৩৩ দেশের ক্লাবে বাংলাদেশ

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত

৩৩ দেশের ক্লাবে বাংলাদেশ

মো. ইস্রাফিল আলম

বিদ্যুতের আলোয় গ্রাম বাংলার চিরায়ত ঘুটঘুটে অন্ধকার চিত্র এখন বদলে গেছে। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের হাত ধরে ঘরে ঘরে এখন বিদ্যুতের আলো। দেশকে আরও বহু দূর এগিয়ে নিতে, উন্নত-সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের বিকল্প নেই। এই সত্য উপলব্ধি করেই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা উত্তরের জেলা পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে গড়ে তুলছেন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

এ বছরই এই কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রেডে যুক্ত হবে বিদ্যুৎ।

দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চিন্তা

এ দেশে ১৯৬১ সালে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে পাকিস্তান সরকার। এ জন্য ১৯৬২ সালে পাবনার ঈশ্বরদীতে পদ্মা নদীর পাশে রূপপুর স্থান নির্ধারণ করা হয়। প্রকল্পের জন্য ২৯২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।

১৯৬৮ সালের মধ্যে ভূমি উন্নয়ন, অফিস, রেস্ট হাউজ, বৈদ্যুতিক উপ-কেন্দ্র ও কিছু আবাসিক ইউনিটের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় ১৯৬৯ সালে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাতিল করে দেয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ১৯৭৭-১৯৮৬ সালে ‘মেসার্স সোফরাটম’ কর্তৃক একটি সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন চালানো হয় এবং এর মাধ্যমে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন যৌক্তিক বলে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। পরে একনেকে ১২৫ মেগাওয়াটের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন করা হয়, কিন্তু বিভিন্ন কারণে  বাস্তবায়ন হয়নি।  

১৯৮৭ সালে জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের দুইটি কোম্পানি কর্তৃক দ্বিতীয়বার সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন করা হয়। এ অধ্যয়নে ৩০০-৫০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু এর পর কাজ আর এগোয়নি।

আ. লীগের ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি 

২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ। তিন মেয়াদে একটানা প্রায় ১৫ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ প্রকল্প নির্মাণের ফলে আওয়ামী লীগ সরকার তার আরও একটি নির্বাচনী ইশতেহার পূরণ করল।

যেভাবে এগিয়েছে কাজ 

শেখ হাসিনা সরকারের হাত ধরে ২০০৯ সালে আবার এই প্রকল্প আলের মুখ দেখতে থাকে। ২০০৯ সালে ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে অপরিহার্য কার্যাবলী সম্পাদন’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রাথমিক কার্যাবলী ও পারমাণবিক অবকাঠামো উন্নয়নের কার্যক্রম শুরু করা হয়। ২০০৯ সালের ১৩ মে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং রুশ ফেডারেশনের রাষ্ট্রীয় পরমাণু শক্তি কর্পোরেশন (রোসাটোম)-এর মধ্যে ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ বিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। ২০১০ সালের ২১ মে বাংলাদেশ সরকার এবং রুশ ফেডারেশন সরকারের মধ্যে ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রকল্পটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একটি জাতীয় কমিটি, মন্ত্রী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সভাপতিত্বে কারিগরি কমিটি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিবের নেতৃত্বে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ ও ৮টি উপগ্রুপ গঠন করা হয়।

২০১০ সালের ১০ নভেম্বর, জাতীয় সংসদে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ২০১১ সালের ৯-১৫ নভেম্বর বাংলাদেশের পারমাণবিক অবকাঠামোর সার্বিক অবস্থা মূল্যায়নের জন্য আইএইএ সমন্বিত পারমাণবিক অবকাঠামো পর্যালোচনা (আইএনআইআর) মিশন পরিচালিত হয়। ২০১১ সালের ২ নভেম্বর বাংলাদেশ এবং রুশ ফেডারেশন সরকারের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত আন্তরাষ্ট্রিয় সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১২ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২ পাস করা হয়।

২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া ফেডারেশন সফরকালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রাক-প্রারম্ভিক পর্যায়ের কার্যাদি সম্পাদনের জন্য রাষ্ট্রীয় রপ্তানি ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। স্বাক্ষরিত আন্তরাষ্ট্রীয় চুক্তি এবং রাষ্ট্রীয় রপ্তানি ঋণ চুক্তির ভিত্তিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন (১ম পর্যায়) প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর শেখ হাসিনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পর্যায় কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।   

২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিচালনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির বিধান সম্বলিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আইন-২০১৫ জারি করা হয়। ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অন্যান্য পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনার জন্য নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড গঠন করা হয়। ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মূল পর্যায়ের কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সাধারণ চুক্তি সই হয়।  

২০১৬ সালের ১০-১৪ মে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় পারমাণবিক অবকাঠামো প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আইএইএ-এর সুপারিশ বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা করার জন্য আইএনআইআর ফলো-আপ মিশন পরিচালনা করা হয়।  

২০১৬ সালের ২১ জুন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থান লাইসেন্স দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল পর্যায়ের কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং রুশ ফেডারেশন সরকারের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্রেডিট চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়।  

রাশিয়া থেকে আসে ইউরেনিয়াম 

২০২৩ সালের ৫ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছে থেকে পারমাণবিক জ্বালানির প্রথম চালান গ্রহণ করে। এ উপলক্ষে একটি ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন উপস্থিত ছিলেন। সেদিন রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি করপোরেশন রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের কাছে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করেন। এর মধ্য দিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশের ক্লাবে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। এ ক্লাবের বর্তমনা সদস্য ৩৩। ১০ নভেম্বর, ২০২৩ পারমাণবিক জ্বালানির শেষ চালান দেশে আসে।  

এর আগে ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১ নং ইউনিটের প্রথম কংক্রিট ঢালাইয়ের উদ্বোধন করেন। ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর এবং ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যথাক্রমে এই কেন্দ্রের প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিটের পারমাণবিক চুল্লিপাত্র বা রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপনের কাজ উদ্বোধন করেন। উভয় অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পাবনার ঈশ্বরদীতে যুক্ত হন তিনি।

নির্মাণ ব্যয় 

রূপপুর পারমণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে জন্য খরচ হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার দিচ্ছে ২২ হাজার ৫২ কোটি ৯১ লাখ ২৭ হাজার টাকা। ঋণসহায়তা হিসেবে রাশিয়া দিচ্ছে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। দেশের বিদ্যুৎ খাতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ কেন্দ্র থেকে ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে। এটি বিশ্বে বাংলাদেশকে নতুন মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করবে।  

ঝুঁকি মোকাবিলায় শক্ত ব্যবস্থা

এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনার পর থেকেই নানাবিধ সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। বিশেষ করে নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তবে ঝুঁকি মোকাবিলায় নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ।  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব ও নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এর চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন জানান, রূপপুরের নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর দুটির প্রতিটিতে ৭টি অ্যাকটিভ (অর্থাৎ বিদ্যুৎ দ্বারা চালিত) এবং ৮টি প্যাসিভসহ (বিদ্যুৎ ছাড়া চালিত) মোট ১৫টি নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়া নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেলের নিচে থাকবে প্রায় ৭৫০ মেট্রিক টন ওজনের একটি মোল্টেন কোর ক্যাচার (Molten Core Catcher)। কোনো কারণে রিঅ্যাক্টরের কোর (ভিতরের অংশ) তাপমাত্রা অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে গলে গেলে এই কোর ক্যাচারটি কোরের উচ্চ তাপমাত্রাসম্পন্ন গলিত তেজস্ক্রিয় পদার্থ ধারণ করে তা শীতল করবে। এর ফলে তেজস্ক্রিয় পদার্থ কোনো অবস্থাতেই রিঅ্যাক্টর বিল্ডিংয়ের মেঝে ও দেয়াল ভেদ করে বাইরে আসতে পারবে না। অর্থাৎ এই রিঅ্যাক্টর হতে কখনোই পরিবেশের বা এর আশপাশে বসবাসকারী লোকজনের কোনো ক্ষতি হবে না।  
নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেলের অভ্যন্তরে পারমাণবিক বিক্রিয়ার ফলে ইউরেনিয়াম জ্বালানির যে সকল তেজস্ক্রিয় পদার্থ উৎপন্ন হবে, তা যাতে কোনো অবস্থাতেই পরিবেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে লক্ষ্যে রূপপুরের রিঅ্যাক্টরে পাঁচ স্তরবিশিষ্ট বিশেষ নিরাপত্তা বেষ্টনির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এখানে প্রথম নিরাপত্তা বেষ্টনি হচ্ছে ফুয়েল প্যালেট, অর্থাৎ জ্বালানির গঠন। রিঅ্যাক্টরে ব্যবহৃত জ্বালানি ইউরেনিয়াম ডাই-অক্সাইড (UO2)-এর গঠন অনেকটা সিরামিকের মতো। এ ধরনের গঠনের ফলে পারমাণবিক জ্বালানির ভেতরের অংশে উৎপাদিত তেজস্ক্রিয় পদার্থ সহজে বেরিয়ে আসতে পারে না বলে এটিকে প্রথম নিরাপত্তা বেষ্টনি হিসেবে গণ্য করা হয়। এর পরের বেষ্টনি হচ্ছে পারমাণবিক জ্বালানির চারপাশে ঘিরে থাকা জিরকোনিয়াম (Zr) ধাতু দ্বারা তৈরি আবরণ বা ক্ল্যাডিং। তৃতীয় স্তরে রয়েছে প্রেসার ভেসেল, যা ২০ সেন্টিমিটার পুরু ইস্পাত দিয়ে তৈরি। চতুর্থ এবং পঞ্চম নিরাপত্তা বেষ্টনি হিসেবে কাজ করে যথাক্রমে প্রথম এবং দ্বিতীয় কনটেইনমেন্ট বিল্ডিং। প্রথম কনটেইনমেন্ট বিল্ডিংয়ে ১.২০ মিটার পুরু বিশেষ কংক্রিটের দেয়াল এবং দ্বিতীয় কনটেইনমেন্ট বিল্ডিংয়ে ০.৫০ মিটার পুরু বিশেষ কংক্রিটের দেয়াল রয়েছে। এটি এমনভাবে তৈরি করা হবে যে ঘন্টায় প্রায় ৪৫০ মাইল বেগে ধাবমান ৫.৭ টন ওজনের একটি বিমান এটির উপরে আছড়ে পড়লেও কনটেইনমেন্টের কোনো ক্ষতি হবে না। এ ছাড়া এটি রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্প সহনীয়। ঘণ্টায় প্রায় ১২৫ মাইল গতিবেগের শক্তিশালী টর্নেডোও এর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

সহযোগিতা করছে আইএইএ

দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন সময়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা মানবসম্পদ উন্নয়নে সহযোগিতা করছে। দক্ষ জনবল তৈরির জন্য তিন বছর মেয়াদি ইন্টিগ্রেটেড ওয়ার্ক প্ল্যান করা হয়। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার এক্সপার্ট মিশন নিয়মিত প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে এবং প্রকল্পের সার্বিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করে পরামর্শ দেয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ডকুমেন্ট রিভিউ কার্যক্রমে আইএইএর বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়া ছাড়াও ভারত হতেও সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে।

অর্থনৈতিক গুরুত্ব

উৎপাদন বাড়বে: অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের মতে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে নব এক বাতায়ন খুলে যাবে। কৃষি, শিল্পসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে উৎপাদন অনেক বেড়ে যাবে। অর্থনীতির গতি তরান্বিত হবে।  সমগ্রিক অর্থনীতিতে এর একটা বিরাট প্রভাব পড়বে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ৩৩তম পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।  

কর্মসংস্থান: ২০১৩ সালের ২ অক্টোবরে রূপপুরে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তি স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে টেকসই ও কম দামে মানুষ বিদ্যুৎ পাবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। কেন্দ্র স্থাপনের কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে।  

বৈদেশি মুদ্রা অর্জন: এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে দেশে পারমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনায় দক্ষ জনবল গড়ে উঠেছে। যারা বিশ্ব নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রিতে অবদান রাখার মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম হবে। যার ফলে আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা তথা আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। অধিকন্তু বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবে।

সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ: স্বল্প আয়তনের ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসাবে বাংলাদেশ টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পারমাণবিক উৎসের ওপর নির্ভর করা অনেকাংশেই সমীচীন। কারণ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আয়ুষ্কাল সাধারণত ষাট বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। পরে তা আশি বছর পর্যন্ত বাড়ানো যায়। সেখানে জীবাশ্ম জ্বালানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ পঁচিশ বছর হয়ে থাকে। তাই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ব্যয় প্রাথমিকভাবে বেশি হলেও দীর্ঘদিন বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারণে সাশ্রয়ী মূল্যে এ কেন্দ্র থেকে জনগণ বিদ্যুৎ পেয়ে থাকে। এদিকে ফুয়েল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অনেক সাশ্রয়ী। যেমন একগ্রাম ইউরেনিয়াম ব্যবহারে প্রায় ২৪ হাজার কিলোওয়াট আওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। অন্যদিকে সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে তিন টন কয়লার প্রয়োজন হয়। এদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য যে পরিমাণ জায়গার প্রয়োজন হচ্ছে সে পরিমাণ স্থানে আমরা যদি সৌর প্যানেল বসাই, তাহলে মাত্র আট মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। অথচ দুটি রি-অ্যাক্টর থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা দুই হাজার চারশ মেগাওয়াট।  

জিডিপি প্রবৃদ্ধি: প্রাথমিকভাবে এই কেন্দ্র চালু হলে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) অন্তত ২ শতাংশ অবদান রাখবে বলে আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা।  

বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি: রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে। বেজার তথ্য মতে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে উত্তরাঞ্চলের সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার খাসবড়শিমুল, পঞ্চসোনা, চকবয়রা এবং বেলকুচি উপজেলার বেলছুটি ও বড়বেরা খারুয়া এলাকায় প্রতিষ্ঠিত দেশের অন্যতম এই ইকোনমিক জোনের আয়তন ১০.৩৫৯৩ একর। বিদ্যুৎসহ পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেলে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে পর্যাক্রমে ৭০০টির মতো ছোট-বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। তা হলে মাসে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্যসামগ্রী উৎপাদন সম্ভব।

শেষ কথা

যেকোনো দেশের মূল চালিকা শক্তি বিদ্যুৎ। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন দায়িত্ব নেন, তখন দেশের মাত্র ৪৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেত। নিয়মিত লোডশেডিংয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত ছিল। বিদ্যুৎ খাতের এ করুণ অবস্থার কারণে বৃহৎ শিল্পগুলো যেমন একদিকে ধুঁকছিল, তেমনিভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়েও কোনো উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু মাত্র এক যুগের মধ্যে দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন নিশ্চিত করতে সমর্থ হয় সরকার। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশ যে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে, সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৫,০০০ মেগাওয়াট হতে প্রায় ২০,০০০ মেগাওয়াটে বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ বছর রূপপুরের দুটি পারমাণবিক চুল্লি থেকে প্রায় ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে বলে বলা হচ্ছে। যা দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। এটি ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের অভীষ্ট অর্জনে সহায়তা করবে।

news24bd.tv/আইএএম