বৃদ্ধাশ্রম, অবহেলিত শিশুদের ঈদ ও প্রকৃতির বিচার

সাইফুল ইসলাম (স্বপ্নীল)

বৃদ্ধাশ্রম, অবহেলিত শিশুদের ঈদ ও প্রকৃতির বিচার

সাইফুল ইসলাম (স্বপ্নীল)

সময় মানুষের জীবনের কঠিন সত্য বলে!যে সত্য বড়ই অপ্রিয়, তিক্ত ও রুঢ় বাস্তবতার। যৌবনে সর্বশক্তি দিয়ে আয় করে সবার চাহিদা পূরণ করা ব্যক্তিটি বার্ধক্যে সংসারের বোঝা হয়ে যায়। কতশত দিনরাত অক্লান্ত খেটে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, দেহ-মনের উপর অমানুষিক অত্যাচার করে মুখে দু মুঠো অন্ন তুলে দেওয়া বাবা পুরস্কার হিসেবে বার্ধক্যে তাচ্ছিল্য উপহার পায়। সংসারের কত গ্লানি, কত চড়াই উৎরাই পেরিয়ে নিজে দিনশেষে ভালোবাসার বদলে উপহাস, অবহেলা উপহার পেয়ে থাকেন।

নিজেই সংসারে অপাংক্তেয় হয়ে যান। যেন নিজ ঘরে পরবাসী।  

সংসারে যৌবনের রাঙা বউ হয়ে আসা মেয়েটি মায়ের বয়সী শাশুড়িকে সহ্য করতে পারে না। নতুন সংসারে এসে সবকিছুকে আপন করে নিতে চায় অনেক মেয়ে।

শ্বশুর-শাশুড়ি স্বামী-সংসার সব যেন তার কাছে প্রায়োরিটি। আবার প্রায়শই হয়ে দেখা যায় বেশিরভাগ বউ-শাশুড়ি মা-মেয়ে সম্পর্কের বদলে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, বিষোদ্গার, অবিশ্বাস করে থাকেন। এক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক,সাংস্কৃতিক ফ্যাক্টরগুলো সমস্যার মূলে কাজ করে। ৩০ বছর পরম আদর-যত্নে, ভালোবাসা ও স্নেহে গড়ে তোলা সন্তানটি যখন একটি মেয়েকে ঘরে বউ করে নিয়ে আসেন অনেক মা সেটাকে সহজভাবে মানসিকভাবে মেনে নিতে পারেন না। আবার নববিবাহিত বউ সংসারে এমন প্রভাব খাটাতে চান যেন তিনি ৩০ বছরের সম্পর্ককে থোরাই কেয়ার করেন। এভাবেই মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ঝগড়া-বিবাদ ও পারিবারিক কলহে রূপ নেয়। অনেকেই বলে থাকেন আমি বউ চাই না, আমি তোমাকে মেয়ে হিসেবেই চাই। যেমন মা-মেয়ের সম্পর্ক অমলিন, অটুট ও মধুর হয়! কিন্তু দিন কয়েক না যেতেই সেই সম্পর্কে চিড় ধরতে থাকে। সংসারের নানা হিসাব-নিকাশ, পীড়নে পড়ে হরহামেশাই মনকষাকষি, ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হন। একটু আদর-স্নেহ-ভালোবাসা, মমতা ও উদার মন-মানসিকতা এ ধরনের অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে পারে।

স্লামডগ মিলিয়নিয়ার কিংবা বালান মুভির শিশুদের সঙ্গে এযুগের লাখ লাখ শিশুর মিল পাওয়া যায় কি?অবশ্যই যায়। জীবনের গ্যাড়াকলে পড়ে এ সকল নিষ্পাপ শিশু কত অবহেলা, বঞ্চনা ও তাচ্ছিল্যের শিকার হন! জীবনের রুঢ়তা এভাবে তাদের নিষ্পেষিত করে কেন? তাদের জন্মই কি আজন্ম পাপ? নিজে ন্যূনতম অন্যায়-অপরাধ না করে সারা জীবন দুঃখ ও কষ্টের গ্লানি বয়ে বেড়াবে; এটাই কি তাদের নিয়তি? অন্যের পাপের ফল বা অবহেলার দায় তারা কেন সইবে? এ কেমন বিচার? কিন্তু তাদের জীবনের দুর্ভোগ কষ্ট লাগবে কারো দায় আছে কি? 
পৃথিবীর সম্পদের অধিকাংশ মজুদ আছে মাত্র পাঁচ ভাগ ব্যক্তির কাছে। এই এলিট শ্রেণির ধনী মানুষগুলো ছিন্নমূল অসহায় মানুষদের স্বাবলম্বী ও আত্ম-নির্ভরশীল হতে সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু আদৌ তারা করবেন কি? বাস্তবতা হচ্ছে সম্ভবত করবেন না। এ পৃথিবীর একটা রুঢ় বাস্তবতা হলো সবাই তেলা মাথায় তেল দিতে চায়, জটা চুলের হাল কেউ নিতে চায় না। পুঁজিবাদী সভ্যতা মানুষের আবেগ, অনুভূতি কেড়ে নিচ্ছে; বিসর্জন দিতে হচ্ছে বিবেক।

রোজার দীর্ঘ ৩০ দিনে ও পবিত্র ঈদের দিনে খুশির আমাজে অনেকেই থাকে কিন্তু থাকে না এতিমখানার অথবা নামগোত্রহীন রাস্তার টোকাই বলে তাচ্ছিল্য করা শিশুটি কিংবা সেই অনাথ শিশুটি যার হয়তোবা কেউ নেই, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই; থাকে না বৃদ্ধাশ্রম এর সেই বাবা মায়েরা যাদের সন্তান-সন্ততি, অর্থকড়ি, জায়গা-জমি কোন কিছুই নেই অথবা থাকলেও তাদের খবর কেউ রাখেন না কিংবা তাদের সম্পদ, জায়গা-জমি কেউ জবরদখল করে আছেন। তাদের কথা কি আমরা কেউ কখনো ভেবেছি? আমাদের হৃদয় কি কখনো নাড়া দেয় না ? তাদের কষ্টের কথা ভেবে চোখ ছলছল করে উঠে না! যদি উঠে থাকে তাহলে আমরা সৃষ্টির সেরা জীব বা আশরাফুল মাখলুকাত।  

বছর কয়েক আগে আমি ঢাকার উত্তরার আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রমে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আমাদের আলোকিত সমাজের উদ্যোগে কিছু খাবার নিয়ে যাই। সেখানে নামপরিচয়হীন ষাটোর্ধ্ব বিভিন্ন বয়সী মায়েরা থাকেন। যাদেরকে হয়তো রাস্তায়, ফুটপাতে, বাস-ট্রেন স্টেশনে অসহায়, নিঃস্ব অবস্থায় পাওয়া গেছে। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে তাদের ভরণপোষণ ও চিকিৎসা পরিচালনা করে একটি অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তাদের কখনো খেয়ে না খেয়েও থাকতে হয়। তাদের অনেকেরই করুন ইতিহাস রয়েছে। তাদের অনেকেরই ছেলে-মেয়ে দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তাদের বাসায় এতো দামি আসবাব টাকা-পয়সা, সোনা-গয়না, চাকর-বাকর সবার জায়গা হলেও বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জায়গা হয় না!চাকরবাকরদের জন্য সারভেন্ট রুম থাকলেও বৃদ্ধ পিতামাতার জন্য জায়গার বড়ই অভাব! তাদের কাছে  বৃদ্ধ বাবা-মা বোঝাস্বরূপ।

ঈদের খুশি অনেকের  মাঝে, ঘরে ঘরে বিরাজ করে । সেই খুশির হাওয়া বৃদ্ধাশ্রমের বাবা-মা কিংবা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের গায়ে লেগেছে কি? পবিত্র খুশির দিনে তাদের খবর কেউ রাখে কি? রাখলে তা কতজনই বা রাখে কিংবা তাদের কথা ভাবে? বৃদ্ধ বাবা-মায়ের প্রতি এটুকু আবদার কি প্রত্যাশিত নয়? এটা কি খুব বেশি কিছু! বাবা-মায়ের পরম আদর-যত্নে, শ্রমে-ঘামে প্রতিষ্ঠিত সন্তান যখন তার পিতা-মাতাকে অযত্ন, অবহেলায় বাইরে রেখে আসে প্রকৃতি তখন কি তা দেখে না? সৃষ্টিকর্তা হয়তো যথোপযুক্ত প্রতিদান নিশ্চয়ই তাদের প্রদান করেন তবে সেটি হয়তোবা তাদের পিতা-মাতা দেখে যেতে পারেন না। তাদের সন্তান-সন্ততিও হয়তোবা তাদের সাথে এমনটি করে থাকে। এটাই ন্যাচারাল জাস্টিস বা প্রকৃতির বিচার। প্রকৃতি ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। জীবনের হিসাব-নিকাশ বড়ই কঠিন, বড়ই নিষ্ঠুর, বড়ই বাস্তব। তাকে উপেক্ষা কিংবা অবহেলা করার সামর্থ্য বা সক্ষমতা কারোরই নেই।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট 

news24bd.tv/ডিডি

এই রকম আরও টপিক