জাকাতের হিসাব করবেন যেভাবে

জাকাতের হিসাব করবেন যেভাবে

 মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

১. যে সম্পদে জাকাত আসে সে সম্পদের ৪০ ভাগের ১ ভাগ জাকাত আদায় করা ফরজ। মূল্যের আকারে নগদ টাকা দ্বারা বা তা দ্বারা কোনো আসবাব ক্রয় করে তা দ্বারাও জাকাত দেওয়া যায়।

২. জাকাতের ক্ষেত্রে চান্দ্র মাসের হিসাবে বছর ধরা হবে। যখনই কেউ নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তখন থেকেই জাকাতের বছর শুরু ধরতে হবে।

৩. সোনা-রুপার মধ্যে যদি ব্রোঞ্জ, রাং, দস্তা, তামা ইত্যাদি কোনো কিছুর মিশ্রণ থাকে আর সে মিশ্রণ সোনা-রুপার চেয়ে কম হয়, তাহলে পুরোটাকেই সোনা-রুপা ধরে জাকাতের হিসাব করা হবে—মিশ্রিত দ্রব্য ধর্তব্য হবে না। আর যদি মিশ্রিত দ্রব্য সোনা-রুপার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে সেটাকে আর সোনা-রুপা ধরা হবে না; বরং ওই মিশ্রিত দ্রব্যই ধরা হবে।

৪. জাকাত হিসাব করার সময় অর্থাৎ ওয়াজিব হওয়ার সময় সোনা, রুপা, ব্যাবসায়িক পণ্য ইত্যাদির মূল্য ধরতে হবে তখনকার ওয়াজিব হওয়ার সময়কার বাজারদর হিসাবে এবং সোনা, রুপা ইত্যাদি যে স্থানে আছে সে স্থানের দাম ধরতে হবে।

৫. শেয়ারের মূল্য ধরার ক্ষেত্রে মাসআলা হলো, যারা কম্পানির লভ্যাংশ অর্জন করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং শেয়ার ক্রয় করেছেন শেয়ার বেচাকেনা করে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে, তারা শেয়ারের বাজারদর ধরে জাকাত হিসাব করবেন।

আর শেয়ার ক্রয় করার সময় যদি মূল উদ্দেশ্য থাকে কম্পানি থেকে লভ্যাংশ অর্জন করা এবং সঙ্গে সঙ্গে এ উদ্দেশ্যও থাকে যে শেয়ারের দর বাড়লে বিক্রি করে দেব, তাহলে জাকাত হিসাব করার সময় শেয়ারের বাজারদরের যে অংশ জাকাতযোগ্য সম্পদের বিপরীতে আছে তার ওপর জাকাত আসবে, অবশিষ্ট অংশের ওপর জাকাত আসবে না।
উদাহরণস্বরূপ—শেয়ারের মার্কেট ভ্যালু (বাজারদর) ১০০ টাকা, তার মধ্যে ৬০ ভাগ কম্পানির বিল্ডিং, মেশিনারিজ ইত্যাদির বিপরীতে, আর ৪০ ভাগ কম্পানির নগদ অর্থ, কাঁচামাল ও তৈরি মালের বিপরীতে, তাহলে জাকাতের হিসাব করার সময় শেয়ারের বাজারদর অর্থাৎ ১০০ টাকার ৬০ ভাগ বাদ যাবে। কেননা সেটা এমন অর্থ/সম্পদের বিপরীতে যার ওপর জাকাত আসে না। অবশিষ্ট ৪০ ভাগের ওপর জাকাত আসবে।

৬. জাকাতদাতার যে পরিমাণ ঋণ আছে সে পরিমাণ অর্থ বাদ দিয়ে বাকিটার জাকাত হিসাব করবে। ঋণ পরিমাণ অর্থ বাদ দিয়ে যদি জাকাতের নিসাব পূর্ণ না হয় তাহলে জাকাত ফরজ হবে না। তবে মুফতি তাকি উসমানি বলেছেন, যে লোন নিয়ে বাড়ি করা হয় বা যে লোন নিয়ে মিল-ফ্যাক্টরি তৈরি করা হয় বা মিল-ফ্যাক্টরির মেশনারিজ ক্রয় করা হয়, এমনিভাবে যেসব লোন নিয়ে এমন কাজে নিয়োগ করা হয়, যার মূল্যের ওপর জাকাত আসে না; যেমন—বাড়ি ও ফ্যাক্টরি বা ফ্যাক্টরির মেশিনারিজের মূল্যের ওপর জাকাত আসে না। এসব লোন জাকাতের জন্য বাধা নয়, অর্থাৎ এসব লোনের পরিমাণ অর্থ জাকাত থেকে বাদ দেওয়া যাবে না। হ্যাঁ, যে লোন নিয়ে এমন কাজে নিয়োগ করা হয়, যার ওপর জাকাত আসে; যেমন—লোন নিয়ে ফ্যাক্টরির কাঁচামাল ক্রয়, এরূপ ক্ষেত্রে এ লোন পরিমাণ অর্থ জাকাতের হিসাব থেকে বাদ যাবে।

৭. কারো কাছে জাকাতদাতার টাকা পাওনা থাকলে সে পাওনা টাকার জাকাত দিতে হবে। পাওনা তিন প্রকার—

ক. কাউকে নগদ টাকা ঋণ দিয়েছে কিংবা ব্যবসায়ের পণ্য বিক্রি করেছে এবং তার মূল্য বাকি আছে। এরূপ পাওনা কয়েক বছর পর উশুল হলে যদি পাওনা টাকা এত পরিমাণ হয় যাতে জাকাত ফরজ হয়, তাহলে অতীত বছরগুলোর জাকাত দিতে হবে। যদি একত্রে উশুল না হয়—ভেঙে ভেঙে উশুল হয়, তাহলে ১১ তোলা রুপার মূল্য পরিমাণ হলে জাকাত দিতে হবে। এর চেয়ে কম পরিমাণ উশুল হলে তার জাকাত ওয়াজিব হবে না। তবে অল্প অল্প করে সেই পরিমাণে পৌঁছে গেলে তখন ওয়াজিব হবে। আর যখনই ওয়াজিব হবে তখন অতীত সব বছরের জাকাত দিতে হবে। আর যদি এরূপ পাওনা টাকা নিসাবের চেয়ে কম হয়, তাহলে তাতে জাকাত ওয়াজিব হবে না।

খ.  নগদ টাকা ঋণ দেওয়ার কারণে বা ব্যবসায়ের পণ্য বাকিতে বিক্রি করার কারণে পাওনা নয়, বরং ঘরের প্রয়োজনীয় আসবাব, কাপড়চোপড়, চাষাবাদের গরু ইত্যাদি বিক্রয় করেছে এবং তার মূল্য পাওনা রয়েছে, এরূপ পাওনা যদি নিসাব পরিমাণ হয় এবং কয়েক বছর পর উশুল হয় তাহলে ওই কয়েক বছরের জাকাত দিতে হবে। আর যদি ভেঙে ভেঙে উশুল হয় তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত সাড়ে ৫২ তোলা রুপার মূল্য পরিমাণ না হবে, ততক্ষণ জাকাত ওয়াজিব হবে না। যখন উক্ত পরিমাণ উশুল হবে তখন বিগত বছরগুলোর জাকাত দিতে হবে।

গ. মহরের টাকা, পুরস্কারের টাকা, খোলা তালাকের টাকা, বেতনের টাকা ইত্যাদি পাওনা থাকলে এরূপ পাওনা উশুল হওয়ার আগে জাকাত ওয়াজিব হয় না। উশুল হওয়ার পর এক বছর মজুদ থাকলে তখন থেকে তার জাকাতের হিসাব শুরু হবে। পাওনা টাকার জাকাত সম্পর্কে উপরোল্লিখিত বিবরণ শুধু তখন প্রযোজ্য হবে, যখন এই টাকা ছাড়া তার কাছে জাকাতযোগ্য অন্য কোনো অর্থ বা সম্পদ না থাকে। আর অন্য কোনো অর্থ বা সম্পদ থাকলে তার মাসআলা ওলামায়ে কেরাম থেকে জেনে নেবেন।

৮.  যে ঋণ ফেরত পাওয়ার আশা নেই, এরূপ ঋণের ওপর জাকাত ফরজ হয় না। তবে পেলে বিগত সব বছরের জাকাত দিতে হবে।

৯. যৌথ কারবারে অর্থ নিয়োজিত থাকলে যৌথভাবে পূর্ণ অর্থের জাকাত হিসাব করা হবে না, বরং প্রত্যেকের অংশের আলাদা আলাদা হিসাব হবে।

১০. যেসব সোনা-রুপার অলংকার স্ত্রীর মালিকানায় দিয়ে দেওয়া হয় সেটাকে স্বামীর সম্পত্তি ধরে হিসাব করা হবে না; বরং সেটা স্ত্রীর সম্পত্তি। আর যেসব অলংকার স্ত্রীকে শুধু ব্যবহার করতে দেওয়া হয়, মালিক থাকে স্বামী, সেটা স্বামীর সম্পত্তির মধ্যে ধরে হিসাব করা হবে। আর যেগুলোর মালিকানা অস্পষ্ট আছে তা স্পষ্ট করে নেওয়া উচিত। যেসব অলংকার স্ত্রীর নিজস্ব সম্পদ থেকে তৈরি বা যেগুলো বাপের বাড়ি থেকে অর্জন করে, সেগুলো স্ত্রীর সম্পদ বলে গণ্য হবে। মেয়েকে যে অলংকার দেওয়া হয় সেটার ক্ষেত্রেও মেয়েকে মালিক বানিয়ে দেওয়া হলে সেটার মালিক সে। আর শুধু ব্যবহারের উদ্দেশ্যে দেওয়া হলে মেয়ে তার মালিক নয়। নাবালেগা মেয়েদের বিয়েশাদি উপলক্ষে তাদের নামে যে অলংকার বানিয়ে রাখা হয় বা নাবালেগ ছেলে কিংবা মেয়ের বিয়েশাদিতে ব্যয়ের লক্ষ্যে তাদের নামে ব্যাংকে বা ব্যবসায় যে টাকা লাগানো হয় সেটার মালিক তারা। অতএব, সেগুলো পিতা-মাতার সম্পত্তি বলে গণ্য হবে না এবং পিতা-মাতার জাকাতের হিসাবে সেগুলো ধরা হবে না। আর বালেগ সন্তানের নামে শুধু অলংকার তৈরি করে রাখলে বা টাকা লাগালেই তারা মালিক হয়ে যায় না, যতক্ষণ না সেটা সে সন্তানের দখলে হয়। তাদের দখলে দেওয়া হলে তারা মালিক, অন্যথায় সেটার মালিক পিতা-মাতা।

১১. হিসাবের চেয়ে কিছু বেশি জাকাত দিয়ে দেওয়া উত্তম, যাতে কম হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে। প্রকৃতপক্ষে সেটুকু জাকাত না হলেও তাতে দানের সওয়াব তো হবেই।

 

এই রকম আরও টপিক