে স্ফটিকের মতো পরিষ্কার করে দিয়েছিল যে তাদের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা পাকিস্তানিদের সাথে মেলার নয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বৈধ নির্বাচিত বাঙালি নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অনিহা এবং আলোচনার সকল শান্তিপূর্ণ পথ ভেঙ্গে দিয়ে বাঙালি নেতৃত্বকে সশস্র সংগ্রামের সূচনা করতে বাধ্য করা হয়। সংক্ষিপ্ত এই তীব্র সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ।  
উল্লেখ্য, এটি ছিল পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রের একটি প্রদেশ যা ১৯৪৭ সালে ধর্মীয়ভাবে প্রতারিত 'জাতীয়তাবাদী' পরিচয়ের কারসাজির মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল। সমস্ত ধরণের বৈষম্য এবং অন্যায়ের চাপে এই পাকিস্তান একাত্তরে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। পাকিস্তানের কারাগারে যন্ত্রণাদায়ক বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসার পর বাঙালির বিজয় সম্পূর্ণ হয়। সেদিন বিকেলে তাঁকে খুবই দুর্বল দেখাচ্ছিল। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে সমৃদ্ধ বাংলাদেশে পুনর্গঠনের উদ্দীপনায় তিনি বেশ উজ্জীবিত ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার পেছনে বাংলাদেশের মানুষের আত্মত্যাগ ও তরুণদের অগ্রণী ভূমিকার কথা তিনি সেদিন স্পষ্টভাবে স্মরণ করেছিলেন। গোটা বিশ্ব এবং অবশ্যই সাধারণ বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে সদয় কথা শুনে মোটেও বিস্মিত হয়নি। কেননা এই মুক্ত্যোদ্ধাদের সিংহভাগই ছিল তরুণ এবং সাধারণ আর্থ-সামাজিক পটভূমি থেকে উঠে আসা। তাই পড়ন্ত বিকেলে তিনি অনায়াসে বলতে পেরেছিলেন যে, সাধারণ মানুষ পর্যাপ্ত খাবার না পেলে এবং তাদের ছেলে-মেয়েদের কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ না দিতে পারলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে। আর এগুলো তাঁর নিছক কথার কথা ছিল না। তিনি প্রকৃতপক্ষেই তাদের বোঝাতে চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রামের গুরুত্ব কতোটা। আর সেই মুহুর্ত থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁর মর্মান্তিক শাহাদাত বরণের ক্ষণ পর্যন্ত সকলের জন্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সংগ্রাম তিনি লাগাতার করে গেছেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, আজকের তরুণরাও তাঁকে জাতির পিতা হিসেবে শ্রদ্ধা করে চলেছে এবং স্বাধীনতার জন্য যে ঐতিহাসিক সংগ্রাম তিনি শুরু করেছিলেন এবং তাঁর সহ-নেতাদের সমর্থনে যে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই ঐতিহাসিক রূপান্তরের সঙ্গে তারা সহজেই নিজেদের যুক্ত করতে পারছে।  
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের সময় আমরা জাতির পিতা সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি নিয়ে একটি অনলাইন জরিপ চালিয়েছিলাম। এটা সত্যিই আনন্দদায়ক ছিল যে তরুণরা তার নান্দনিক নেতৃত্বকে মূল্য দেয় এবং উপরোক্ত আখ্যানের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করতে পারে। দেড় হাজারের মতো তরুণদের ওপর ওই জরিপ অনুযায়ী, ৬৫ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শব্দটি শোনা মাত্রই বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম তাদের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। উপরন্তু, ৭৪ শতাংশ তরুণ মনে করেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ স্থানীয় প্রতিকূলতা ও বৈশ্বিক কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ উপেক্ষা করে লাখো মানুষের সামনে তিনি যখন কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, সেই ফ্ল্যাশপয়েন্ট বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শব্দটি সমার্থক হয়ে গেছে। আমরা যখন আজকের তরুণদের জিজ্ঞাসা করলাম কেন বঙ্গবন্ধু তাদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ, তখন তাদের উত্তরগুলিতে স্পষ্টভাবে রূপান্তরমূলক নেতৃত্বের গুণাবলীর কথাই বিবৃত হচ্ছিল। শতকরা ৮১ ভাগ মনে করেন, বঙ্গবন্ধু অনেকের কাছেই আরাধ্য রয়ে গেছেন মূলত তার নান্দনিক নেতৃত্বের গুণাবলীর কারণে। তাঁদের মধ্যে ৭৩ শতাংশ মনে করেন, স্বাধীনতার মহৎ লক্ষ্যে তাঁর আপসহীন নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য জাতির পিতা হিসেবে এই গুণটি তরুণদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই তরুণ উত্তরদাতাদের মধ্যে ৭২ শতাংশ মনে করেন যে তাঁর নেতৃত্ব নিঃস্বার্থ ছিল এবং সর্বদা জনস্বার্থের দিকে মনোনিবেশ করে। সন্দেহ নেই, সমসাময়িক রাজনীতি ও সমাজে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি আজকের তরুণদের হৃদয়ের কাছাকাছিই রয়ে গেছেন।  
বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার কর্তৃক ৫,৬০৯ জনের ওপর পরিচালিত সাম্প্রতিক একটি জরিপে ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীর কাছে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজের বিভিন্ন দিকসহ তাদের অতিক্রম করতে হবে এমন কিছু চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়। এসব তরুণ কিছু বিষয়ে মিশ্র ধারণা প্রকাশ করলেও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তারা ইতিবাচক (৫৬.৮%) এবং নিরপেক্ষ (২১.৬%) ছিল। তাদের মধ্যে মাত্র ২১.৬ শতাংশ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে। এই জরিপের মূল ফলাফলে আমি অবাক হইনি। এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের, বিশেষ করে নীতিনির্ধারকদের মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও দুর্নীতির অবস্থা নিয়েও বঙ্গবন্ধু ছিলেন সমান সমালোচনামূলক, যা তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় প্রতিফলিত হয়েছে। তারপরও তিনি ছিলেন এই তরুণদের মতো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিরন্তন আশাবাদী। তিনি বরাবরই একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন যখন তার কোষাগারে একটি ডলারও ছিল না এবং ৮০% এরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল, যাদের বেশিরভাগই দিনে দু'বার পূর্ণ মুখের খাবার থেকে ছিল বঞ্চিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি কখনো আশা ছাড়েননি। তিনি মনে করতেন, সংগ্রামী বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করার জন্য বাংলাদেশের রয়েছে উর্বর জমি এবং কঠোর পরিশ্রমী মানুষ রয়েছে। তাঁরই মতো, জরিপে অংশ নেওয়া ৭৭.২% তরুণ বিশ্বাস করে যে আগামী বছরগুলিতে তাদের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে।  
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে শিক্ষার মানোন্নয়নে ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন চালু করেছিলেন। আজকের তরুণরাও শিক্ষার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করে। জরিপে অংশ নেয়া তরুণদের ৬৮.৬ শতাংশ মনে করে, চাকরির জন্য তাদের প্রস্তুত করতে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি প্রয়োজন। তাদের মধ্যে ৬৯.৬ শতাংশ মনে করে যে শিক্ষা ব্যবস্থার তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রস্তুত করা উচিত। বঙ্গবন্ধু যেমন শিক্ষকের গুণগত মানের দিকে নজর দিতেন, তেমনি ৫৭ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণ মনে করে, উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার জন্য শিক্ষকদের মান বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। তাদের মধ্যে আরও ৩৫% উন্নত শিক্ষার অত্যাবশ্যক উপাদান হিসাবে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে। দুর্নীতি ও বেকারত্ব নিয়ে আজকের তরুণরা বঙ্গবন্ধুর মতোই সোচ্চার। তাদের মধ্যে ৮৮ দশমিক ৮ শতাংশ দুর্নীতিকে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাছাড়া, ৬৭ দশমিক ৩ শতাংশ মনে করে বেকারত্বও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বঙ্গবন্ধু একই পরিভাষায় কথা না বললেও ১৯৭০-এর দশকের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে মুখোমুখি যোগাযোগের পাশাপাশি ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাস এবং মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষায় প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরবনের ভাগ্য নিয়ে অনেক চিন্তিত ছিলেন।  
আশ্চর্যজনকভাবে, আজকের যুবকদের ৭৩.৪% জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের মুখোমুখি হয়েছে এবং চরম উষ্ণতার প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, স্বাস্থ্য সমস্যা, খারাপ বায়ুর গুণমান এবং খাদ্য ও জলের ঘাটতি সম্পর্কে কথা বলেছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্যের দিকে তাকালে আজকের তরুণরা তার মধ্যে উন্নত বাংলাদেশের জন্য কাজ করার প্রেরণার প্রকৃত উৎস খুঁজে পায়। বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশম্যাটিক ও রূপান্তরকামী নেতৃত্বের গুণাবলির জীবন ও বিভিন্ন দিক নিয়ে তাদের আরও বেশি সম্পৃক্ত হতে হবে। বঙ্গবন্ধুর নান্দনিক নেতৃত্বের শীর্ষে আরোহণ সম্পর্কে আমাদের তরুণরা যতক্ষণ না জানবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করা সহজ হবে না। তাই বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত রাখার জন্য আসুন আমরা আরও গুরুত্ব সহকারে চেষ্টা করি। প্রকৃতপক্ষে, উভয়ই সমার্থক। তারা একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তাই সকল অর্থেই বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ। আর সে কারণেই আজকের তরুণদের মাঝে আরো বেশি করে তুলে ধরতে হবে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। স্বাধীনতা অর্জনে তারুণ্যের ভূমিকা এবং চলমান অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামেও তাদের অবদান বোঝার জন্যেই তাদের এই সচেতনার খুবই প্রয়োজন।

 লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

news24bd.tv/ডিডি

সম্পর্কিত খবর