সড়কের ওপর সড়ক

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

সড়কের ওপর সড়ক

মো. ইস্রাফিল আলম

‘অনেক প্রত্যাশার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠলে মনে হয় না যে দেশে আছি বা ঢাকায় আছি, মনে হয় অন্য কোনো স্বপ্নের দেশে চলে গেছি। এত ভালো লাগে, পুরো রাস্তায় কোনো যানজট নেই। চারপাশের সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে পার হওয়া।

আর রাতের বেলা তো আরও অসাধারণ লাগে যখন স্ট্রিটলাইটগুলো জ্বলজ্বল করে আলোকিত হতে থাকে। ’ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারের পর কথাগুলো বলছিলেন আফরোজা বেগম। আফরোজা বেগমের মতো অনেকের ঢাকা শহরের চিরায়ত যানজটের ধারণা কিছুটা হলেও বদলে দিয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।

কেন এক্সপ্রেসওয়ের সিদ্ধান্ত?

২০১৮ সালে পরিচালিত বুয়েটের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকা শহরের যানজটের জন্য বার্ষিক ৪.৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়, যা জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশের বেশি।

২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩.৮ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। অথচ একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও যুগোপযোগী অবকাঠামো। তাই ঢাকা শহরকে যানজটমুক্ত ও রাস্তাঘাটের উন্নয়নে ঢাকায় একটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে শুরু হয়ে কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী এলাকায় গিয়ে শেষ হবে এই প্রকল্প। এরই মধ্যে গত ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ উত্তরা থেকে ফার্মগেট অংশের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।         

যেভাবে শুরু

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জমি বুঝে না পাওয়া, নকশায় জটিলতা ও অর্থায়নের অভাবে এর নির্মাণ কাজ শুরুতে কিছুটা সময় কেটে যায়। তবে পরবর্তী সময়ে বিমান বন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের গতি বৃদ্ধি পায়।  

উদ্বোধন 

২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ পূর্ণাঙ্গ এক্সপ্রেসওয়েটির উত্তরা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উত্তরা থেকে তেজগাঁও, ফার্মগেট, মগবাজার হয়ে চিটাগাং রোডের কুতুবখালী পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের দূরত্ব ১৯.৭৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১১ কিলোমিটার পথের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। ২০২৪ সালের মধ্যে তেজগাঁও থেকে যাত্রাবাড়ী অংশের কাজ শেষ হওয়ার কথা।

অবকাঠামোর দৈর্ঘ্য

এর দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। চালু হওয়া বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ১১.৫ কিলোমিটার। প্রায় ২০ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়েতে উঠা-নামার জন্য মোট ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি র্যাম্প রয়েছে। এই র্যাম্পসহ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৭ কিলোমিটার।

ভৌত কাঠামো

প্রকল্পের ভৌত কাজের প্রথম ধাপে ১৪৮২টি পাইল, ৩২৬টি পাইল ক্যাপ, ৩২৫টি কলাম, ৩২৫টি ক্রস বিম, ৩০৪৮টি আই গার্ডার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। এছাড়া ৩০৪৮টি আই গার্ডার এবং ৩২৮টি ব্রিজ স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়। প্রকল্পের ভৌত কাজের দ্বিতীয় ধাপে ১৬৩৩টি পাইল, ৩৩৫টি পাইল ক্যাপ, ৩২৩টি কলাম, ৩২০টি ক্রস বিম, ২৩০৫টি আই গার্ডার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। এছাড়া ২০৪৪টি আই গার্ডার এবং ২৩৩টি ব্রিজ স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়। এছাড়া প্রকল্পের ভৌত কাজের তৃতীয় ধাপের কাজও এগিয়েছে অনেক খানি।

র‌্যাম্প

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের সামনে থেকে ফার্মগেট প্রান্ত পর্যন্ত বর্তমানে যান চলাচল করছে। এ পথের দূরত্ব সাড়ে ১১ কিলোমিটার। র‌্যাম্পম্পসহ এ পথের মোট দৈর্ঘ্য সাড়ে ২২ কিলোমিটার। ১১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে র‌্যাম্প রয়েছে ১৫টি, যার মধ্যে বিমানবন্দরে দুটি, কুড়িলে তিনটি, বনানীতে চারটি, মহাখালীতে তিনটি, বিজয় সরণিতে দুটি এবং ফার্মগেটে একটি। এগুলো যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।

নির্মাণ ব্যয়

প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়, ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ডিং (ভিজিএফ) তহবিল দুই হাজার ৪১৩ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশ সরকার প্রদান করবে।

এক্সপ্রেসওয়েটি তৈরি হচ্ছে সরকারের সেতু বিভাগের তত্ত্বাবধানে। ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (এফডিইই) কোম্পানি লিমিটেড এক্সপ্রেসওয়েতে বিনিয়োগকারী কোম্পানি। এতে ইতালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার রয়েছে ৫১ শতাংশ, চায়না শানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপের (সিএসআই) শেয়ার ৩৪ শতাংশ এবং সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেডের ১৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।

টোল

সরকার নির্ধারিত টোল অনুযায়ী, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি, ট্যাক্সি, জিপ, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল, মাইক্রোবাস (১৬ সিটের কম) ও হালকা ট্রাকের (৩ টনের কম) জন্য দিতে হয় (ভ্যাটসহ) ৮০ টাকা। আর মাঝারি ট্রাকের জন্য (৬ চাকা পর্যন্ত) ৩২০ টাকা, ৬ চাকার বেশি ট্রাকের জন্য ৪০০ টাকা ও আর সব ধরনের বাসের (১৬ সিট বা এর বেশি) জন্য দিতে হয় ১৬০ টাকা।

উত্তরা-ফার্মগেট যেখান থেকে উঠবেন-নামবেন

নির্ধারিত টোল পরিশোধ করে কোন কোন স্থান থেকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠা-নামা যাবে তা ঠিক করে দিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। উত্তর থেকে দক্ষিণ অভিমুখী যানবাহন ওঠার স্থান—১. হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা। ২. প্রগতি সরণি এবং বিমানবন্দর সড়কের আর্মি গলফ ক্লাব।   উত্তর থেকে দক্ষিণ অভিমুখী যানবাহন নামার স্থান— ১. বনানী কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ। ২. মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে। ৩. ফার্মগেট প্রান্তে ইন্দিরা রোডের পাশে। দক্ষিণ থেকে উত্তর অভিমুখী যানবাহন ওঠার স্থান— ১. বিজয় সরণি ওভারপাসের উত্তর ও দক্ষিণ লেন। ২. বনানী রেলস্টেশনের সামনে। দক্ষিণ থেকে উত্তর অভিমুখী যানবাহন নামার স্থান— ১. মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে। ২. বনানী কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউর সামনে বিমানবন্দর সড়ক। ৩. কুড়িল বিশ্বরোড ও  ৪. বিমানবন্দর তৃতীয় টার্মিনালের সামনে থেকে।

যেসব বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা 

আপাতত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে দুই ও তিন চাকার যানবাহন এবং পথচারী চলাচল সম্পূর্ণ নিষেধ। একইসঙ্গে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ওপর যেকোনো ধরনের যানবাহন দাঁড়ানো ও যানবাহন থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ছবি তোলাও সম্পূর্ণ নিষেধ।

সুবিধা

যানজট নিরসন: সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পসমূহের আওতাধীন যোগাযোগ অবকাঠামোর এই বিশাল প্রকল্পটি ঢাকা শহরের যানজট নিরসনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে শুরু করেছে। বিশেষ করে ফার্মগেট থেকে বননী হয়ে উত্তরা রুটে যে অসহনীয় যানজট তা থেকে বেশ কিছুটা মুক্তি পেয়েছে মানুষ। মানুষ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে খুব সহজে এ পথে যাতায়াত করতে পরছে। যানজটের কারণে আগে যে শ্রমঘণ্টা নষ্ট হতো তা অনেকাংশে কমে এসেছে। এই উড়াল সড়ক সবটা সম্পন্ন হলে এই সুবিধা আরও বহু গুণে বেড়ে যাবে; যা রাজধানীতে বসবাসকারী সাধারণ জনগণসহ উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের সার্বিক কার্যক্রমে বহুমাত্রিক পরিবর্তন আনবে।

জনমনে স্বস্তি: রাজধানীবাসীর অস্বস্তির সবচেয়ে বড় কারণ ট্রাফিক জ্যাম। উত্তরা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত পথ পাড়ি দিতে যেখানে মানুষের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করা লাগতো, সেখানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে আধাঘণ্টার মধ্যেই এ পথ পাড়ি দেওয়া যাচ্ছে। রোদ-গরমে এখন গাড়ির মধ্যে অস্বস্তিতে ভুগতে হয় না নগরবাসীর।     

সহজে পণ্য পরিবহন: যোগাযোগের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। গাজীপুর, আশুলিয়া, টঙ্গীসহ রাজধানীর আশপাশের শিল্পঞ্চলের রফতানি পণ্যবাহী যানবাহন এই উড়াল সড়ক ব্যবহার করে সহজে ফার্মগেট পর্যন্ত আসতে পারছে। পুরো সড়ক নির্মাণ হলে ঢাকার যানজট এড়িয়ে এসব পরিবহন চট্টগ্রাম ও মোংলাবন্দরসহ গন্তব্যে যেতে পারবে সহজে। এতে বাঁচবে সময় ও খরচ।

পোশাক রপ্তানিতে গতি: রাজধানীর উত্তর অংশে গাজীপুর শিল্পাঞ্চল। বেশিরভাগ তৈরি পোশাক শিল্প এ এলাকায়। এসব রফতানি পণ্য রাজধানীর যানজট পেরিয়ে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরসহ নির্ধারিত গন্তব্যে যাওয়া ছিল বেশ ঝক্কির বিষয়। তবে সেই কষ্টের দিন ফুরানো এখন সময় ব্যাপার মাত্র। পুরোপুরি ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ হলে এই উড়াল সড়ক ধরে রাজধানীর চিরায়ত যানজট এড়িয়ে কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে রফতানিজত এসব পণ্য। গাজীপুর এবং সাভার থেকে উৎপাদিত পণ্য স্বল্প খরচে ও দ্রুততম সময়ে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে পৌঁছাতে সাহায্য করবে, যা আমাদের স্থানীয় বাণিজ্যের পাশাপাশি প্রতিবেশি দেশসমূহের সাথে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করবে।

জিডিপিতে অবদান: এ উড়াল সড়কটি বাংলাদেশের বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিতের পাশাপাশি আমাদের জিডিপিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। এটি সামনের দিনগুলোতে দেশের অবকাঠামোগত এবং অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আরও কার্যকর অবদান রাখবে।

পর্যটন শিল্পের বিকাশ: এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পুরোপুরি শেষ হলে তা পর্যটন শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। হযরত (রা.) শহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর হতে খুব শহজে ঢাকা শহরের ওপর দিয়ে ক্সবাজারে সমুদ্র সৈকত ও সুন্দরবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পটে যাওয়া যাবে।

শেষ কথা

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। এটি পুরোটা সম্পন্ন হলে বাংলাদেশের শুধু যোগাযোগ খাতে নয়, দেশের অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে আরও অবদান রাখবে। এই উড়াল সড়ক দেশের জন্য নতুন দিগন্তের দুয়ার খুলে দিচ্ছে। সরকারের যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ভিশন রয়েছে, সেই লক্ষ্যে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।

news24bd.tv/আইএএম