বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের ঈদ আয়োজন

গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়া মণিপুর বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্র।

বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের ঈদ আয়োজন

অনলাইন ডেস্ক

মো. রফিকুল ইসলাম (৬৮) ছিলেন পেশায় একজন চিকিৎসক। ঢাকার প্রধান হাসপাতালগুলোতে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী চার ছেলের দুজন চিকিৎসক আর দুজন প্রকৌশলী। পাঁচ বছর আগে স্ত্রীও পাড়ি জমান ছেলেদের কাছে।

শেষ বয়সে এসে রফিকুল ইসলামের নিঃসঙ্গ, একাকী দিনগুলো কাটছে গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়া মণিপুর বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্রে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বৃদ্ধ রফিকুলের সময় এখন কাটে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের রফিকুল ইসলাম থাকতেন রাজধানীর আজিমপুরে। এখন জায়গা হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে।

বুধবার (১০ এপ্রিল) চোখের পানি মুছতে মুছতে রফিকুল ইসলাম বলেন, রাত পোহালেই ঈদ। ছেলে ও স্ত্রীর কথা মনে পড়ে। সবাই থাকতেও আজ আমার কেউ নেই। বেশ কিছুদিন ধরে বৃদ্ধাশ্রমে ঈদ কাটছে। বুকের ভেতর চাপা কষ্ট নিয়ে প্রতিটি ঈদ পার করি। বৃদ্ধাশ্রমে ঈদের সময় ভালো খাবারের আয়োজন করলেও  শুধু খাবারে তো আর মন ভরে না।

রফিকুল ইসলামের চার ছেলের মধ্যে দুইজন পড়াশুনা করেছেন বাংলাদেশে আর দুইজন যুক্তরাষ্ট্রে। ছেলেদের ব্যাপারে রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি যা উপার্জন করেছি সবই ছেলেরা নিয়ে গেছে। এ নিয়ে আমার কোনো আফসোস না থাকলেও বৃদ্ধ বয়সে কেউ আমার খোঁজ নেয় না দেখে কষ্ট লাগে। বাবা হিসেবে আমি সব সময় চাই ছেলেরা ভালো থাকুক। আমি চাই, ওরা এসে আমাকে নিয়ে যাক।

রফিকুল ইসলামের মতো শতাধিক বৃদ্ধ নারী-পুরুষের জীবন কাটছে এই বৃদ্ধাশ্রমে। কেউ পরিবার থেকে বিতাড়িত, কেউ ক্ষোভে পরিবার ছেড়ে এখানে চলে এসেছেন। কারও কারও দেখাশোনা করার মতো কেউ না থাকায় ঠাঁই হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রমে অপরিচিত মানুষের সঙ্গে ঈদের উদযাপন করলেও চরম অসহায়ত্ব আর একাকিত্ব তাদের নিত্যসঙ্গী। তবু যেন বৃদ্ধাশ্রমকেই শান্তির জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তারা। বৃদ্ধাশ্রমের লোকজন নানাভাবে তাঁদেরকে খুশি রাখার চেষ্টা করেন। প্রয়োজনীয় সেবা ও চিকিৎসা দেয়ার পাশাপাশি বিনা মূল্যে খাবার, ওষুধসহ পোশাকও দেওয়া হয়। ঈদেও নতুন কাপড়ের পাশাপাশি তাঁদের জন্য বিশেষ খাবার রান্না করা হয়।

বৃদ্ধাশ্রমের নিবাসী ইফতেখার আহমেদ (৭০) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন। ১৯৯১ সালে স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। একমাত্র ছেলে থেকে যান মায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, ছেলে এখন বেশ বড় হয়েছে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কেউ দেখা করেন না। বয়স হওয়ায় ইদানিং কাজকর্ম করতে অনেক সমস্যা হয়। ২০২১ সালে তিনি নিজেই এ বৃদ্ধাশ্রমে চলে আসেন। ভালোই আছেন। তারপরও ছেলেটার জন্য মন কাঁদে, উল্লেখ করে ইফতেখার আহমেদ বলেন, ঈদে একসঙ্গে সেমাই-পোলাও খাওয়া ভাগ্যে জোটেনি। আমার ছেলে কোথায় থাকে, কী করে, তা-ও আমার অজানা। সে যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক। ঈদেও আনন্দে, ভালোভাবে কাটুক, এ দোয়াই করি।

বৃদ্ধাশ্রমে প্রথমবারের মতো ঈদ করছেন মো. নুরুজ্জামান। পেশায় প্রকৌশলী নুরুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি জামালপুরে। স্ত্রী-সন্তানদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে গত বছরের মার্চে বৃদ্ধাশ্রমে উঠেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্ত্রী-সন্তানদের কথা মনে হলেই তাদের অপমান করার চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠে। বৃদ্ধাশ্রমে আসার পর থেকে কেউ আমার খোঁজ নেয়নি, আমিও কারও খোঁজ নিইনি। আজ আমার সবাই থাকতেও যেন কেউ নেই।

বৃদ্ধাশ্রমে নারীদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা বেলি আক্তার বলেন, অসহায় পরিবারহারা এ মানুষগুলোর সেবা করতে পেরে বেশ ভালো লাগে আমার। এই মানুষগুলোর মাঝে আমি আমার বাবা-মাকে খুঁজে পাই। তাঁদের সেবাযত্ন করি। এখানে সকাল-সন্ধ্যা সবার জন্য আমি কাজ করি। আমার একটুও খারাপ লাগে না। সবাইকে নিয়ে আনন্দে থাকি। এই ঈদে একটা পরিবারের মতো সবাই একসঙ্গে ঈদ করব।

গাজীপুর সদরের মণিপুর বিশিয়া এলাকার খতিব আবদুল জাহিদ ১৯৮৭ সালে রাজধানীর উত্তরার আজমপুর এলাকায় ১২ কক্ষের একটি বাড়িতে এই বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্র স্থাপন করেন। ১৯৯৪ সালে কেন্দ্রটিকে মণিপুর বিশিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। ১৯৯৫ সালের ২১ এপ্রিল নোবেলজয়ী মাদার তেরেসা কেন্দ্রটির সম্প্রসারিত অংশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ওই সময় থেকেই কেন্দ্রটিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলেছে এমন শতাধিক মানুষের।

বৃদ্ধাশ্রমটির তত্ত্বাবধায়ক রবিউল ইসলাম বলেন, ৬০ বছরের বেশি বয়সী যেসব মানুষের পরিবার দেখভাল করতে পারে না, যত্ন নেওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, তাদের কথা চিন্তা করে এ বৃদ্ধাশ্রম বানানো হয়েছে। বর্তমানে এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মধ্যবিত্ত পরিবারের ৮০ জন বৃদ্ধ এবং ৭০ জন বৃদ্ধা বসবাস করছেন।

news24bd.tv/ab

এই রকম আরও টপিক