কেন আশফাকুলের বাসায় মেয়ে দুটি কাজের জন্যে গিয়ে মৃত্যু চায় ? 

প্রিসিলা রাজ

নাসিরনগর ও কুলাউড়া থেকে ফিরে

কেন আশফাকুলের বাসায় মেয়ে দুটি কাজের জন্যে গিয়ে মৃত্যু চায় ? 

 প্রিসিলা রাজ

নাসির নগরের ছোট মেয়েটি

১) কেন মরতে চেয়েছিল সাত বছরের শিশুটি

ঢাকা থেকে ট্রেনে আশুগঞ্জ। সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশায় করে বেশ লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে নাসিরনগরের এক গ্রাম। অবশেষে গ্রামের ভেতরের ঘিঞ্জি এক বসতিতে পৌঁছে যাই। আমাদের গন্তব্য এখানেই।

গায়ে গায়ে লাগানো টিনের ঘর। হতশ্রী। দারিদ্র্য মুখ ব্যাদান করে আছে। শিশুটির নাম বলতে আশেপাশে জুটে যাওয়া কৌতূহলীদের একাংশ বাড়িটি দেখিয়ে দেন।
আমরা দরজায় টোকা দিয়ে মেয়েটির নাম ধরে ডাকি। ওর মা বেরিয়ে আসেন অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে। একটু পরে শিশুটিও এসে যায়। পাড়ার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলতে গিয়েছিল সে।  
শিশুটির মা কয়েকটা ঘরের মাঝখানে ছোট্ট এক চিলতে ফাঁকায় প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসার ব্যবস্থা করেন। আশেপাশের বউঝিরা ভিড় করে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের জানাই ওপর থেকে পড়ে যাওয়া শিশুটিরখোঁজ-খবর করতে এসেছি। আমরা অর্থাৎ আমি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ফারহা তানজিম তিতিল এবং স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক-সমাজকর্মী বন্ধু।  
দেশের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের মোহাম্মদপুরের আটতলার ফ্ল্যাট থেকে সাত বছরের শিশুটি পড়ে যায় গত বছরের (২০২৩) ৬ই আগস্ট। কীভাবে সাত বছরের একটি শিশুকে বাড়ি থেকে এত দূরে কাজে পাঠানো হলো তার পরিপ্রেক্ষিত বলেন শিশুটির মা। শিশুটির বাবার দুই বিয়ে। তিনি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। তেমন কাজ করতে পারেন না। দুই ঘরে তাঁর বেশ কয়েকটি সন্তান। টানাটানির সংসারে বাধ্য হয়ে তাঁরা একটি মেয়েকে ঢাকার সেগুনবাগিচায় এক বাড়িতে কাজে পাঠান। এই বাড়িতে বসবাসরত পরিবারের আত্মীয় বা বন্ধু আশফাকুল হক ও তানিয়া খন্দকার দম্পতি। সেই সূত্রে শিশুটিকে আশফাক দম্পতির বাসায় কাজে রেখে আসেন তার মা। কিন্তু রেখে আসার চার দিনের মাথাতেই শিশুটির পড়ার ঘটনা ঘটে।
বড়দের কথার মাঝখানে শিশুটি আমাদের কোলে বসেছিল। যদিও খেলাধুলা করছে সে তবে পুরোপুরি সুস্থ হতে তার এখনও অনেকদিন বাকি। বা, আদৌ সে পুরোপুরি কখনও সুস্থ হবে কিনা সেটাও নিশ্চিত নয়। তার মাথার পেছনটা ফুলে উঁচু হয়ে আছে যা সেরে উঠতে সময় লাগবে। আর—মা বললেন, সে স্বামীর সংসার করতে পারবে না। বিয়ে দিলে ফিরে আসবে। মা জানালেন, ওর জননাঙ্গে বেশ কয়েকটা সেলাই লেগেছে। প্রস্রাব করতে গেলে ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে শিশুটি। নয়তলার ওপর থেকে পড়ে গ্যারেজ বা এমন কিছুর ছাদে পড়েছিল মেয়েটি, ফলে তার হাত-পা ভাঙেনি। কেবল মাথার বহিরাঙ্গের আঘাতটি দৃশ্যমান। তাহলে জননাঙ্গের ভেতরে ওই গভীর ক্ষত কীভাবে হলো?
ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ওখানে কী কাজ করতে, মা?’ আমাদের প্রশ্নের উত্তরে সে জানায় তাকে চাল বাছতে দেওয়া হয়েছিল। খেলাচ্ছলে এমনি নানান আলাপ করতে করতে যখন আমরা ওই দিনের ঘটনার দিকে যাচ্ছিলাম, উল্লেখ মাত্রই শিশুটি মুখ বন্ধ করে ফেলল। চোখে তার ভয়ার্ত দৃষ্টি আর কথা বলায় নিদারুণ অনীহা। অনেকটা সময় নিয়ে, অনেক আদরের পর শিশুটি জানায় সে ব্যথা পেয়েছিল পড়ে যাওয়ার আগে। এরপর শিশুটির সঙ্গে আরও গভীরভাবে কথা বলার তাগিদে ওকে নিয়ে আমরা ঘরের ভেতরে যাই।  
প্রথমদিকে ঘরের ভেতরে শিশুটির সঙ্গে কথা বলার বিষয়টি কঠিন ছিল। আশেপাশের বাসার বউ-ঝিরা এসে প্রতিবাদ করতে লাগলেন। তাঁদের ধারণা আমরা পরিবারটির ক্ষতি করতে গিয়েছি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোনো ঘটনার অনুসন্ধানে গেলে প্রাথমিক যে প্রশ্ন ও বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়, এ যেন তার চেয়েও বেশি। এক ধরনের ভয়ের পরিবেশ বিরাজ করছে বলে মনে হলো। এক পর্যায়ে মেয়েটির বাবা ভয় পেয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লেন। আমাদের প্রতি শিশুটির প্রাথমিক ভয় ও সংকোচ ততক্ষণে অনেকটাই কেটে গিয়েছিল। বৃদ্ধ মেয়েকে নিজের কাছে টানলেও সে যেতে চাচ্ছিল না। আরও কিছুটা সময় যাওয়ার পর শিশুটি ওই বাসায় বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা বলে। শিশুটি জানায় ওর মরে যেতে ইচ্ছা হয়েছিল আর সেজন্যই সে নিচে লাফিয়ে পড়েছিল।
শিশুটিকে যখন সৈয়দ আশফাকুল হক ও তানিয়া খন্দকার দম্পতির বাসায় কাজ করতে দেওয়া হয় তার বয়স ছিল সাত থেকে সাড়ে সাত বছর। জীবন-মৃত্যু সম্পর্কে তার কোনো বোধ তৈরি হওয়ার কথা নয় বোধহয় এই বয়সে। কিন্তু এই চারদিনের অভিজ্ঞতা তাকে জানিয়ে দিয়েছিল, বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। আর সেই মৃত্যু যদি আটতলার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে হয় তারপরও তা কাম্য।  
এরপরে আমরা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, মহিলা মেম্বার এবং ইউনিয়ন পরিষদের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে কথা বলি। আমাদের আলোচনায় বেশ কয়েকটি বিষয় উঠে আসে। শিশুটির সঙ্গে কথা বলে যে তথ্য আমরা পেয়েছি তা তাঁদের জানালে তাঁরা বলেন, শিশুটি এই বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে সেটি তাঁদের কল্পনাতেও আসেনি।  

২) পড়ে যাওয়ার দিনের ঘটনা: যা বলল পুরানো গৃহকর্মী

এই শিশুটি যখন আশফাক-তানিয়া দম্পতির বাসায় ছিল একই সময় আরেকজন গৃহকর্মী সেখানে কর্মরত ছিল। সম্পর্কে মেয়েটি ওই বাসা থেকেই পড়ে মারা যাওয়া আরেক গৃহকর্মী প্রীতি উরাংয়ের খালাতো বোন। তার বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ায়। নাসিরনগরের পরে আমরা সেখানেও যাই। মেয়েটির বয়স ১৭ বছর বা তার কিছু বেশি হতে পারে। সে জানায় আট বছর বয়সে সে আশফাক-তানিয়া দম্পতির বাসায় কাজ করতে শুরু করে। অর্থাৎ নয় বছর ধরে সেখানে কাজ করেছে সে।  
কিশোরীর দেওয়া বিবরণ অনুযায়ী ওই ফ্ল্যাটে বাইরের দরজা দিয়ে ঢুকলে পড়ে বেশ বড় একটি ঘর যাবৈঠকখানা, খাওয়ার জায়গা এবং ‘লিভিং রুম’ এই তিনটির সমন্বয়। এই ঘরেই টিভি দেখার ব্যবস্থা। এখানেই লিভিং রুমের জায়গায় রাতে মেঝেয় বিছানা পেতে গৃহকর্মীদের শোবার ব্যবস্থা। ঘরের একদিকে আশফাক-তানিয়া দম্পতির ছেলের ঘর, একদিকে মেয়ের ঘর (সে এখন প্রবাসে অধ্যয়নরত, ফলে ঘরটি আশফাকুল হক কাজের ঘর হিসেবে ব্যবহার করেন) এবং আরেকদিকে আশফাক-তানিয়ার শোবার ঘর। গৃহকর্তা-কর্ত্রীর শোবার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দার গ্রিলের একটি অংশ মেঝে থেকে বেশ ওপর পর্যন্ত কাটা। গ্রিলের ওপারে রাস্তা। কিশোরী জানায় সে ওই দম্পতিকে খালাম্মা ও খালু বলে সম্বোধন করত, যদিও আমাদের সঙ্গে কথপোকথনের সময় সে তাদেরকে মূলত ‘স্যার’ ও ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করছিল।
শিশুটি যেদিন পড়ে যায় সেদিনের বর্ণনা করে কিশোরী গৃহকর্মীটি। সে জানায় ওইদিন দুপুরে খাওয়ার পর সে এবং শিশুটি ওই দম্পতির ঘরে গিয়ে শোয়। ওই সময় আশফাকুল হকও বাসায় ছিলেন এবং একই ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। বিকেলের দিকে বৈঠকখানায় গিয়ে তানিয়া টিভি খুলে দেখতে দেন শিশুটিকে। এরপর তিনি নামাজ পড়তে চলে যান। কিশোরী গৃহকর্মী তখন তানিয়াদের ঘরে ঘুমাচ্ছিল। তার ঘুম ভাঙে নিচে কোলাহলের শব্দে। নিচে থেকে ফোনে শিশুটির পড়ে যাওয়ার কথা জানায় কর্তব্যরত প্রহরী ও কর্মীরা। কিশোরীর বিবরণ থেকে প্রতীয়মান হয়, আশেপাশের মানুষের প্রতিবাদ ও ভিড়ের মুখে আশফাক-তানিয়া দম্পতি সম্ভবত নিচে নামার সাহস করেননি। ফোনে অ্যাপার্টমেন্ট কর্মীদের নির্দেশনা দিয়ে শিশুটিকে হাসপাতালে পাঠান।  
কিশোরীর বক্তব্য অনুযায়ী, গৃহকর্মী শিশুটি ড্রইং-কাম-ডাইনিং-কাম লিভিং রুমের গ্রিলবিহীন জানালা দিয়ে লাফ দিয়েছিল বা পড়ে গিয়েছিল। জানালা লাগোয়া যে সোফা ছিল তার ওপরে চড়ে শিশুটি জানালার কিনারে পৌঁছেছিল।  
সুতরাং কিশোরীর ভাষ্য অনুযায়ী ওই বাসায় দুটি গ্রিলবিহীন জায়গা ছিল যেখান থেকে পড়ে যাওয়া, ঠেলে ফেলে দেওয়া বা লাফিয়ে পড়া সম্ভব ছিল। এর একটি হচ্ছে ড্রইং-কাম-ডাইনিংয়ের জানালা, অপরটি হচ্ছে আশফাক-তানিয়ার ঘর লাগোয়া বারান্দার কাটা গ্রিলের অংশটি। দুজন গৃহকর্মী দুটি ভিন্ন জায়গা দিয়ে নিচে পড়েছিল।  
প্রীতির বোনের ভাষ্যে যে গরমিল রয়েছে তার সঙ্গে কথা বলার সময়ই সময়ই টের পেয়েছিলাম কারণ তার ভাষ্যে মাঝেমধ্যেই স্ববিরোধিতা ঘটছিল। স্ববিরোধের জায়গায় প্রশ্ন করলেই সে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিচ্ছিল। তবে সে যে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিল তা আশফাক-তানিয়ার বাড়িটি পরিদর্শনে গিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলার সময় স্পষ্ট হয়।  
প্রীতির বোন বলেছিল, ওই ফ্ল্যাটে দুটি ফাঁকা জায়গা ছিল যেখান দিয়ে লাফ দেওয়া যায় বা ফেলে দেওয়া যায়। প্রত্যক্ষদর্শী, এলাকাবাসী এবং ওই ফ্ল্যাটে গিয়েছেন এমন একজন প্রতিবেশী জানিয়েছেন ওই ফ্ল্যাটে একটিই ফাঁকা জায়গা ছিল। থাইগ্লাস লাগানো বড় জানালায় গ্রিল না দেওয়ার ফলে ফাঁকাটি তৈরি হয়। শিশু গৃহকর্মীটিকে পড়তে দেখেছিলেন এমন দাবিদার একজন আমাদের ফাঁকা জায়গাটি দেখিয়ে দেন। রাস্তার ওপর থেকে দেখলে জানালা লাগোয়া কার্নিশে টব রাখার জন্য লোহার ফ্রেমও দেখা যায়। সুতরাং প্রীতির বোন কেন আমাদের মিথ্যা তথ্য দিলো সে রহস্যেরও কিনারা হওয়া প্রয়োজন।

৩) কয়েকটি প্রশ্ন

৬ই আগস্ট শিশুটির মা-বাবার কাছে খবর আসে সাড়ে আটটা বা নটার দিকে। রাত হয়ে যাওয়ায় তাঁরা অত ভেতরের গ্রাম থেকে ঢাকা রওনা দিতে পারেননি। পরদিন প্রতিবেশীদের থেকে টাকা ধার করে শিশুটির মা প্রতিবেশীদের মধ্যেই কাউকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। তিনি জানান, ঢাকায় এসেই তিনি সরকারি হাসপাতালে যান যেখানে তাঁর সন্তানের চিকিৎসা চলছিল। পরে তাকে আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। পুরো সময়টি মা সন্তানের পরিচর্যায় পাশে ছিলেন। শিশুটির জননাঙ্গে ক্ষত কীভাবে হলো জানতে চাইলে মা বলেন, ‘কেমনে কমু?’
শিশুটি যেমন বলেছে সে লাফিয়ে পড়ার আগে দুই পায়ের মাঝখানের অংশে ব্যথা পেয়েছে, এ বিষয়ে বিশদ জানার জন্য প্রয়োজন বাইরের প্রভাববিহীন অধিকতর মেডিকেল পরীক্ষা।  
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিশুটির শারীরিক ক্ষতি সারাতে সঠিক চিকিৎসার প্রসঙ্গ। একইসঙ্গে তার যে অপূরণীয় মানসিক ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে দরকার শিশু মনোবিশেষজ্ঞের সহায়তা। দরকার তার বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ। মায়ের আশঙ্কা যদি শেষ পর্যন্ত সত্যি হয় এবং সে যদি বড় হয়ে বিবাহিত জীবন থেকে বঞ্চিত হয় তবে স্বাবলম্বিতাই হবে একমাত্র অবলম্বন। আর জীবনের অপূরণীয় ক্ষতি? তার পূরণ কীভাবে হবে কে তা বলতে পারে।
যে প্রশ্নটি তোলা প্রয়োজন তা হচ্ছে, একটি ছোট শিশু গৃহকর্মী নিয়োগকারীর বাসা থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনা কি আদৌ নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে নিষ্পত্তি করা যায়?
একটি সাত বছরের শিশু মরবে বলে আটতলা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল। রাষ্ট্র, পরিবার, সমাজ, সকলেই যে তার পাশে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছে। এর চেয়ে গ্লানিকর আর কী হতে পারে? 
আমাদের সঙ্গে আলোচনায় ইউনিয়ন পরিষদের নেতৃবৃন্দ এবং স্থানীয়রা বলেছেন, তাঁরা অন্তত শিশুটির পাশে থাকবেন। সে কথা তাঁরা রাখবেন কিনা একমাত্র ভবিষ্যতই বলে দেবে।  

৪) শিশু গৃহকর্মীর বয়স

এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে এই দম্পতির বাসায় শিশু গৃহকর্মীদের বয়স বিষয়ে। বাংলাদেশে একেক আইনে শিশুর সর্বোচ্চ বয়স একেক রকম নির্ধারণ করা হয়েছে। গৃহকর্মীর বিষয়ে শ্রম আইনের প্রসঙ্গটিই এখানে আমরা আলোচনা করি। এর (৬৩) ধারায় ১৪ বছর পর্যন্ত সকল ব্যক্তিকে শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আইনের ৪৪ ধারার (১) উপধারা অনুযায়ী—‘বারো বৎসর বয়ঃপ্রাপ্ত কোনো শিশুকে এমন কোনো হালকা কাজে নিয়োগ করা যাইতে পারিবে যাহা তাহার স্বাস্থ্য ও উন্নতির জন্য বিপজ্জনক নহে, অথবা যাহা তাহার শিক্ষা গ্রহণকে বিঘ্নিত করিবে না...’
এখনও আইনে পরিণত না হওয়া গৃহকর্মী বিষয়ক নীতিমালাতেও শিশু গৃহকর্মী নিয়োগ বিষয়ে নীতি শ্রম আইনে এ সংক্রান্ত ভাষ্যের অনুরূপ।
এ পর্যন্ত যে তিনজন গৃহকর্মী আমরা পেয়েছি কাজে যোগদানের সময় তাদের বয়স ছিল, একজনের সাত থেকে সাড়ে সাত, একজনের আট এবং একজন (প্রীতি) ১১ বছর বয়সী। তিনটি ক্ষেত্রেই আশফাক-তানিয়া এ সংক্রান্ত শ্রম আইনের বিধান লঙ্ঘন করেছেন। শুধু তা-ই নয়, প্রীতি এবং তার বড় বোন যথাক্রমে দুই ও নয় বছর কাজ করা সত্ত্বেও এই দম্পতি তাদের লেখাপড়ার সুযোগ দেননি, যা প্রীতির বড় বোনের ভাষ্যে বেরিয়ে এসেছে।
দেশ ও সমাজের বিবিধ অসঙ্গতি তুলে ধরার ক্ষেত্রে দি ডেইলি স্টার পত্রিকার যে ভূমিকা দেখি তার সঙ্গে সেই পত্রিকারই নির্বাহী সম্পাদকের এই ভূমিকা আশ্চর্য বিরোধ তৈরি করে। সমাজের সবচেয়ে শিক্ষিত অংশটির প্রতিভূ একটি পরিবারের এই আচরণ কীভাবে সম্ভব?

৫) ভয় এবং আরো কিছু প্রশ্ন

আশফাক-তানিয়া দম্পতির বাসায় যে কিশোরী গৃহকর্মী প্রীতি উরাংয়ের মা নমিতা উরাংয়ের বড় বোনের মেয়ে। প্রীতির বোনের বিবরণ এবং পত্রিকায় প্রকাশিত প্রীতির বাবা-মায়ের কথা থেকে আমরা জানি, বড় বোনের সঙ্গে একই বাড়িতে কাজ করবে এই ধরনের একটি আস্থার জায়গা থেকে তারা প্রীতিকে আশফাকদের বাসায় পাঠান।
কিন্তু প্রীতি যাওয়ার পরে তার খালাতো বোন দুই বছর না হতেই বোনের মৃত্যুতে বাড়ি চলে যায়। তাকে তার পরিবার আর আসতে দেয়নি। এর ফলে প্রীতি আশফাকদের বাড়িতে একাই কাজ করতে থাকে। এর কিছুদিন বাদে তার মৃত্যু হয়।
যে দুই বছর প্রীতি আশফাক-তানিয়া দম্পতির বাসায় ছিল তার মধ্যে শেষ এক বছর তার পরিবারের সঙ্গে তার কোনো কথা হয়নি। প্রীতির বাবা লোকেশ উরাং সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, প্রথম এক বছর আশফাকের ফোনে কয়েকবার মেয়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল। পরের এক বছর যখনই আশফাককে ফোন করেন তখনই তিনি বলতেন বাইরে আছেন। বাসায় গিয়ে ফোন দেবেন। কিন্তু কখনোই ঘুরে লোকেশকে ফোন করেননি।
প্রীতির বোনকে আমরা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তানিয়ার নিজের ফোনেই মেয়েটির বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে কেন সে তাকে অনুরোধ করেনি। বড় বোন হিসেবে এটুকু তার করা উচিত ছিল। কিন্তু আমাদের প্রশ্নের উত্তরে প্রীতির বোন জানিয়েছে ভয়ে সে গৃহকর্ত্রীকে অনুরোধ করতে পারেনি। এই বাড়িতে মেয়েটির শৈশব কেটেছে, দীর্ঘ আট-নয় বছরে সে এখানে বড় হয়েছে, ওই দম্পতি তার ভাষ্যমতে তাকে আদর করতেন। কিন্তু এ কেমন আদর যেখানে ছোট বোনের জন্য সামান্য অনুরোধ করা যায় না?
প্রীতির বোন আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছে। সে জানিয়েছে, প্রীতি সে বাসায় কাজ করতে এলে সে তাকে ফিরে যেতে বলেছিল। কেন? কারণ, সে বাসায় মারধোর করা হতো। কী দিয়ে মারা হতো জানতে চাইলে সে বলে, হাত দিয়ে বা লাঠি দিয়ে মারা হতো। তবে তার ভাষায়, তার নিজেরই ভুলে এমনটা করা হতো। কেন তার মনে হয়েছিল প্রীতি সেই মার সহ্য করতে পারবে না? মেয়েটির উত্তর, প্রীতি ছোট বলে মারধোর সহ্য করতে পারবে না বলে তার মনে হয়েছিল। আবার সেই বোনকেই একা রেখে চলে গিয়ে আর ফিরে আসেনি কিশোরীটি, বা তার পরিবার তাকে আসতে দেয়নি। কেন আর তাকে আসতে দেওয়া হলো না সেই প্রশ্নের উত্তরে কিশোরীটি বা পরিবার পরিষ্কার করে কিছু বলেনি।  

৬) প্রতিবাদ অন্য খাতে নেওয়ার চেষ্টা

প্রীতির মর্মান্তিক মৃত্যুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবাদের মাঝে একটি মহল যুক্ত হয় যাদের পরিচয় খুব স্পষ্ট নয়। প্রীতির পরিবারকে এনে তারা মানববন্ধন করেছে, প্রতিবাদ করেছে। ধারণা করা হয় ডেইলি স্টার বিরোধী একটি পক্ষ ঘটনাটিকে পুঁ জি করে ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে যাতে সরকারের সায় রয়েছে। এর ফলে নানা বিরোধিতার মধ্যেও প্রীতির মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের যে চেষ্টা হয়েছে তা প্রভাবিত হয়েছে বলেই আমাদের মনে হয়।  

৭ ) প্রতিবাদ-প্রতিরোধ জারি থাকা জরুরি

আশফাক-তানিয়া দম্পতি গৃহকর্মী সংক্রান্ত আইন ভঙ্গ করেছেন, প্রীতির সঙ্গে অমানবিক আচরণ করেছেন, তাদের ন্যূনতম পড়ালেখার ব্যবস্থা করেননি—এসবের বাইরেও তাদের বাসায় এমন কী ঘটত বা ঘটেছিল যে দুটি শিশুর ক্ষেত্রে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল তা উদ্ঘাটনের প্রয়োজন আছে।  
ওপর থেকে লাফ দেওয়া শিশুটির বক্তব্য, প্রীতির বোনের বক্তব্য, দুটি মামলার এজাহার, পুলিশি তদন্ত, চিকিৎসকের বক্তব্য এসবই আরও গভীরভাবে দেখার অবকাশ রয়েছে, পুনর্বিবেচনা ও পুনঃতদন্তের প্রয়োজন রয়েছে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনের স্বার্থে।  
বাংলাদেশে সুবিচার এক সোনার হরিণ। বিত্তবান আর বিত্তহীনের আর্থসামাজিক ভারসাম্যের বিপুল ফারাক সেখানে বাধার পাহাড় হয়ে দাঁড়ায়। একটি প্রভাবশালী পত্রিকার উচ্চপদে আসীন একজন ব্যক্তি ও তার পরিবার এই বাধাকে অলঙ্ঘনীয় করে তুলতে পারেন।
নাসিরনগরের অসহায় শিশুটি বা মৌলভীবাজারের প্রত্যন্ত এলাকার প্রান্তিকতম জনগোষ্ঠীর শিশু প্রীতির জন্য সাধারণ মানুষ, বিচার ব্যবস্থা, আইনশৃংখলা ব্যবস্থা, মানবাধিকারের পক্ষের শক্তিগুলো যদি কণ্ঠ না তোলে, সক্রিয় না হয় তবে এই অন্যায় চলতেই থাকবে।  
শুধুমাত্র মানবিকতার তাগিদ, মানব কল্যাণের অন্তর্গত ইচ্ছাই এই পরিস্থিতি থেকে আমাদের উদ্ধার করতে পারে।
news24bd.tv/ডিডি