ফেলে আসা ঈদ ফিরে দেখা

গোলাম কবির

ফেলে আসা ঈদ ফিরে দেখা

গোলাম কবির

ঈদকে আমরা উৎসব হিসেবেই দেখি। সেই শৈশবেও দেখেছি। বছরের অনেকটা সময় ধরে ঈদের আগে ছিল আমাদের প্রতীক্ষা। বিশেষ করে কয়েক মাস আগে থেকেই এক আনা, দুই আনা পয়সা জালিতে ভরে শোবার আগে একবার গুনতাম।

কবে এক টাকা হবে। দেশভাগের আগে এক টাকা আর হয়নি। ‘তবু আনন্দ, তবু আনন্দ’ জাগত। এটা ছিল এক ধরনের সামাজিক প্রতিক্রিয়া।

প্রতিবেশীদের পূজার আনন্দ দেখতে দেখতে আমরাও আনন্দ উপভোগে উৎসাহী হয়ে উঠতাম। সে আনন্দ কতখানি ঠুনকো, আজ প্রায় জীবন শেষে একটু একটু বুঝছি।

শীতের দিনে কাঁপতে কাঁপতে গোসল করে পুরনো কাপড় ইস্ত্রি করে অর্থাত্ পরিষ্কার করে ভাঁজ করে বালিশের নিচে রেখে—তা পরে চোখে সুরমা দিয়ে ছুটতাম ঈদের মাঠে। নামাজের আয়োজন অপেক্ষা পাঁচ মিশালি খাবারের দোকানের দিকে নজর থাকত বেশি।

অস্থায়ী দোকানের সেসব খাবার আর কি! ওই যে টক কুলের গোলাকার আচার (এক পয়সা দামের) গুড়ের জিলাপি, গুড়ের পানতোয়া, তিলের খাজা আর আকর্ষণীয় টাটকা ভাজা পাপড়। সাধারণ এসব মুখরোচক খাবার পাড়ায় পাওয়া যেত না। আমরা সেসব নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। আমরা দুই ভাই, তেমন সচ্ছলতা ছিল না পরিবারে। ছোট ভাই একটা ছিল।

তার আবদার কম ছিল না। ঈদের মাঠে যাওয়ার সুযোগ তার হয়নি। তবে ওই জিনিসগুলোর প্রতি তার দুর্বলতা বেশি ছিল বলে ঈদফেরত আমাদের হাতের দিকে বুভুক্ষের মতো চেয়ে থাকত। সব মান-অভিমান হেলায় তুচ্ছ করে সে চলে গেছে। রেখে গেছে আমাদের আনন্দ উপভোগের মাঝে বেদনার বহ্নিজ্বালা। থাক, ভোলা গেল না এ জন্মে সেই চলে যাওয়া। সব অভাব-অভিযোগের মধ্যে যে আনন্দ ছিল, তা আর ফিরে আসেনি। অভাব চলে গেছে, নিয়ে গেছে আনন্দের উপচার।
এ কথা মানতে হবে ধর্মের অনুষ্ঠান হলো নিবেদনের। যে যেখানে আনন্দ পায়, সেটাই তার জন্য উপাদেয় আনন্দ হয়ে ওঠে। আমরা ভেবে দেখতে পারি, পূর্বপুরুষদের পরম্পরা। একদা আজকের মতো আড়ম্বরপূর্ণ ঈদ ছিল না। কাপড়চোপড়, খাওয়াদাওয়ার বৈচিত্র্য তেমন ছিল না। তবে পরিচ্ছন্ন হয়ে সুগন্ধি মেখে উন্মুক্ত মাঠে সবাই জমায়েত হওয়ার মধ্যে ঈদ সমাপ্ত হতো। ঈদের বিশাল ময়দানে ব্যক্তিগত, জাতীয় মুক্তি কামনা করা হতো। এই যে আজকের আড়ম্বর, বোধ করি তখন ছিল না।

আমাদের পোল্লাডাঙ্গার পশ্চিমে মিয়ার বাগান ছিল অনেক বড়। সেখানে এখন বাড়ির জঙ্গল। বাগানের পশ্চিমে একটু খালি জায়গায় হতো ঈদের নামাজ। এখনো হয়। চারপাশে একাধিক গ্রাম। তাই সব পাড়ায়ই পৃথক ঈদগাহ ছিল।

দেশভাগের আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে কোনো ঈদগাহ ছিল না। জনৈক মহকুমা প্রশাসক আব্দুর রাজ্জাক চুরিআল পাড়ার পাশে পরিত্যক্ত আমবাগানে ঈদের নামাজের ব্যবস্থা করেন। তবে আমাদের পোল্লাডাঙ্গা-আজাইপুর ঈদগাহটা কেবল বৃহত্ নয়, দেখার মতো সৌষ্ঠভও ছিল। বাগানের চারপাশে বসতবাড়ি। নামাজের জন্য মানুষ নির্দিষ্ট সময়ে মাথায় টুপি পরে বেরিয়ে আসছে। আর বাড়ির মহিলারা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখে আনন্দ উপভোগ করছে। সব মিলিয়ে দুই-আড়াই ঘণ্টার মধ্যে ঈদ আয়োজন শেষ হয়ে যেত। বাড়ি এসে যে যার মতো বিশ্রম্ভালাপের মধ্যে মশগুল হতো। অবশ্য ফেরার পথে কবরস্থানে কেউ দোয়া করতে ভুলত না। আমাদের পাড়ায় সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী তেমন ছিল না বললেই চলে, যদিও দিনটা ছিল ছুটির। শহুরে মানুষ সে ছুটির আমেজ উপলব্ধি করত।

শহরে ঘোরার জায়গা ছিল কদমতলার ঘাট। তেমন পারাপারের মানুষ নেই। আমরা ছেলে-ছোকরারাই ঘাটে গিয়ে সাধারণ খেলা খেলে সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরতাম। এই ছিল আমাদের দেশভাগের সময়ের ঈদ। ৮৩ বছর পার করে দেখছি, এখন ঈদের চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেছে। আর আমি যেন তেমনটাই রয়ে গেছি। হয়তো বদল হবে না এ জন্মে। সে আশাও করি না—সে যে দুরাশা।

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ 

এই রকম আরও টপিক