রমজানে মুসলিম মনীষীদের কোরআন তিলাওয়াত যেমন ছিল

রমজানে মুসলিম মনীষীদের কোরআন তিলাওয়াত যেমন ছিল

 আসআদ শাহীন

কোরআন তিলাওয়াত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। পাশাপাশি আত্মিক প্রশান্তি ও রুহের খোরাক। রমজানে কোরআন তিলাওয়াতের গুরুত্ব ও ফজিলত বেশি। কেননা পবিত্র মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘রমজান মাস—যে মাসে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে...। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৫)
প্রতি রমজানে রাসুলুল্লাহ (সা.) জিবরাইল (আ.)-এর সঙ্গে কোরআন ‘দাওর’ (একে অন্যকে শোনানো) করতেন। (বুখারি, হাদিস : ১৯০২)

কোরআন-হাদিসের নির্দেশনা মেনে মুসলিম মনীষীরা বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে রমজান অতিবাহিত করতেন। রমজানে মুসলিম মনীষীদের কোরআন তিলাওয়াত সম্পর্কিত আমল ও ঘটনা নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

সাঈদ বিন জুবায়ের (রহ.)-এর আমল

সাঈদ বিন জুবায়ের (রহ.) একজন বড় মুহাদ্দিস হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন নির্ভীক ও সাহসী মুজাহিদ ছিলেন।

অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি জানবাজ লড়াকু সৈনিক ছিলেন। অন্যান্য ধর্মীয় খিদমত করা সত্ত্বেও তিনি রমজানে প্রতিদিন মাগরিব ও এশার নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে একবার পবিত্র কোরআন খতম করতেন। সে জন্য লোকেরা অন্য সময়ের চেয়ে বিলম্ব করে এশার নামাজ আদায় করত। (তাহজিবুল কামাল, খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ৩৬৩)

কাতাদাহ ইবনে দিয়ামা (রহ.)-এর আমল

কাতাদাহ ইবনে দিয়ামা (রহ.) হাদিসচর্চায় উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। বড় বড় মুহাদ্দিস তাঁর কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করতেন। যদিও তিনি বাহ্যিক দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত (অন্ধ) ছিলেন, কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁকে সর্বোত্তম স্মৃতিশক্তি দিয়েছিলেন। কোরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে তাঁর আমল ছিল, তিনি প্রতি সপ্তাহে একবার কোরআন খতম করতেন। কিন্তু রমজান মাসে তিনি আরো বেশি তিলাওয়াত করতেন এবং প্রতি তিন দিনে কোরআন খতম করতেন আর শেষ ১০ দিনে তিনি প্রতিদিন কোরআন খতম করতেন। আল্লামা জাহাবি (রহ.) বলেন : কাতাদাহ (রহ.) প্রতি সপ্তাহে কোরআন খতম করতেন আর রমজান এলে প্রতি তিন দিনে খতম করতেন এবং শেষ দশক এলে প্রতি রাতে কোরআন খতম করতেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৭৬)

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর আমল

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ইলমি মর্যাদা সম্পর্কে প্রায় কমবেশি সবাই অবগত। ইসলামী ফিকাহ সংকলনের ব্যস্ততা এবং শিক্ষা ও শিক্ষাদানে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি রমজানে বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করতেন। রমজানের প্রত্যেক দিন ও রাতে তিনি একবার একবার করে কোরআন খতম করতেন আর এই একই আমল ঈদুল ফিতরের দিন ও রাতেও অব্যাহত থাকত। এভাবে তিনি সর্বমোট ৬২ বার কোরআন খতম করতেন। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) বলেন, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) প্রত্যেক দিন ও রাতে কোরআন খতম করতেন এবং যখন রমজান মাস আসত, তখন তিনি ঈদুল ফিতরের দিন ও রাতসহ সর্বমোট ৬২ বার কোরআন খতম করতেন। (আখবারু আবি হানিফা ওয়া আসহাবিহি, পৃষ্ঠা ৫৫)

ইমাম শাফেয়ি (রহ.)-এর আমল

ইমাম শাফেয়ি (রহ.) ছিলেন একজন উচ্চ মর্যাদার ফকিহ ও মুহাদ্দিস। তিনি সর্বদা ইলম প্রচার-প্রসারে নিয়োজিত থাকতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি অধিক কোরআন তিলাওয়াত করতেন। তবে রমজান মাস এলেই তা দ্বিগুণ হারে বেড়ে যেত যে দিনে এক খতম ও রাতে এক খতম করতেন। এভাবে তিনি রমজান মাসে ৬০ বার কোরআন খতম করতেন। রাবি বিন সুলাইমান (রহ.) বলেন, ইমাম শাফেয়ি (রহ.) প্রতি রাতে এক খতম করতেন এবং যখন রমজান আসত, তখন রাতে এক খতম এবং দিনে আরেক খতম করতেন। ফলে তিনি রমজান মাসে মোট ৬০ বার কোরআন খতম করতেন। (তারিখে দামেস্ক লি ইবনে আসাকির, খণ্ড ৫১, পৃষ্ঠা ৩৯২)

ইমাম বুখারি (রহ.)-এর আমল

ইমাম বুখারি (রহ.)-এর মতো মহা মনীষীর কোনো পরিচয়ের প্রয়োজন নেই। পৃথিবীতে এমন একটি লোকও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে তাঁর নাম শোনেনি। হাদিস প্রচার ও প্রসারে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি রমজানে বহুবার কোরআন খতম করতেন। সাহরির সময়ে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কোরআন তিলাওয়াত করা এবং প্রতি তিন দিনে একবার সাহরির সময়ে কোরআন খতম করা ছিল তাঁর অভ্যাস। একইভাবে তিনি প্রতিদিন দিনের বেলায় ইফতারের সময় কোরআন খতম করতেন। কেননা একদিকে ইফতারের সময় হলো দোয়া কবুল হওয়ার সময় আর দ্বিতীয়ত কোরআন খতম উপলক্ষেও দোয়া কবুল হয়। খতিবে বাগদাদি (রহ.) বলেন, ইমাম বুখারি (রহ.) সাহরিতে কোরআনের অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশ তিলাওয়াত করতেন এবং প্রতি তিন রাতে সাহরিতে কোরআন খতম করতেন এবং প্রতিদিন দিনের বেলায়ও কোরআন খতম করতেন। আর এই খতম ছিল ইফতারের সময় এবং তিনি বলতেন যে প্রত্যেক খতম শেষে দোয়া কবুল হয়। (তারিখে বাগদাদ, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৩১)

মুহাম্মদ বিন মুহাম্মাদ তুনসি (রহ.)-এর আমল

মুহাম্মদ বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান তুনসি (রহ.) তাঁর সময়ের একজন বিখ্যাত বুজুর্গ এবং ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। প্রথম দিকে তিনি একজন বণিক এবং প্রচুর সম্পদের অধিকারী ছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁর সমস্ত সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করেন আর সারাক্ষণ ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। কোরআনের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা ছিল; তাই তিনি রমজানে ১০০ বার কোরআন খতম করতেন। আল্লামা ইবনুল খতিব (রহ.) বলেন, তিনি রমজান মাসে ১০০ বার কোরআন খতম করতেন। (আল ইহাতাতু ফি আখবারি গারনাতাহ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২০৫)

মাহমুদ বিন আবি বকর জাজারি (রহ.)-এর আমল

মাহমুদ বিন আবি বকর জাজারি (রহ.) ইমাম শাফেয়ি (রহ.)-এর মতাদর্শের ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বিভিন্ন উলুম ও ফুনুনে পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও পরে সুফিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ইবাদত ইত্যাদিতে অনেক সময় ব্যয় করতেন। তিনি কোরআন তিলাওয়াত করতে খুব পছন্দ করতেন এবং রমজান মাসে আরো বেশি উৎসাহের সঙ্গে তিলাওয়াত করতেন। সে জন্য তিনি রমজান মাসে প্রতিদিন দুইবার কোরআন খতম করতেন। ইতিহাসবিদরা বলেন, তাঁর বহু গুণ রয়েছে; তন্মধ্যে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, তিনি এক দিন রোজা রাখতেন এবং এক দিন রোজা ভঙ্গ করতেন। আর রমজান মাসে তিনি একটি নির্জন স্থানে একাকিত্ব অবলম্বন করতেন, যেখানে তিনি দিনে একবার এবং রাতে একবার কোরআন খতম করতেন। (সিলকুদ দুরার, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ১২৭)

মুহাম্মদ জাহিদ বিন উমর (রহ.)-এর আমল

শায়খ মুহাম্মাদ জাহিদ বিন উমর (রহ.) ছিলেন হারামাইন শরিফের অন্যতম আলেম। মসজিদে নববীতে শিক্ষকতার সৌভাগ্যও হয়েছে তাঁর। ইলমি ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি রমজানে বেশি পরিমাণে তিলাওয়াত করতেন এবং প্রতি রাতে নামাজে কোরআন খতম করতেন। তাঁর কোরআন শরিফের দৃঢ় হিফজ সম্পর্কে জানার জন্য এটাই যথেষ্ট যে তৎকালীন একদল আলেম তাঁর বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছিলেন—এক রাতে কোরআন খতম করার কারণে শব্দের সঠিক উচ্চারণ হয় না। সে জন্য তাঁরা তাঁদের একজন লোককে শায়খ মুহাম্মাদ জাহিদ (রহ.)-এর পেছনে দাঁড় করিয়ে দেন, যাতে শায়খের তাজবিদ, তারতিল, শব্দ বা অন্য কোনো উপায়ে ভুল পেলে সে যেন তাঁদের অবগত করে। আর তাঁরা প্রতিটি ভুল চিহ্নিত করার জন্য তাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা হাদিয়া দেওয়ার ঘোষণা দেন। সে জন্য ওই ব্যক্তি শায়খ মুহাম্মদ জাহিদ (রহ.)-এর পেছনে দাঁড়িয়েছিল। শায়খ রাতে পুরো কোরআন খতম করেছিলেন, কিন্তু সেই ব্যক্তি তার একটি ভুলও খুঁজে পায়নি। (আলাম মিন আরদ আন-নবুওয়্যাহ, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১০৪)

এমনই ছিল মুসলিম মনীষীদের কোরআনময় রমজান। তাই আমাদে উচিত বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করা এবং কোরআনময় জীবন গড়া। মহান আল্লাহ তাওফিক দান করুন।

লেখক : অনুবাদক, গবেষক