যেভাবে বদলে যাচ্ছে ঈদ উদযাপনের ধারা

ঈদের কোলাকুলি

যেভাবে বদলে যাচ্ছে ঈদ উদযাপনের ধারা

মো. ইস্রাফিল আলম

সারাদেশে আনন্দ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আজ (১১ এপ্রিল) উদযাপিত হচ্ছে মুসলমানদের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান—‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানের ধ্বনিতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে ঈদের আনন্দ। বহু শতাব্দী ধরে মুসিলম প্রধান এ দেশে নানা আয়োজনে উদযাপিত হয়ে আসছে ঈদ। ঈদের নামাজের পর আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধুদের বাড়িতে যাওয়া এবং আপ্যায়িত হওয়া দিনটিকে নতুন করে সৌহার্দ, সখ্য ও বন্ধুত্বের আবহে মুখর করে তোলে।

এ দিনে নতুন জামাকাপড়, জুতা ও অলংকার সবার জন্যই বিশেষত শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় জিনিস হিসেবে গণ্য করা হয়। সব কিছুই এই দিনে হয়ে ওঠে এক নতুন আনন্দময় সূচনার প্রতীক। যে চিরঞ্জীব আনন্দের ধারা ঈদ উৎসবের মৌলিক উপাদান তারই নবায়ন ঘটে এ দিনে। এই উৎসবের ধরন-ধারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানাভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।
কিন্তু এর মূল প্রকৃতি অপরিবর্তীত রয়েছে।  

চাঁদ দেখায় পরিবর্তন

ব্রিটিশদের হাতে মুঘল সাম্রাজ্যের যখন পতনের মুখে তখনকার সময়ের মুঘল সম্রাটদের ঈদুল ফিতর পালনের কিছু তথ্য পাওয়া যায়। শেষ দুই মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর ও বাহাদুর শাহ জাফর শোভযাত্রা সহকারে দিল্লি জামে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে যেতেন। ঊনত্রিশ রমজানের দিন দিকে দিকে সম্রাটের প্রতিনিধিদের পাঠানো হতো চাঁদ দেখার জন্য। সবার উদগ্রীব নজর থাকত তখন আকাশের দিকে, ঈদের চাঁদ দেখার আশায়। সম্রাটের বার্তাবাহক যখন চাঁদ দেখার খবর নিয়ে ফিরে আসতেন তখনই শুরু হতো ঈদের বাঁধভাঙা আনন্দ। বাজনাঘর বা নাকারখানায় পঁচিশ বার গান স্যালুটের মাধ্যমে ঈদের আগমনী বার্তা ঘোষণা করা হতো। সেদিন চাঁদ দেখা না গেলে গান স্যালুট করা হতো পরদিন, ত্রিশ রোজার সমাপনান্তে।

প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ঈদের চাঁদ দেখায় ঘটেছে পরিবর্তন। এখন আর ছোট-বড় কেউ আকাশের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে না। চাঁদ দেখার জন্য এখন ইন্টারনেটযুক্ত হাতের মুঠোফোনই যথেষ্ট।  

উদযাপনে পরিবর্তন

সপ্তদশ শতকে বাংলা, কুচবিহার, আসাম ও বিহারের সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে মির্জা নাথানের লেখা বিখ্যাত বই ‘বাহারিস্তান ই গায়েবি’তে মুঘল আমলে বাংলার সেনাক্যাম্প ও বিভিন্ন শহরে রমজান ও ঈদ পালনের বিবরণ পাওয়া যায়। মির্জা নাথানের বিবরণী থেকে জানা যায়, সব বয়সের মানুষ রমজানের সময় সেনাব্যারাকে সমবেত হয়ে সেহরি ও ইফতার করতেন। সেসময় ঢাকা মুঘল সাম্রাজ্যের প্রান্তবর্তী অতি সাধারণ একটি জনপদ, এ কারণে পুরনো আফগান কেল্লাকে (পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায়) ঘিরেই মূলত ঈদের উৎসব পালন করা হতো। ঈদের আগের দিন ঢাকার আকাশে চন্দ্রদর্শনের জন্য সবার জড়ো হওয়াও ছিল সে সময়ের অন্যতম ঈদ আকর্ষণ। চাঁদ দেখা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যরা বিউগল বাজিয়ে ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে সে খবর জানান দিত। পদাতিক সেনারা কামান দাগত ও আতশবাজির বিস্ফোরণ ঘটাত। এটি চলত মধ্যরাত পর্যন্ত। ঈদের দিন সেনাব্যারাক, প্রাসাদ ও কিল্লায় ভোজসভার আয়োজন করা হতো। সেখানে ধনি-গরীব একসঙ্গে খানাপিনা করতেন। আয়োজন করা হতো নাচ ও গানের। এছাড়া মুঘল অভিজাতেরা দরিদ্রদেরকে সাধ্যমত দান করতেন।  

যুগের পরিবর্তনে ঈদের আনুষ্ঠানিকতা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। উত্তরাধুনিক যুগে আরও বেশি পরিবর্তন ঘটেছে ঈদ আয়োজনে। এখন দেখা যায়, মানুষ ঈদ উপভোগ করার থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্যকে উপভোগ করানোর পেছনে বেশি ছুটছে। অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই যুগে উৎসব দেখার থেকে দেখানোর মানুষের সংখ্যা বেশি।

আগেকার সময় ঈদের দিনে নারীরা ঘরোয়াভাবে তৈরি করতেন বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবার। স্মার্টফোন না থাকায় তখন তাঁদের মধ্যে ছিল না কোনো কনটেন্ট তৈরি করার প্রচেষ্টা, ছিল না খাবারের ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করার ঝোঁক। শপিং করা নিয়ে গ্রামের নারীদের ছিল না কোনো প্রকার আগ্রহ।  

অনলাইনের ব্যবহার না থাকায় তখন মেয়েরা ঘরে বসেই নতুন নকশার জামার আবদার করতে পারত না। দূরে যাঁরা থাকতেন, তাঁদের ছিল না অনলাইনে অগ্রিম টিকিট কেটে রাখার সুযোগ। ফলে তাঁদের জন্য পরিবারের সদস্যরা অপেক্ষায় থাকত। আগে একান্নবর্তী পরিবার ছিল বলে মানুষ অনেক দূরবর্তী স্থান থেকেও ছুটে আসত পরিবারের সঙ্গে ঈদ উপভোগ করার জন্য। কিন্তু এখন পরিবারগুলো ছোট ছোট হয়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ায় ঈদের আনন্দ আর আগের মতো ভাগাভাগি করা হয় না। শহরের অনেক পরিবারই ছুটে আসত গ্রামে ঈদ উদযাপন করার জন্য। তখন গ্রামের প্রতিটি ঘর মেহমানের আগমনে উৎসবমুখর হয়ে উঠতো। কিন্তু এখন ব্যস্ততার কারণে শহরের মানুষকে কষ্ট করে ঈদ করতে আর গ্রামে যেতে হয় না। বর্তমান সময়ে ঈদ এলেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তখনকার যুগে তা ছিল না।

প্রাধান্য পাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া

একসময় নানি-দাদির গল্প আর গ্রাম্য নানা খেলা ছিল ঈদ আনন্দের উপলক্ষ, কিন্তু সেই বাস্তবতা আজ বদলেছে। বর্তমানে ফেসবুক, মেসেঞ্জার আর আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের দেশের সামাজিক উৎসবগুলো হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের খেলার পুতুল। মানুষ এখন সামাজিক উৎসবের থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে বেশি প্রাধান্য দেয়। কে কার আগে ছবি পোস্ট করবে, কার ছবি কতটুকু সুন্দর হয়েছে, পোস্টে কতগুলো লাইক ও কমেন্ট পড়েছে, এগুলো করতে করতেই তাদের দিন চলে যায়। ফলে আগের মতো আর তারা সামাজিক উৎসব আনন্দমুখরভাবে পালন করতে পারে না।  

ঈদ সালামি

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঈদ আনন্দের ধরনের পরিবর্তন এসেছে। তবে পাল্টায়নি ঈদ সালামির রীতি। শুধু পরিবর্তন হয়েছে দেওয়া-নেওয়ার প্রথায়। ছোটবেলায় সালামি পাওয়ার সুযোগ বেশি থাকলেও, বড় হতে হতে সালামি দেওয়ার হার বাড়ে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সালামি পাওয়ার চেয়ে দেওয়ার অঙ্কটাও বাড়তে থাকে। ঈদুল ফিতরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ সালামি। নতুন পোশাকে নামাজ শেষে কোলাকুলির পরই শুরু হয় বড়দের থেকে সালামি নেওয়ার পর্ব। যুগ বদলালেও চিরাচরিত এই চিত্র চলছেই, এখনো ছোটরা বড়দের কাছ থেকে আশা করেন চকচকে নতুন নোটের ঈদ সালামি। বয়স যাই হোক, সম্পর্কে বড় হলেই ঈদ সালামি দেওয়া যেন অলিখিত নিয়ম।

নব্বইয়ের দশকের তরুণ-তরুণীরাও মনে করতে পারবেন স্মার্টফোন এতটা সহজলভ্য হওয়ার আগের ঈদ সালামি কথা। কে কত টাকা ঈদ সালামি পেল, তা নিয়ে চলত নীরব প্রতিযোগিতা। কিছু টাকা জমলেই দোকানে গিয়ে পছন্দের খাবার কিনে খাওয়ার এক অকৃত্রিম আনন্দ ছিল।  
news24bd.tv/আইএএম

এই রকম আরও টপিক