ডোপ টেস্ট নমুনায় প্রস্রাবের বদলে পানি, হাসপাতালে গিয়ে জানলেন বিচারক

সংগৃহীত ছবি

ডোপ টেস্ট নমুনায় প্রস্রাবের বদলে পানি, হাসপাতালে গিয়ে জানলেন বিচারক

অনলাইন ডেস্ক

মাদক মামলার রায়ের আগে ডোপ টেস্ট করাতে আসামিদের নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন চিকিৎসক। তবে হাসপাতালে গিয়ে তিনি জানলেন, টেস্টে প্রস্রাবের বদলে পানি ধরিয়ে দিয়েছে অভিযুক্তরা। ঘটনাটি ঘটেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে।

গত সোমবার (২৫ মার্চ) মাদক মামলায় ১৫ জনের রায় দেয়ার কথা ছিল।

তবে রায় দেয়ার আগে আদালতের বিচারক মো. হুমায়ুন কবীর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের স্বার্থে ডোপ টেস্টের নির্দেশ দেন।

জানা গেছে, ডোপ টেস্টের সেই রিপোর্ট পর্যালোচনায় সন্দেহ সৃষ্টি হলে একইদিন আসামিদের নিয়ে ২৫০ শয্যার চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালে ছুটে যান বিচারক। সেখানে গিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর আসামিদের ডোপ টেস্টের জন্য দেয়া ইউরিনের বদলে পানি পূর্ণ করে ল্যাবে জমা দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হন তিনি। পরে আদালতে ফিরে আসামিদের ৬ মাস থেকে ৩ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন।

এরপর শুক্রবার (২৯ মার্চ) বিষয়টি নিজেই সামাজিক মাধ্যমে তুলে ধরেন বিচারক হুমায়ুন কবীর। এক ফেসবুক পোস্টে তিনি জেলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনিয়ম আর ন্যায়বিচারের পথে শত বাধার কঠিন বাস্তবতার অবতারণা করেছেন। এদিকে এ ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

পোস্টে বিচারক লেখেন, ২৫ মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৫টি মাদক মামলার রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য ছিল। মামলাগুলো ২০১৭-২০১৮-২০১৯ সালের। দীর্ঘদিন আসামিরা আদালত চত্বরে ঘোরাঘুরি করেছেন, নিয়মিত হাজিরাও দিয়েছেন। অন্যদিকে মাদকের পরিমাণও বেশি না। সবকিছু বিবেচনা করে মনে করলাম, আসামিদের প্রবেশন দেয়া যায় কি না। আবার ভাবলাম দেখি আসামিদের ডোপ টেস্টের রেজাল্ট কি আসে, তারপরে সিদ্ধান্ত নেব। এটা বিবেচনা করে ডোপ টেস্টের জন্য ২৫০ শয্যার চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালে পাঠালাম।  

তিনি লেখেন, আসামিরা ডোপ টেস্টের রেজাল্ট নিয়ে হাজির হলো। দেখলাম মাত্র একজন আসামির রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে, বাকি সবগুলোর নেগেটিভ। চিন্তায় পড়ে গেলাম রেজাল্ট কি ঠিক আসল নাকি সত্যি সত্যিই আসামিরা মাদক ছেড়ে দিয়েছে। আমার জানা মতে, ছয় মাস আগেও যদি কেউ মাদক গ্রহণ করে তবুও ডোপ টেস্টে তার রেজাল্ট পজিটিভ আসবে।

এমনিতেও আসামিরা আদালতে দাঁড়িয়ে বলেন তারা মাদকের সঙ্গে জড়িত না। মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের ফাঁসানো হয়েছে। তখন মনে হচ্ছিল, এতগুলো নিরপরাধ মানুষকে কীভাবে ফাঁসানো হলো। আরও অনেক চিন্তা মাথায় ঘুরছিল। এরপর ডোপ টেস্টের সব রিপোর্ট ভালোভাবে পর্যালোচনা করে দেখলাম। দেখতে পেলাম সব কয়টা ইউরিন অর্থাৎ প্রস্রাব গ্রহণের মাধ্যমে টেস্ট করা হয়েছে।

বিচারক লেখেন, এরপর আমার কাছে একটু সন্দেহ হলো। আমি বললাম ব্লাড টেস্টের মাধ্যমে রিপোর্ট নিয়ে আসেন। কিছুক্ষণ পর একজন আইনজীবী এসে বললেন, ‘স্যার প্রত্যেক টেস্টের জন্য ১১০০ টাকা খরচ হচ্ছে। এরা গরিব মানুষ। এত টাকা কোথায় পাবে। ’ আবার আসামিদের ডাকলাম। আমার ধারণা ছিল সরকারি হাসপাতাল ১০ টাকার টিকিট কেটে টেস্ট করা সম্ভব। আসামিরা পুনরায় এসে একটি ভয়ংকর তথ্য দিলেন।

তারা বললেন, স্যার ৯০০ টাকা রিপোর্টের জন্য আরও ২০০ টাকা বকশিশ (ঘুষ) নিয়েছে। এজলাস থেকে নেমে আসামিদের নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মহোদয়ের রুমে গেলাম এবং উনাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। আমার কথা উনি মনোযোগ সহকারে শুনে ডোপ টেস্টের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের ডাকলেন।

তত্ত্বাবধায়ক মহোদয় আমার অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেই সংশ্লিষ্টরা অকপটে স্বীকার করে বলেন, ‘স্যার ৯০০ টাকা টেস্টের খরচ। আর ২০০ টাকা আমাদের খুশি হয়ে দিয়েছে। শুনে খুব রাগ হচ্ছিল। এরপরেও রাগ চেপে রেখে মৃদু হেসে নিজেকে সংযত করলাম। পরবর্তী ঘটনা ছিল আরও ভয়ংকর। আমি তত্ত্বাবধায়ক মহোদয়কে বললাম ইউরিন বা প্রস্রাব টেস্টের মাধ্যমে সঠিক ডোপ টেস্টের রেজাল্ট পাওয়া যায় কি? উনি আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললেন, ‘অবশ্যই! ৯৮% সঠিক আসবে। ’

কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, কোথায় যেন একটা ঘাপলা আছে। আরও গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল। অবশ্য তাতে আমার আপত্তি নেই। সঠিক তথ্য বের করতেই হবে। এবার পেলাম সেই ভয়ংকর তথ্য। ইউরিন বা প্রস্রাব দেয়ার বিপরীতে আসামিরা বাথরুমে ঢুকে পটে করে পানি নিয়ে ল্যাবে জমা দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে রেজাল্ট যা আসার তাই এসেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মাসুদ পারভেজ বলেন, বেশ কয়েকজন রোগী আদালত থেকে এসে জরুরি ডোপ টেস্টের জন্য তাড়াহুড়ো করেন। তারা টেকনিশিয়ানদের হাতে কিছু টাকাও দেন। যেন তাদের রিপোর্ট জরুরি হয়। এখানে সরকারি ফি ৯০০ টাকা ছাড়াও বকশিশ নেয়া হয়। যার প্রমাণ মিলেছে। এমন অপরাধের জন্য একজন টেকনিশিয়ানকে শোকজ করা হয়েছে, একজনকে সতর্ক ও অপরজনকে জেলা হাসপাতাল থেকে বদলি করা হবে।  

তিনি আরও বলেন, ডোপ টেস্টে অর্থ আদায়ের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আরও কি ব্যবস্থা নেয়া যায়-সে বিষয়ে পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে।

news24bd.tv/FA