'কে যেন গো ডেকেছে আমায়'

কামরুল ইসলাম

কিস্তি-১৭

'কে যেন গো ডেকেছে আমায়'

অনলাইন ডেস্ক

সেদিন কলাভবনের সামনে সবুজ চত্বরে সতীর্থরা মিলে একসঙ্গে বসে ইফতার করছিলাম। আমাদের চারপাশে আরও অনেক সতীর্থ-বৃত্ত বসেছিলো সবুজ ঘাসের উপর। কথা-বার্তা, ক্যাম্পাসের স্মৃতিচারণ, হাসাহাসি, রসিকতার সঙ্গে ছোলা-পেঁয়াজুরা দাঁত বের করে করে হাসছিলো। নাকি কাঁদছিলো ঠিক জানি না।

সবার কান কেবল আজানের দিকে। আকাঙ্ক্ষিত অপেক্ষার জাদুতে সকলেই উচাটন। আজান হলো। পানিমুখে সবাই বক্সে থাকা ইফতারির ভার থেকে খেজুরকে মুক্ত করে নিয়ে মুখে চালান দিলো।
খেজুর কি মুক্ত হলো নাকি নিজেকে খোদাতায়ালার নেয়ামত হিসেবে উৎসর্গ করলো? কে জানে ! কেননা মানুষের মাথায় চিন্তা গজানোর সাথে সাথে  তার শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারটা মোটামুটি আত্মকেন্দ্রিক যুক্তির ছাঁচে সে গড়ে নিতে শেখে। ফলে খেজুরের নিজের কথাটা মানুষ কোনোদিন শুনতে পায় কিনা জানি না। তবে খেজুর খেতে না পারার হাহাকারের তলায় গাছের সঙ্গে খেজুরের বিচ্ছেদগাথা একেবারে চাপা পড়ে থাকে।

আরও পড়ুন: জ্বিনের বাদশাহ

সেদিন দেখলাম আজানের সঙ্গে সঙ্গে একটা কুকুর চিৎকার করে কাঁদছিলো। মনের ভেতরে কেমন জানি একটা চাপা বেদনাবোধ কাজ করছিলো। পৃথিবীর সমস্ত জায়গার সব কুকুরের কান্নার কণ্ঠ একইরকমের হয় কী করে? কুকুরের রঙ,সাইজ এমনকি ক্লাসও তো ভিন্ন হতে দেখি। ওইদিনের ওই কুকুরটারই বা কী হয়েছিলো? এভাবে কেঁদে কেঁদে কোন প্রিয়জনকে কাছে ডাকছিলো সে? তার সঙ্গীরা তো সঙ্গেই বসেছিলো সবাই? তবু কেন এতো হাহাকার? নাকি কুকুরটি মানুষের জন্য দুর্বোধ্য কোনো সংকেত-বার্তা বাজিয়ে দিয়েছিলো? কে জানে!

ঢাবি ক্যাম্পাস কুকুরদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এখানে লেজ-নাড়া, জিভ নামানো, ডোরাকাটা অনেক কিসিমের কুকুরের বিচরণ দেখি। রোজার আগে ভোরে ফজরের আজানের সঙ্গে আমাদের বাসার পাশেই একটি কুকুর খুব জোরে জোরে কাঁদতো। কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের এক প্রতিবেশীর বাবা ইহলোক ত্যাগ করলেন। এটা হয়তো এমনিতেই ঘটতো, কিন্তু কুকুরের কান্নার পরেই যে ঘটতে হলো সেই বিষয়টা আমার মনের মধ্যে থেকে অনায়াসেই বেরিয়ে এলো। কুকুরের কান্নার আওয়াজ বাসার পাশে আগেও শুনেছি, হলের এক কর্মচারীর মৃত্যুর খবর পেয়েছিলাম তখন।
কুকুরের কান্না নাকি নির্দিষ্ট সিজনে শোনা যায়। কই আমি তো সারা বছরই কুকুরের কান্না শুনি! আমার মতো অনেকে নিশ্চয়ই শোনেন, কিন্তু কানটা সবসময় পুঁজির লয়ে উচাটন থাকে বিধায় এসব কান্না অতো বেশি কানে পৌঁছে না আমাদের। আমরা প্রাণী হিসেবে যেই গোত্রে জন্মেছি সেই  মানুষের কান্নাই কানে পৌঁছে না, আর তো কুকুর! ঘোর শীত অথবা চৈত্রের চাঁদনী রাতেও কুকুরের কান্না শুনেছি। কুকুর নাকি একা থাকলে সঙ্গীর জন্য কাঁদে। কই আমি তো দলের মধ্যে থাকা কুকুরের কান্নাও শুনেছি।
কয়েক বছর আগে শীতের সময় রোজ ক্যাম্পাসে সন্ধ্যায় হাঁটতাম। তখন ইন্টারন্যাশনাল হলের সামনে কয়েকটি কুকুর ঢেউ খেলে খেলে কান্নার রোল তুলছিলো। সেই দলে কমপক্ষে চারটি কুকুর ছিলো। কেঁদেছিল কয়জন তা মনে নেই। আমার সঙ্গে আমাদের এফ রহমান হলের একজন হাউস টিউটরের স্ত্রীও হাঁটতেন। আমরা ওই সময়ে হাঁটতে দেখতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক রাজীব স্যারকে। শুকনা লম্বা একজন মানুষ কানে হেডফোন লাগিয়ে বাতাসের আগে আগে উড়ে উড়ে হাঁটতেন। এক সন্ধ্যায় কুকুরের কান্না শুনেই মনটা কেমন জানি ছ্যাঁত করে উঠলো। যেটা আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি কখনো। ওইদিন সঙ্গের ওই ভাবিকে বললামও সেটা। এর পরদিন শুনি রাজীব স্যার হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন। সবই কাকতাল হয়তো। কিন্তু মানুষের মন তো খালি সূত্র মিলিয়ে মিলিয়েই জীবন পার করতে চায়। জীবনের কোথাও যখন কোনো টপোলজিক্যাল মোড় অতিক্রম করতে হবে তখনই দেখা যায় কেউ কেউ ফ্রাক্টাল জিওমেট্রি হাজির করে মিলিয়ে নিচ্ছে দুইয়েক ছত্র জীবনের বিন্যাস। সে মিলুক আর না মিলুক, মেলানোর জোর মানুষের খুলিতে আছে।
আব্বু মারা যাবার আগে বাড়িতে রোজ নিমপেঁচা ডাকতো। অনেকদিন ধরেই ডাকছিলো। আম্মুর সঙ্গে কথা হলে এই তথ্যটা নিতাম, অবশ্য এখনও নিই। কারণ নিমপেঁচার ডাক আমার ভালো লাগতো না। আব্বুকে ফোনে বলতাম সাবধানে চলতে। আরও অনেক আগে আব্বু একবার আমার এসব ভীতির কথা শুনে রাগ করে বলেছিলেন আমার বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমস্ত শিক্ষা-সনদ পুড়িয়ে ফেলতে। আমার শিক্ষাগত যোগ্যতাকে আব্বু খুবই বিরক্তির সাথে খারিজ করে দিতেন। আব্বুর ঝাড়ি, আম্মুর হেঁয়ালি উপেক্ষা করেই আমার খারাপ লাগা কাজ করতো সবসময়। আব্বু আম্মু আমাকে এইসব গায়েবি ব্যাপার স্যাপার নিয়ে কখনো কোনো সংস্কারাচ্ছন্ন শিক্ষা দেননি। তবু কেন আমার মধ্যে এসব অনুভুতি ইনহেরিট করলো? বিষয়টি নিয়ে এখনও যখন আমার বরকে ত্যাক্ত করি, তখন তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে করতে আমার মধ্যের এই বিষয়টার কারণ কী হতে পারে, তা নিয়ে ভাবি। ছোটবেলায় আব্বুর এক মামী আসতেন আমাদের বাড়িতে। ভদ্রমহিলার কাছে আমি শুধু গায়েবি গল্প শুনতে চাইতাম। এই দাদির গল্প বলার ধরন এতো রিয়েলিস্টিক ছিলো যে আমার অচেতন জগতে একেবারে গেঁথে গেছে। আমি একে কিছুতেই টেনে বের করতে এখনও পারিনি।

আরও পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয় ও একজন মোহাম্মদ আজম

ওইসময় আব্বুর যুক্তি ছিলো পরিষ্কার। আমাদের বাড়িটা গাছে গাছে ঢেকে থাকায় বিচিত্র পাখির বাসা আমাদের বাড়িতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। ফলে বিচিত্র পাখির ডাকও স্বাভাবিক। কিন্তু আব্বু কেন বুঝতে চাইতেন না যে এই নিমপেঁচা সবসময় ডাকে না? কেন ডাকে না? দোয়েল যেমন ফজর হলেই ডাকে, কাকেরা আলো ফুটলে ডাকে। নিমপেঁচা কেন প্রতি সন্ধ্যায় বা প্রতি গভীর রাতে ডাকে না? কুকুর কেন কেবল ভাদ্রমাসে সঙ্গীর তাড়নায় ডাকে না? কাকেরা কেন 'কা কা'-এর পরিবর্তে 'খা খা' করে ডাকে?
আব্বুকে সাবধান করার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি পরলোকগমন করলেন। ভাইয়ার মৃত্যুর আগে নিমপেঁচা একেবারে আমাদের বাড়ির সামনের আমগাছে বসে ডাকতো। বাড়িতে গেলেই এই পেঁচার আওয়াজ আমার আত্মা কলিজা ছিঁড়ে খেতো একেবারে। ডাকটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলে টের পাওয়া যায়। মনোযোগ না দিলে নিজের মনুষ্য জীবনের গৌরবে বুঁদ হয়ে থাকলে বোঝা মুশকিল হয়। কোকিলও 'কুউ' বলে ডাকে নিমপেঁচাও 'কুউ' ধ্বনিতে ডাকে। কিন্তু কোকিলের মতো নিমপেঁচার ডাক কোনোপ্রকার উচ্ছ্বাস জোগায় না কেন?
বছর বিশ পঁচিশ আগের এক রোজার দুপুরে অনেকগুলো কাক আমাদের গ্রামের বাড়ির পাশের ভাঙা দালানের উপরে 'খা খা' করে ডাকছিলো। সেদিনই ভাঙা লাল দালানের একটি মেয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলো। আহা আজও কাকের এরকম 'খা খা' ডাক শুনলে আত্মা কেঁপে ওঠে আমার।

বেড়াল কুকুরের কান্না, হুতুম আর নিমপেঁচার ডাক, উত্যক্ত না করা সত্ত্বেও অনেকগুলো কাকের একসঙ্গে 'খা খা' করা ডাক আমাদের বাস্তুবিজ্ঞানে কি কোনো অমিয় বার্তা দিতে চায়? আমরা অনেক কিছুর রহস্য উদঘাটন করতে না পেরে তাকে 'কুসংস্কার' বলি। আবার পরীক্ষিত কুসংস্কারকে আমরা ধর্মজ্ঞান মনে করি। কারণ কী?
নিমপেঁচা ডাকে। আমরা পাখির ডাক শুনি। জীব-বৈচিত্রের কিচ্ছা বয়ান করি। জীবন-মৃত্যুর হিসাব কিছুই বুঝি না। বোঝার মতো অতো সময় আমাদের নাই। কানে যেসব আওয়াজ আসে তার মধ্যে 'দ্রুত চলতে হবে'র তাড়া যেভাবে সুর সাধে এর বাইরের কিছুই কানে পৌঁছে না। মাঝে মাঝে সংগীত কানে গুঁজি, তাও তারও নির্দিষ্ট বলয় আছে। প্রকৃতিতে কতো সে সুর আছে।  প্রাণীরা কতো কী যে বলতে চায় সুরে সুরে! আমরা আমাদের মানব জন্মের শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই দিয়ে ঢেকে রাখি আমাদের ইন্দ্রিয়।

আরও পড়ুন : আমার দস্তইয়েভস্কি

অস্ট্রেলিয়ার নৈতিকতার দার্শনিক পিটার আলবার্ট ডেভিড সিংগারের বরাত দিয়ে দীপেশ চক্রবর্তী তাঁর 'মানবিকতা ও অমানবিকতা' গ্রন্থে বলছেন,' যদি গাছ কেটে বন উজাড়ও করে দাও, আমার কিছু বলার নেই,আমার বলার কথা হচ্ছে কোন কোন প্রাণীর সঙ্গে আমাদের নৈতিক সম্পর্ক তৈরি করতে হবে__ অর্থাৎ সেইসব প্রাণীর যাদের মনের মধ্যে আমার অবভাসতাত্ত্বিক অধিগম্যতা(phenomenological access)আছে, অর্থাৎ যেসব প্রাণী বা জন্তু পৃথিবীটাকে খানিকটা মানুষের মতো করে অভিজ্ঞতা করে, সেইসব জন্তু। যেমন,আমরা অনেকসময় বলি__ কুকুরটার মন খারাপ হয়েছে... বিড়ালের ডিপ্রেশান হয়েছে। '


আমরা 'অ্যানথ্রোপসেন্ট্রিক' চিন্তা করতে গিয়ে ভুলে যাই পৃথিবীতে মাইক্রোবিয়াল লাইফের কথা। দীপেশ চক্রবর্তী বলছেন,
'অথচ সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, একটু খোঁজ করলে দেখবেন যে, আপনি যদি একটি কাল্পনিক দাঁড়িপাল্লার একদিকে মানুষ, হাতি, ঘোড়া, জন্তুজানোয়ার, অর্থাৎ যেসব প্রাণী চোখে দেখতে পাই তাদের যদি একদিকে রাখেন, আর অন্যদিকে মাইক্রোবিয়াল লাইফ রাখেন, তাহলে শুধু সংখ্যায় নয়, ওজনেও মাইক্রোবিয়াল লাইফ অনেক বেশি। এই পৃথিবীর বেশিরভাগ জীবনই মাইক্রোবিয়াল। '(পৃষ্ঠা:৩৭ মানবিকতা ও অমানবিকতা)

তাহলে যেখানে আমরা সাধারণ মানুষ মাইক্রোবিয়াল লাইফ সম্পর্কে প্রায় কিছুই আন্দাজ করতে পারি না, সেখানে পৃথিবীর সেন্সবল প্রাণীদের টিউন কীভাবে ধরতে পারবো?

শিল্প সাহিত্যে কিন্তু এইসব প্রাণীদের আলাদা-আচরণকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই দেখা হয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একজন বিজ্ঞানমনস্ক লেখক হওয়া সত্ত্বেও তাঁর উপন্যাস গল্পে শকুন, কাকের আলাদা-আচরণের উল্লেখ আছে। পেঁচা পাখিজগতের আদিমাতা বলেই কি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় এতো পেঁচা পছন্দ করতেন? মনে হয় না। অন্তত তাঁর 'আট বছর আগের একদিন' কবিতাটি পড়লে কখনোই এটা মনে হয় না যে, কবি আহ্লাদের ঠেলায় পেঁচাকে বরণ করেছেন। এ কবিতাটিকে হৃদয়গ্রাহী, বেদনাশ্রিত ও রহস্যময় করে তুলেছে মূলত পেঁচা। যেমন:

'থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে
বলেনি কি: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে
চমৎকার!

ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার!’
জানায়নি পেঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?'

আচ্ছা এখানে কবিকে পেঁচা কী সমাচার জানায়?
পেঁচার চিহ্নিত ডাক শুধু যে আমার নির্জ্ঞানমনকে তাড়িত করে তা নয়, বিজ্ঞানমনস্ক ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি জীবনানন্দকেও প্ররোচিত করে। প্ররোচিত করে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির প্রমুখকে।
এই প্রতিযোগিতামূলক বাজারনির্ভর পৃথিবীতে সবাই সবার উন্নত পলিসির গুণগান প্রচার প্রতিষ্ঠাতে ব্যস্ত। কই কেউ তো কোনো ধ্বংসের পলিসি নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে আসে না? মানুষের বিনাশ দেখতে পারার মতো অতো বড়ো মনোবল মানুষের নাই। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, মানুষের বিনাশ করতে পারার হিম্মত আর হীনম্মন্য মনটা আছে মানুষের।

কুকুর,বেড়াল, কাক, পিঁপড়া, পেঁচাদের ক্ষেত্রে উলটো। এরা চক্রান্তমূলকভাবে সৃষ্টিকে বিনাশ করতে নয়, বরং অনেক সময় বিনাশের সতর্কবাণী প্রচার করে এই মানুষসর্বস্ব পৃথিবীকে সাহায্য করে কোনটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার অভাবে 'কুসংস্কার' আর কোনটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাসত্ত্বেও ধর্মের মর্যাদাভুক্ত সেই ভেদজ্ঞান না হয়েই আমরা মৃত্যুবরণ করি।

নাহ, আমি এভাবে চতুর্দশপদীর মতো মরতে চাই না।  

লেখক পরিচিতি : কবি, লেখক ও শিক্ষক। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।   বর্তমানে সরকারি বিজ্ঞান কলেজে কর্মরত।

news24bd.tv/ডিডি