বিভিন্ন দেশে যেভাবে হয় ঈদ উদযাপন

বিভিন্ন দেশে যেভাবে হয় ঈদ উদযাপন

অনলাইন ডেস্ক

মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের একটি ঈদুল ফিতর। পবিত্র রমজানে মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর ঈদের খুশিতে মেতে ওঠেন সবাই। শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ঈদুল ফিতর পালন করে বিশ্ববাসী। সেক্ষেত্রে কোনো দেশে একদিন আগে আবার কোনো দেশে একদিন পরে ঈদ উদযাপন হয়।

সব দেশে ঈদ উদযাপনে কিছু মিল দেখা যায়, তবে দেশভেদে কিছু ভিন্নতাও রয়েছে।

সাধারণত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোয় ঈদ উপলক্ষে তিন দিনের সরকারি ছুটি থাকে। তবে দেশভেদে ছুটির দিনের সংখ্যায় তারতম্য দেখা যায়। ঈদের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় ঈদের নামাজের মধ্য দিয়ে।

সাধারণত ঈদের দিন সকালে এই নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।

দেশে দেশে ঈদগাহে খোলা আকাশের নিচে হাজারো মানুষ সমবেত হন। বেশিরভাগ মানুষের পরনে থাকে ঈদের নতুন জামা। মনে উৎসবের আমেজ। ঈদগাহে সমবেত হয়ে একসঙ্গে তারা নামাজ আদায় করেন। দেশ, জাতি ও সম্প্রদায়ের জন্য দোয়া করেন। ‘আল্লাহু আকবর’ বলে খোদার প্রশংসা করেন। নামাজের পর কোলাকুলি করেন। জেনে নেওয়া যাক বিশ্বের কোন দেশে কীভাবে ঈদ উদযাপন হয়।  

সৌদি আরব

ঈদের নামাজ আদায়, নতুন পোশাক, ঐতিহ্যবাহী খাবার, অসহায়দের সাহায্য আর প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে ঈদ উদযাপন করা হয় সৌদি আরবে। ঈদ উপলক্ষে দেশটিতে তিন দিন সরকারি ছুটি থাকে। ঈদকে কেন্দ্র করে বাড়ি-ঘর সাজানো, ঈদ সেলামি, ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন, অতিথি আপ্যায়নসহ নানা আয়োজন থাকে দেশটিতে।  

ঈদের নামাজ শেষে পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয় সৌদিবাসী। আমাদের দেশের সালামির মতো এ সময় প্রিয়জন বিশেষ করে শিশুদের দেওয়া হয় অর্থ, খেলনা ও নতুন পোশাকের মতো বিভিন্ন উপহার। এমনকি অমুসলিমদের উপহার দিতেও তারা ভুলেন না।  

ঈদের নামাজ শেষে বাড়িতে বিশেষ খাবার রান্না হয়। তৈরি হয় ভেড়ার মাংস আর টমেটোর সমন্বয়ে তৈরি সুস্বাদু ঐতিহ্যবাহী খাবার মুগালগাল। আরও তৈরি করা হয় মসলাযুক্ত মাংসের সঙ্গে গম দিয়ে তৈরি জারেশ। সঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী আরব দেশের মিষ্টি জাতীয় খাবার তো রয়েছেই।

ঈদের দিন সৌদি মুসলিমরা অসহায় ও দুস্থদের সাহায্য করে থাকে। এটা দেশটির ঈদ উদযাপনের অংশ। মানুষের মাঝে উদারতার কোনো কমতি থাকে না এই দিনে। এদিন তারা বাজার থেকে বেশি পরিমাণে চাল কিনে আনে। আর তা বাড়ির প্রবেশ দরজার বাইরে রেখে দেয়। যেন অসহায় ও অভাবগ্রস্ত মানুষ তা নিয়ে প্রয়োজন মেটাতে পারে। এছাড়াও এই দিনটিতে গরিবদের মধ্যে খাবার বিতরণও করা হয়।  

ঈদ উপলক্ষে এই দিনে অনেক দোকানি ক্রেতাদের জন্য বিশেষ ছাড়া দেন।

ইন্দোনেশিয়া

জনসংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া। কিন্তু বাংলাদেশের মতো এত আড়ম্বরপূর্ণভাবে সেখানে ঈদ উদযাপন হয় না। ঈদ বলতে আমরা যা বুঝি, ইন্দোনেশিয়ায় সেটির একশ ভাগের এক ভাগও নেই। ঈদ নিয়ে উচ্ছ্বাস, আবেগের দেখা মেলে না। লোকজন ব্যস্ত যে যার প্রাত্যহিক কাজে। আজ কি ঈদ? প্রশ্ন করলে অনেকে বুঝতেও পারেন না। বুঝিয়ে বলার পর কেউ কেউ হয়তো বললেন, ‘ইয়েস ইয়েস, টু ডে ঈদুল ফিতর। ’

বাংলাদেশে যেমন ঈদ ব্যানার-ফেস্টুনের শুভেচ্ছায় রাস্তাঘাট ভরিয়ে ফেলা হয়, তবে ইন্দোনেশিয়ানরা এই সংস্কৃতি থেকে অনেক দূরে।

তুরস্ক

বাংলাদেশে ঈদের ছুটি তিন দিন। তবে তুরস্কে শুধু ঈদের দিনই ছুটি দেওয়া হয়। ঈদের দিনেও সরকারি অফিস ছাড়া প্রায় সবই খোলা থাকে। সাপ্তাহিক ছুটি শনি ও সোমবার। এই দিনগুলোতেও শহর থাকে ব্যস্ত। কোনো কিছু নিয়ে উচ্ছ্বাস, আনন্দ প্রকাশে বাড়াবাড়ি নেই সেখানে।  

তুরস্কের মানুষ ঈদ উদযাপন করেন সমুদ্র সৈকতে। তপ্ত রোদে সমুদ্র সৈকতে এসে ভিড় জমান সবাই। ঈদের ছুটি কাটাতে তুরস্কের বিভিন্ন সমুদ্র সৈকতে পরিবারসহ সময় কাটান তুর্কিবাসীরা। তুরস্কের জনসংখ্যার প্রায় ৯৮ শতাংশই ঈদুল ফিতরের ছুটিতে সেখানকার বিভিন্ন প্রদেশে ভ্রমণ করেন।

এছাড়াও অনেকে ঈদুল ফিতরের প্রথম দিন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন তারা সমুদ্রে কাটান। এ সময় তারা মাছ ধরা, সাঁতার কাটাসহ এবং আনন্দ হুল্লোড়ে মেতে ওঠেন। বালুকাময় উপকূলে বসে সমুদ্রের ঢেউ দেখেই পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করে থাকেন তুর্কিবাসীরা। ঈদ মানে তাদের কাছে বিশ্রাম, আনন্দ, আবার বিশ্রাম!

ঈদের দিন তুরস্কের অন্যতম খাবার লোকুম। হরেক রঙের মিষ্টির টুকরো এই ‘লোকুম’ মূলত টার্কিশ ডিলাইট। বরফি আকৃতির বিশেষ এই মিষ্টি তুরস্কের সব ঘরেই ঈদের দিন তৈরি করা হয়। চিনি, স্টার্চ আর খেজুর, বাদামের মতো উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয় এই ডেজার্টটি। এই মিষ্টি তৈরিতে নানারকম রঙও ব্যবহার করা হয়। শুধু ঈদ নয় তুরস্কের যেকোনোও উৎসব আয়োজনে এই মিষ্টি থাকে সবার ঘরে ঘরে।

ইরান
ইরানে ঈদুল ফিতর উদযাপন মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য এবং আনন্দের উপলক্ষ। এ দিন দেশটির পরিবার এবং সম্প্রদায়গুলো মসজিদে বিশেষ প্রার্থনায় যোগ দেয়। শুভেচ্ছা বিনিময় করে। প্রিয়জনদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খায়। ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি ও খাবারগুলি প্রস্তুত করা হয়। অপক্ষেকৃত স্বচ্ছলরা অভাবি ব্যক্তিদের খাবার দেন, সাহয্য দেন।

এই দিনে পুরুষরা কান্দর নামের সাদা পোশাক পরিধান করে মাথায় দেয় গাহফিহ নামের টুপি। নারীরা এই দিনে থাউব নামের বিশেষ পোশাক পরে থাকে।

সিঙ্গাপুর

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ সিঙ্গাপুর। দেশটিতে ঈদ উদযাপিত হয় বেশ জাঁকজমকে। গিলং সেরাই এলাকায় ঈদুল ফিতরের দিন রঙিন আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। গিলং সেরাইয়ের রাস্তাগুলো ঈদ উপলক্ষে সাজানো হয় বেশ ঘটা করে। পঞ্চাশটিরও বেশি আলোক এবং ভিজ্যুয়াল ইনস্টলেশনের মাধ্যমে আলোকসজ্জা করা হয় সেখানে।

গিলং সেরাইকে কেন্দ্র করেই সিঙ্গাপুরের ঈদুল ফিতরের উৎসব পরিপূর্ণতা পায়। সেখানেই সব মুসলিমরা ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে ভিড় জমায়। ১০০'র খাবারের দোকান বসে। যেখানে ঐতিহ্যবাহী মালয় খাবার পরিবেশন পাওয়া যায়। চোখ ও পেট ভরাতে সিঙ্গাপুরে একবার হলেও ঈদুল ফিতর উদযাপন করতে পারেন।

আইসল্যান্ড

আইসল্যান্ডবাসী মুসলমানরা প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা রোজা রাখেন। তারা রাজধানী রেকজাভিকের কয়েকটি মসজিদে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। মসজিদের আশেপাশের এলাকাতেই অতিথিদের সমাগম ঘটে। সেখানেই তারা পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করেন। এ সময় তারা ইন্দোনেশিয়ান, মিসরীয় এবং এরিটরিয়ানে বিভিন্ন খাবার ও পানীয় খেয়ে থাকেন। শিশুরা নতুন পোশাক পরে ছোটাছুটি করে। এভাবেই আইসল্যান্ডবাসীরা ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করেন।

মিসর

মিসরে ঈদুল ফিতর শুরু হয় ঈদের নামাজ পড়ার মাধ্যমে। এরপর পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের সঙ্গে যুবকদের দেখা করার নিয়ম আছে। এ সময় প্রবীণরা পরিবারের অল্পবয়সীদেরকে একটি ছোট টোকেন বা সালামি দেয়। অনেক মিসরীয়রা ঈদ উদযাপনের জন্য সরকারি বিভিন্ন উদ্যান এবং চিড়িয়াখানায় পরিবারসহ ঘুরতে যান। গির্জা-চিড়িয়াখানা সবার জন্যই অন্যতম জনপ্রিয় এক স্থান।

নিউজিল্যান্ড

নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে ঈদুল ফিতরের উৎসব শুরু হয় সকালে নামাজের মধ্য দিয়ে। তারপরে ইডেন পার্কে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাই অ্যানুয়াল ঈদ ডে’। সেখানে বিভিন্ন আয়োজন দেখতে ভিড় জমান নিউজিল্যান্ডবাসী। বিভিন্ন কার্নিভালের আয়োজন ছাড়াও খাবারের দোকান বসে সেখানে। সবাই মেতে ওঠে আনন্দ উৎসবে। অনেকটা সাংস্কৃতিক উৎসবের মতো উদযাপিত হয় নিউজল্যান্ডের ঈদুল ফিতর। এই বিশেষ অনুষ্ঠানে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য যেমন শিক্ষামূলক, তেমনি বিনোদনমূলক। এটি সর্বস্তরের মুসলিম দর্শকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত।

মরক্কো

অন্যান্য দেশের মতো মরক্কোতেও সকালে ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ঈদের নামাজ শেষে পারস্পারিক খোঁজ-খবর নেওয়া একটি সাধারণ রীতি। দেশটিতে ঈদে যে বিশেষ খাবার খাওয়া হয়, তার নাম ‘তাজিন’। ঐতিহ্যগতভাবে এই রান্নাতে ব্যবহার করা হয় মাটির পাত্র, যেটার নাম তাজিন। আর ওই মাটির পাত্রের নামানুসারে রান্নার নামকরণও হয়েছে তাজিন। সাধারণত ভেড়া ও গরুর মাংস দিয়ে তৈরি করা হয় এই খাবারটি। তবে মাংসের সঙ্গে নানারকম সবজি ও মশলার মিশ্রণও থাকে এতে। এই খাবার দিয়েই বেশিরভাগ অতিথি আপ্যায়ন করেন তারা।

news24bd.tv/SHS