বিশ্বে ‘ব্লু হেলমেটে’ বাংলাদেশই সেরা

সুদানে এক স্থানীয়’র কাছে সমস্যার কথা শুনছেন বাংলাদেশের দুই শান্তিরক্ষী।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন

বিশ্বে ‘ব্লু হেলমেটে’ বাংলাদেশই সেরা

দেবদুলাল মুন্না

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের প্রতীক ব্লু হেলমেট। আর সেই 'ব্লু হেলমেট'-এ বাংলাদেশ শীর্ষে। এদেশের সেনারা সুনামের সঙ্গে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কাজ করছেন। অর্থ ও উপার্জন করছে।

বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের সঙ্গে সঙ্গে সুনাম কুড়িয়ে আনছেন। দেশের গৌরব তারা। আবার এই শান্তিরক্ষীরা বিদেশের মাটিতে শান্তি ফেরাতে গিয়ে নিজের জীবনও দিচ্ছেন। মারা যাচ্ছেন।
এ ও কম বীরত্বের নয়। তাই জাতিসংঘ পুরস্কৃত করছে বারবার বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের।  

এ পর্যন্ত (২০২৩ সাল) ৪০টি দেশে জাতিসংঘের ৫৬টি শান্তি মিশনে বাংলাদেশের এক লাখ ৮৮ হাজার ৫৫৮ জন শান্তিরক্ষী অংশগ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীর সংখ্যা এক লাখ ৫১ হাজার ৯৩০। বর্তমানে মোট ছয়টি দেশে সর্বমোট ছয়টি বা ততোধিক মিশনে ছয় হাজার ৪৩ জন সেনা সদস্য নিয়োজিত আছেন। নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশসহ মোট শান্তিরক্ষীর সংখ্যা বর্তমানে সাত হাজার ৪৪৬। যে দেশগুলোতে শান্তি মিশন চলছে সেগুলো হলো—আবেই (সুদান), সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, মালি, সাউথ সুদান, ডিআর কঙ্গো ও ওয়েস্টার্ন সাহারা।

অবস্থান :

জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে সর্বোচ্চ সংখ্যক শান্তিরক্ষী পাঠানো ১২৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় ধরে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে ২০২০ সালের জুলাই মাসের পর থেকে এ অবস্থান বহাল। তার আগেও কখনো প্রথম, কখনো দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের পরের অবস্থান যথাক্রমে নেপাল, ভারত, রুয়ান্ডা ও পাকিস্তানের।

প্রথম যোগদান :

শ্রাবণের রোদেলা সকালে ঢাকা বিমানবন্দরে একদল চৌকস সেনা অফিসার কুয়েত এয়ারওয়েজের একটি বিমানে কুয়েত হয়ে বাগদাদ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। লে. কর্নেল ফজলে এলাহী আকবরের (পরে মেজর জেনারেল ও সুদান মিশনে ফোর্স কমান্ডার) নেতৃত্বাধীন সামরিক পর্যবেক্ষক দলটি ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধের জন্য গঠিত শান্তিরক্ষী মিশন ‘ইউনাইটেড নেশনস ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভার গ্রুপ’ (ইউনিমগ)-এ যোগদানের পথে। এটিই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম জাতিসংঘ শান্তি মিশন।

তাঁদের হৃদয়ে প্রিয়জন ও মাতৃভূমি ছেড়ে যাওয়ার বেদনা, চোখে মধ্যপ্রাচ্যের বিস্ময়। ( শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অবসরপ্রাপ্ত) ) ১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরানে সামরিক পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে অংশ নেওয়া শুরু।

আয় :

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা গতবছরের ২ নভেম্বর সংসদ বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে জানায়, জাতীয় সংসদে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বিগত ২০০০-২০০১  থেকে ২০২২-২৩ অর্থ বছর পর্যন্ত বিদেশে শান্তিরক্ষী মিশন থেকে  ২৭ হাজার  ৯৪১ কোটি  ৬৩ লাখ  ৩ হাজার ১৩৮ টাকা  আয় করেছে।

সংসদে সরকারি দলের সদস্য মো. হাবিবর রহমানের টেবিলে উত্থাপিত লিখিত প্রশ্নের জবাবে তিনি এ তথ্য জানিয়েছিলেন। তিনি জানান, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে বার্ষিক গড় আয় ১৫ কোটি ৫ লাখ ৮০ হাজার ৭৪৩  দশমিক ৬১  মার্কিন ডলার যা সমপরিমাণ বাংলাদেশী মুদ্রায় ১ হাজার ২১৪ কোটি ৮৫ লাখ ৩৪ হাজার ৯১৯ দশমিক ৪ টাকা। অন্যদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে, পুলিশের রাজস্ব আয়ের একটি বড় মাধ্যম শান্তিরক্ষা মিশন। গত প্রায় ৩৪ বছরে শান্তিরক্ষা মিশন থেকে পুলিশ চার হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করেছে।

নারী:
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। কেবল পুরুষরাই নয়, নারীরাও শান্তিরক্ষা মিশনে অবদান রেখে চলেছেন অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে। ২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন জানিয়েছিলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের নারী সদস্যরা পথিকৃৎ। এ মিশনে ১ হাজার ৯০০ নারী সদস্যকে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও সদিচ্ছায় বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে চলেছে। শান্তিরক্ষায় আমাদের নারীরা এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের অনেক কঠিন ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের নারীরা কাজ করছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে জুডিশিয়াল কর্মকর্তা হিসেবেও বাংলাদেশের নারীরা নিয়োজিত। বর্তমানে দক্ষিণ সুদানে নিয়োজিত জাতিসংঘ মিশন (ইউএনএমআইএসএস) ও ইউএনএসওএমে নারীরা বিচারক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। শান্তিরক্ষার সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের তিন দশক পূর্ণ হয়েছে আগেই।

মিশনে প্রথম নারী পুলিশ :
২০০০ সালে ৫ নারী পুলিশের একটি টিম প্রথমবারের মতো শান্তি মিশনে পূর্ব তিমুরে অংশ নেয়। পরবর্তী সময়ে নানা কারণে আর নারী পুলিশের কোনও টিম মিশনে অংশ নেয়নি। এরপর অপেক্ষা করতে হয় আরও দশ বছর। সব বাধা অতিক্রম করে ২০১০ সালে বাংলাদেশ নারী পুলিশের প্রথম কনটিনজেন্ট পাঠানো হয় শান্তিরক্ষা হাইতি মিশনে। এ কনটিনজেন্টে ছিল নারী পুলিশের ১৬৮ সদস্য। আর এর মধ্যদিয়েই ব্যাপক আকারে শান্তি মিশনে বাংলাদেশ নারী পুলিশের যাত্রা শুরু। ইতিপূর্বে বাংলাদেশ পুলিশের পুরুষ সদস্যদের পাশাপাশি নারী সদস্যরাও কর্মদক্ষতার মধ্যদিয়ে শান্তি মিশনে কুড়িয়েছে প্রশংসা। সংখ্যার দিক দিয়ে পৌঁছে গেছে শীর্ষ অবস্থানে। ২০১৫ সালের ৯ এপ্রিল শান্তিরক্ষা কঙ্গো মিশনে যোগ দিতে ঢাকা ত্যাগ করেন বাংলাদেশ নারী পুলিশের দ্বিতীয় কনটিনজেন্টের ১২৫ সদস্য। এ ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে খুবই সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন ।

বর্তমানে মোট ৭টি মিশন এরিয়াতে (সুদান ও সাউথ সুদান, মালি, আইভোরি কোস্ট, দারফুর, হাইতি, কঙ্গো এবং লাইবেরিয়া) বাংলাদেশ পুলিশ পেশাদারিত্বের সাথে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া এ মুহূর্তে হাইতি এবং ডিআর কঙ্গোতে দু’টি বাংলাদেশ ফিমেল ফরম পুলিশ ইউনিট সাফল্যের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে নিয়োজিত বাংলাদেশি মহিলা শান্তিরক্ষীর সংখ্যা ২৮৪ জন। এদের মধ্যে সেনাবাহিনীর ১১৯ জন, নৌবাহিনীর পাঁচ জন, বিমানবাহিনীর ১০ জন ও পুলিশের ১৫০ জন রয়েছেন।

জীবন উৎসর্গকারী তারা:
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ বর্তমানে সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। এ পর্যন্ত শান্তিরক্ষা মিশনে কর্তব্যরত অবস্থায় বাংলাদেশের ১৫৯ বা ততোধিক জন শান্তিরক্ষী মৃত্যুবরণ করেছেন। তার পরও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা-মিশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ বর্তমানে সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী পাঠানো দেশ। জাতিসংঘের ৯টি শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের প্রায় ৭ হাজার শান্তিরক্ষী কর্মরত। এ পর্যন্ত শান্তিরক্ষা মিশনে কর্তব্যরত অবস্থায় বাংলাদেশের ১৫৯ বা ততোধিক জন শান্তিরক্ষী মৃত্যুবরণ করেছেন।

২০২১ সালে বিশ্ব শান্তি রক্ষায় জীবন উৎসর্গকারী আট বাংলাদেশিকে জাতিসংঘ তাদের সর্বোচ্চ পদক দ্যাগ হ্যামারশোল্ড মেডেলে ভূষিত করেছে।
জাতিসংঘের সদর দপ্তররের বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, সর্বোচ্চ ত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ এ বছর বিশ্বের ৪৪টি দেশের ১২৯ জন শান্তিরক্ষীকে পুরস্কারটিতে ভূষিত করা হয়েছে।

জাতিসংঘ সদর দপ্তরে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এই মেডেল দেয়া হয়। ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস পুরস্কার পাওয়া ৪৪ দেশের স্থায়ী প্রতিনিধিদের হাতে মেডেল তুলে দেন।

কর্তব্যরত অবস্থায় আত্মোৎসর্গকারী বাংলাদেশের আট শান্তিরক্ষী হলেন মালিতে মিনুস্মা মিশনের ওয়ারেন্ট অফিসার আব্দুল মো. হালিম, কঙ্গোতে মনুস্কো মিশনের ওয়ারেন্ট অফিসার মো. সাইফুল ইমাম ভূঁইয়া, সার্জেন্ট মো. জিয়াউর রহমান, সার্জেন্ট এমডি মোবারক হোসেন ও ল্যান্স করপোরাল মো. সাইফুল ইসলাম, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে মিনুস্কা মিশনের ল্যান্স করপোরাল মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন ও সার্জেন্ট মো. ইব্রাহীম এবং দক্ষিণ সুদানে আনমিস মিশনের ওয়াসারম্যান নুরুল আমিন। ২১ সালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই মেডেল গ্রহণ করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা।

এরপরের বছর ২০২২সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত শান্তিরক্ষা মিশনে কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী ৫ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীকে মর্যাদাপূর্ণ মরনোত্তর 'দ্যাগ হ্যামারশোল্ড মেডেল' প্রদান করেছে জাতিসংঘ।

২০২৩ সালে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে এ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেজের কাছ থেকে বাংলাদেশের পক্ষে এ মেডেল গ্রহণ করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আবদুল মুহিত।

বাংলাদেশের ৫ জন জীবন উৎসর্গকারী শান্তিরক্ষীদের মধ্যে রয়েছেন, সার্জেন্ট মোহাম্মদ মনজুর রহমান আবেই-তে ইউনিসফা মিশনে; ল্যান্স করপোরাল কফিল মজুমদার দক্ষিণ সুদানের আনমিস মিশনে; সৈনিক মোহাম্মদ শরিফ হোসেন, সৈনিক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ও সৈনিক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের মিনুসকা মিশনে কর্তব্যরত ছিলেন। তবে একটি বার্তা সংস্থাকে দেওয়া সেনা সদর দপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুসারে,২০২২ সালের  ২৩মে  পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীর ১৩৯ সদস্য এবং ২২ পুলিশ সদস্যসহ ১৬১ জন কর্মকর্তা শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন।

news24bd.tv/ডিডি/কেআই