যুক্তরাজ্যের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে যে কারণে মায়ের কাছেই ফিরলেন আবিদুর

পরিবারের সঙ্গে আবিদুর

যুক্তরাজ্যের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে যে কারণে মায়ের কাছেই ফিরলেন আবিদুর

সাইয়েদ আবদুল্লাহ

‘মায়ের জন্য যুক্তরাজ্যের লোভনীয় চাকরি ছাড়লেন অধ্যাপক’ এই হেডিংয়ে পত্রিকায় একটা হেডলাইন দেখেই লেখাটাতে চোখ বুলালাম আগ্রহ নিয়ে। লেখাটা খুব মনে ধরলো। এরপর আবিদুর রহমানকে ফেসবুকে সার্চ করে খুঁজে বের করলাম। ফেসবুকে তার বিভিন্ন পোস্ট দেখেই বুঝে গেলাম মায়ের প্রতি তার আবেগটা কেমন।

এখানে যেই ছবিটা দেখতে পাচ্ছেন, সেটা তার ওয়াল থেকেই নিয়েছি। ইনিই আবিদুর রহমান, সাথে আছেন তার মা। এই আবিদুর রহমান আর তার মাকে কেন্দ্র করেই এই লেখাটা। আবিদুর রহমানের বাড়ি সিলেটে।
ছোটবেলায় পড়াশোনা করেছেন সিলেট ক্যাডেট কলেজে। মালয়েশিয়াতে পড়াশোনা করেছেন কিছুদিন। এরপর সেখানেই খণ্ডকালীন চাকরির পর বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির সুবাদে থিতু হন ওমানে। সেখানেই স্ত্রী, বাচ্চা মেয়ে আর নিজের মাকে নিয়ে বাস করতেন।  

শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন ওমানের একমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সুলতান কাবুসে। ২০২২ সালে অফার পেলেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব হাডারসফিল্ডে। সেখানে যোগ দেন সিনিয়র লেকচারার হিসেবে। তার জব ছিল ফুল টাইম এবং স্থায়ী, সেইসঙ্গে ছিল অবসরকালীন সুবিধাও। ফলে সব মিলিয়ে তার চাকরিটা ছিল লোভনীয়। কিন্তু বিপত্তিটা বাধলো অন্য জায়গায়। ওমানে আবিদুর রহমান থাকতেন নিজের মা, স্ত্রী, বাচ্চাকে নিয়ে। কিন্তু যুক্তরাজ্য তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেও তার মাকে ভিসা দিলো না। সত্যি বলতে সে যে ধরনের ভিসা পেয়েছিল, তাতে বাবা-মাকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। তবুও যেহেতু যুক্তরাজ্যের চাকরিতে সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি ছিল, তাই মা চাচ্ছিলেন তার ছেলে সেই সুযোগটা গ্রহণ করুক। মায়ের জোরাজুরিতে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমালেন আবিদুর রহমান। এ ক্ষেত্রে সমর্থন পেয়েছেন তার স্ত্রী নায়লা শারমিনের।  

প্ল্যান ছিল আবিদুর যাবেন যুক্তরাজ্যে, আর নায়লা শারমিন তার মেয়ে ও শাশুড়িকে নিয়ে দেশে ফিরে আসবেন। এরপর আবিদুর ওখানে গিয়ে তার মায়ের ভিসা ম্যানেজ করার চেষ্টা করবেন। আবিদুর যুক্তরাজ্যে গিয়ে ভার্সিটিতে জয়েন করার পর বহু চেষ্টা করতে থাকেন মায়ের ভিসা পাওয়ার। কিন্তু কোনোভাবেই ম্যানেজ করতে পারেননি। তাই শেষমেশ লোভনীয় ওই চাকরিটাই ছেড়ে দিয়েছেন। তখন এপ্লিকেশন করেছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের ইউনিভার্সিটি অব শারজায়, এখানে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে চাকরিতে জয়েন করে যুক্তরাজ্যের লোভনীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে টিচিংয়ের প্রফেশন ছেড়ে এখন উনি শারজাহতে বাস করছেন মা-সহ পুরো পরিবার নিয়ে। আবিদুর রহমান ওই পত্রিকায় ইন্টারভিউতে জানিয়েছেন, বাবা যখন মারা যান, তখন আমার বয়স ছিল ১০ বছর এবং আমার বোন হুমায়রার বয়স ৫। আম্মা তার এই ছোট দু’টি সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের সব সুখ বিসর্জন দিয়েছেন। আম্মা আমাদের মানুষ করতে অনেক সংগ্রাম করেছেন। আব্বাকে তো সেভাবে পাইনি, তাই আমাদের কাছে আম্মাই ছিলেন ‘আব্বা ও আম্মা’। ফলে আমার জীবনে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আম্মার কথাই প্রথমে মাথায় আসে।

যুক্তরাজ্যের চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার কারণটা কী ছিলো এই প্রশ্নের জবাবে আবিদুর রহমান বলেন ‘আমি কয়েক বছর যুক্তরাজ্যে বসবাস করলে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পেয়ে যেতাম। আমার মেয়ে সে দেশের নাগরিক হিসেবে বড় হতো। কিন্তু আমি তো এমন সুখ চাইনি, যেখানে আমার মা সাথে থাকবেন না। আম্মা তো নিজের পুরো জীবন আমাদের জন্য সেক্রিফাইস করলেন, সেখানে আমি এটুকু করতে পারব না কেন? এই চিন্তাই সবসময় কাজ করত। তাই যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটা ছেড়ে দিই। মায়ের কাছে ফিরে আসি। এখন দুনিয়ার শান্তি। মাকে নিয়ে আছি। ’  একজন আবিদুর রহমানের গল্পটা পড়তে পড়তে চোখের সামনে বেশ কয়েকটা ঘটনা ভেসে উঠলো। আমি এমন বেশকিছু পরিবারকে চিনি যেখানে সন্তানরা সব বিদেশ থাকে, বৃদ্ধ বাবা মা থাকে দেশে। এমন না যে বাবা-মাকে দেখে না তারা। টাকা-পয়সা পাঠায়, যখন যা প্রয়োজন সেটা মেটানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সবকিছু করেও সবচেয়ে বড় জিনিসটাই অপূর্ণ থেকে যায় সেটা হলো সঙ্গ।  

আমি এমন দৃশ্যও দেখেছি বেশ কয়েকটা, যেখানে সন্তানরা বিদেশে বড় বড় চাকুরে, বহু টাকাপয়সার মালিক, বাবা-মাকে দেখার জন্য দেশে লোক রেখে দিয়েছে, বহু খরচ করেছে, কিন্তু বাবা বা মা মারা যাওয়ার সময় ছটফট করতে করতে মারা গেছে আপন মানুষহীনতায়। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে নিজের সন্তানকে বুকে জাপটে ধরতে না পারার আক্ষেপ নিয়েই পরপারে চলে গেছেন। জীবনের একটা সময় পর এসব বৃদ্ধ বাবা মায়ের কাছে হয়তো ম্যাটেরিয়ালিস্টিক কোনকিছুর আর তেমন মূল্য থাকে না, তারা শুধু সন্তান এবং পরিবারের সঙ্গটুকুই চায়। নিজের সন্তানদের সঙ্গে একসাথে সুখ-দুঃখের অনুভূতিগুলো ভাগ করে নিতে চায়, এটাই বোধহয় তাদের কাছে সবচেয়ে দামি জিনিস হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু চরম পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা আমাদের জীবনের সুখের সংজ্ঞাটা হয়তো বদলে দিয়েছে। ম্যাটেরিয়ালিস্টিক জীবনের প্রতি আমরা ছুটতে ছুটতে এতোটাই ক্লান্ত হয়ে পড়ি যে স্পিরিচুয়ালিটির সন্ধান আমরা যেন খুঁজেই পাই না, আমরা মজে আছি শুধু সামনে দৌঁড়ানোর দিকে, কিন্তু এই দৌঁড়টা যে আমাদের পেছনের কত আবেগ অনুভূতির সুতোকে ছিঁড়ে আমাদেরকে ক্রমশ সমাজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে করতে একা, ভীষণ একা বানিয়ে দিচ্ছে, সেটা হয়তো নিজেরা বুঝতেও পারছি না।  

এই ব্যাপারটা অনেকে না বুঝতে পারলেও আবিদুর রহমান সেটা পেরেছেন। আর তার এই পারার পেছনে আরেকটা মানুষের ডিরেক্ট অবদান আছে, যেটা স্বীকার না করাটা হবে অন্যায় সেটা হলো তার স্ত্রী নায়লা শারমিনের ভূমিকা। তিনিও কোনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা না করে নিজের শাশুড়ির জন্য যে দরদ আর সহযোগিতার মনোভাব ধরে রেখেছেন, সেটাই হয়তো আবিদুরের কাজটাকে সহজ করে দিয়েছে বহুগুণ। আবিদুর রহমানের একটা কথা কেন যেন মনে বিঁধে গেছে একদম, ‘আমি তো এমন সুখ চাইনি, যেখানে আমার মা সাথে থাকবেন না। ’ এই কথাটার ভেতর যে গভীর দরদ আর দর্শন লুকিয়ে আছে, আমরা ঠিক কতজন সেটা বুঝতে পারি? 

news24bd.tv/ডিডি